বাজারে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আওয়ামীরা হঠাৎ ঘাবড়ে গেল কেন? গত একবছর তো বেশ সাহসের সাথেই চালাল। হঠাৎ এতো আগ্রাসী হয়ে ওঠার দরকার কি? কি হত একটা সমাবেশ করতে দিলে। গাজীপুরেরটাই বা আটকানোর দরকার কি ছিল। ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’এর সাথে ছন্দ মিলিয়ে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পয়দা করার দরকারই বা কি ছিল। নিজেদের ম্যোরাল বিজয় দেখানো? মুখে যত বড়বড় কথাই বলুক, আওয়ামীরা বুঝিয়ে দিয়েছে, তাঁরা বেশ বিচলিত। মনে মনে প্রত্যাশা করছে, ভালোয় ভালোয় এই শীতকাল যেন পার হয়ে যায়।
২০০৮এ নির্বাচিত হওয়ার পর যেভাবে আওয়ামীরা দেশ চালিয়েছিল, তাতে দুটো ব্যাপার বেশ পরিষ্কার ছিল। যে যাই বলুক, আমরা নিজেদের মত চলব, প্রয়োজনে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে। স্বৈরতান্ত্রিক তাঁরা আগেও ছিল, তবে এবার তিন চতুর্থাংশ পেয়ে সম্ভবতঃ তাঁদের মাথা আরও বেশি বিগড়াল। বিএনপির ৩২ দেখে ভাবল, ওদের আর কোন আশা নেই। দ্বিতীয়টি যে ব্যাপারটি স্পষ্ট ছিল তা হচ্ছে রাজাকার ইস্যু থেকে যতটা ফায়দা তোলা যায়, সেটা তোলা। দ্বিতীয় প্ল্যানটা খারাপ না হলেও প্রথম দিকে খুব কাজে দিচ্ছিল না। ব্যাপারটাকে অনেকটা বিএনপি জামায়াত বিভেদ তৈরির প্ল্যান হিসেবে দেখছিল সবাই। ভেতরে কি ঘটছিল তা নিয়ে মতামত দেয়া সম্ভব না, কারণ বিচারালয় নিয়ে প্রশ্ন করা সম্ভব না। তবে সবার মনেই সন্দেহ ছিল, জামায়াতের সাথে ভেতরে ভেতরে কোন আঁতাত হচ্ছে। তারপর ঘটনাটা ঘটল।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন আর তার বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো, বিস্ফোরণ ঘটাল। এমন যে ঘটবে বা ঘটতে পারে, তা আওয়ামীরা স্বপ্নেও ভাবেনি। গণজাগরণকে প্রথমে পাত্তা না দিলেও, অচিরেই তাঁদেরকে পাত্তা দিতে বাধ্য হল। রাজাকারদের বিচার চলাকালীন রাস্তায় বিচার বিরোধী অবস্থানই দৃশ্যমান ছিল। বিচারের সমর্থনে তেমন কিছুর দেখা মিলছিল না। তাই একটি রায়ের বিরুদ্ধে এতো বড় সমাবেশ হবে, সরকার নিজেও বোঝেনি। কোন মিছিল মিটিং হরতাল ছাড়া, কেবল অবস্থান দিয়ে যে সরকারের হাড়ে কাঁপন ধরান সম্ভব, ব্যাপারটা প্রথম অনুধাবন করল আওয়ামীরা।
ব্যাপারটা বেগতিক হতে পরে দেখে তা ধ্বংসের প্ল্যান করতে হল। এমনও একটা কিছু যে আবার এই ধরনের অবস্থান তৈরি না হতে পারে। যদিও অবস্থানটি ছিল সরকারের আঁতাতের বিরুদ্ধে, তারপরও আওয়ামীরা অচিরেই বুঝে গেল, এই আন্দোলন পকেটে ঢোকান সম্ভব। আর এই সোজা কাজটা ছাত্রলীগ করে দিল। প্রথমে মঞ্চ ক্যাপচার, এরপরে সাধারণ জনতার মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অবশেষে, হালুয়ারুটির ভাগাভাগি নিয়ে দ্বিখণ্ডিত করন। পুরো ঘটনার যে সারাংশ দাঁড়াল, ‘এই ধরনের আন্দোলন তৈরিই হয় বিক্রি হওয়ার জন্য’ আন্দোলনটির এমন একটি ছবি চিত্রায়িত হল। দুটো সুবিধা হল, রাজাকার প্রশ্নে, আওয়ামীরা তাঁদের নিজ ফর্মুলায় ফিরে যেতে পারল আর এটাও নিশ্চিত করতে পারল যেন এরপরে যুব সমাজ আর কখনই এই ধরনের কোন ডাকে সাড়া না দেয়।
সরকারের হাড়ে দ্বিতীয় কাঁপনটি জাগিয়েছিল, হেফাজত। ফর্মুলা একই। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান। বেশিদিন চালাতে পারলে, সরকারের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা শুরু হয়ে যেত। এদের সামলানোর জন্য একই ফর্মুলা চলবে না, সেটা আওয়ামীরা বুঝেছিল। ধর্ম ব্যাপারটার সঙ্গে আওয়ামীদের সখ্য খুব বেশি না। ফলে ছাত্রলীগ দিয়ে এই আন্দোলন কব্জা করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে মুল সুবিধা ছিল অন্য জায়গায়। এই আন্দোলনে আসা জনতার অনভিজ্ঞতা। তাঁদের মনে হয়েছিল, জ্বালাও পোড়াও মানেই বিজয়। যে শিশুদের নিয়ে এই অবস্থান আন্দোলন তৈরি হয়েছিল তাঁদের সাহস ব্যাপারটাও ছিল একটি ইস্যু। আর সেই রাতের অতর্কিত আক্রমণও ছিল অপ্রত্যাশিত, বা হয়তো তাঁদের নেতাদের কাছে প্রত্যাশিত এবং প্রকাশিত। যাই হোক অপারেশান সাকসেসফুল।
এই দুই ঘটনার পর থেকে, সরকারের অবচেতনে একটি ব্যাপারই তাড়া করছিল, আর তা ছিল অবস্থান আন্দোলন। ঢাকার প্রবেশ মুখে একবার যদি বিরোধী দল অবস্থান শুরু করতে পারে, তবে কাহিনী পাল্টাতে সময় লাগবে না। আর সেই অবস্থানে যদি ম্যাডাম স্বয়ং থাকেন, তবে তো পরিণতি আরও ভয়ানক হয়ে যাবে। অন্তর্কলহ আর একরাশ মামলা দিয়ে যত সহজে বিএনপি নেতাদের কাবু করা গেছে, একবার অবস্থান আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে, তাঁরাও পকেট থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে। বিএনপি নেত্রীকে মামলা দিয়ে থামানো যাবে না, জানতো। ফলে নতুন কোন প্ল্যানিং জরুরী ছিল। তবে গনতান্ত্রিকভাবে তা করা সম্ভব না, এটাও জানত। রাস্তা একটাই ছিল, তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দেয়া। কিংবা একাকী করে দেয়া।
সত্যিকারের নির্বাচন হলে যে হারবে, আওয়ামীরা সেটা জানতো। আবার এও জানতো, আন্দোলন করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী তাঁরা মানাতে পারবে না। হোলও তাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জবাই করবার পর থেকে বিএনপি কোন আন্দোলনই দানা বাঁধাতে পারেনি। হরতাল আর অবরোধ, সেই অর্থে আর রাজনৈতিক হাতিয়ার নেই। আর দুইএকদিনের এমন কর্মসূচীতে আজকাল আর সরকার কর্ণপাতও করেনা। আর তাই গতবছরের ৫ই জানুয়ারির পর থেকে সরকার বেশ আরামেই ছিল। আওয়ামীদের জন্য ভয়ের সময় বলতে এই শীতকাল। এটা পার হলেই, পরিস্থিতি আবার নিয়ন্ত্রণে। আর বিএনপির জন্যও আশার সময় এই শীতকাল। যা করার এই সময়েই করতে হবে। মামলা আর অন্তুর্কলহের কারণে বিএনপি এখন পর্যুদস্ত। টিমটিম করে আশার যে বাতিটি জ্বলছে, তা জ্বালিয়ে রেখেছেন বিএনপি নেত্রী।
আওয়ামীরা ঠিক করল, নেত্রীর ওপরও আঘাত হানবে। মামলার দিন পড়তে লাগল। মামলায় কাজ হবে না, আওয়ামীরা জানে। তবে কিসে কাজ হবে, সেটা জানে না। এদিকে হরতালও যে কাজে দেবে না, সেকথা বিএনপিও জানে। কিসে কাজ হবে, সেব্যাপারেও তাঁরা বেশ অনিশ্চিত। সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে, আওয়ামী সরকারের হাড়ে কাঁপন ধরাতে পেরেছিল কেবল অবস্থান আন্দোলন। আর সেটা যদি হয়, ঢাকার প্রবেশ মুখে। আওয়ামীদের ভেতর সেই জুজুর ভয় ছিলই। তাই সম্ভবতঃ তাঁরা ঠিক করে রেখেছিল, ঢাকার প্রবেশ মুখে সমাবেশের কোন সুযোগ দেয়া হবে না। প্রয়োজনে ‘নেড়িকুত্তা’ ইফেক্ট দিতেও তাঁরা রাজী ছিল। নেত্রীকে ঢাকার বাইরে সমাবেশ করতে দিলেও, ঢাকার প্রবেশ মুখের আশে পাশে করতে দেয়ার ঝুঁকি নিতে রাজী ছিল না আওয়ামীরা। সেই ফর্মুলার প্রথম প্রকাশ দেখা গেল গাজীপুরে।
সমাবেশের পরবর্তী প্ল্যান বিএনপি করেছিল ৫ই জানুয়ারী। সেটা আটকাবার ফর্মুলা হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করল, ‘মার্চ ফর ডেমক্রেসি’র পুরনো ফর্মুলা। ম্যাডামকে অন্তরীন রাখা। আর সেটা করবার জন্য সেই বালুর বস্তা। হয়তো প্রত্যাশা ছিল, আবার রেগে গিয়ে ‘গোপালি’ বলবেন। টুই তোকারি করবেন। তবে এবার তিনি শান্ত ছিলেন। তবে বরাবরের মত সমালোচনা হল, বিএনপির অন্য নেতাদের মেরুদণ্ডহীনতার। মামলার ভোয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার। প্রথম দিকে সরকারকে বিজয়ী মনে হলেও, পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করেছে মনে হচ্ছে।
আসলে ৫ই জানুয়ারী নিয়ে আওয়ামীদের প্ল্যানিং বেশ অগোছাল মনে হয়েছে। বালি, খোয়ার ট্রাকের মত হাস্যকর ফর্মুলা, ইচ্ছে করে নেয়া, না ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ আটকাবার ফর্মুলার রিপিট টেলিকাস্ট, বোঝা যাচ্ছে না। কারণ যেটাই হোক, আগেরবার ফর্মুলাটা কাজে দিয়েছিল। তবে এবার কাজটা যেভাবে বিদেশী মিডিয়ায় এসেছে, আর তালার যে দৃষ্টিকটু ব্যবহার হয়েছে, তা সরকারের জন্য খুব সুখকর হয়নি। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা বেশ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছে তালা খুলে দিতে, না পারছে তালা লাগিয়ে রাখতে। তারচেয়েও বড় সমস্যা, খুব যুক্তিযুক্ত কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারছে না এই ‘তালা’র। সবার সামনে স্বীকার করতে পারছে না, ম্যাডামকে ছাড়লে, আর তিনি একটি সমাবেশকে অবস্থান আন্দোলনে পরিণত করতে পারলে, আমাদের গদি নড়ে উঠবে। গণজাগরণ আর হেফাজতের পরে সম্ভবতঃ প্রথমবারের মত আবার আওয়ামীদের হাড়ে কাঁপন লেগেছে। দেখা যাক এবার কি হয়।