হচ্ছি হচ্ছি করেও বিএনপির কিছু হচ্ছে না। আন্দোলনকে অংকুরে বিনাশের যে স্ট্র্যাটেজি আওয়ামীরা নিয়েছে, তাতে ভালোই কাজ দিচ্ছে। সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব আওয়ামীদের দেয়া ঠিক হবে না। কিছুটা কৃতিত্ব অবশ্য বিএনপিরও। নিজেদের অন্তর্কলহ থেকে শুরু করে নেতৃত্বের থাকা দুই জেনারেশানের একে অপরকে অবিশ্বাস, আওয়ামীদের কাজ আরও সহজ করে দিয়েছে। যেমনটা সাধারণতঃ হয়, অতি আত্মবিশ্বাস পতন ডেকে আনে, তেমনটা সম্ভবতঃ হতে যাচ্ছে, আওয়ামীদের। তাঁরা ভেবে বসে আছে, বিএনপি মাঠে নেই এই তথ্য যত প্রচারিত হবে, বিএনপির জন্য তা ততো ক্ষতিকর হবে। তবে ঘটনা সম্ভবতঃ তেমনটা ঘটছে না।
সহানুভূতি ব্যাপারটা বোধহয় কিছু নিয়ম মেনে চলে। তার একটা হচ্ছে অত্যাচারিতের দিকে ধাবিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা কাজ করছে, তা হচ্ছে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে যে তথ্য জনগণ পাচ্ছে, তা এমন একটি ছবি প্রকাশ করছে যে বিএনপি ভয়ানক অত্যাচারের শিকার। তাঁদের নেত্রী একটি সমাবেশ করতে চাইছে, তাঁকে সেটা করতে দেয়া হচ্ছে না। অফিস থেকে বেরোতে চাইছে, তাও দেয়া হচ্ছে না। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে বালু আর খোয়ার ট্রাক এর আগমন সবকিছু মিলিয়ে সহানুভূতি এই মুহূর্তে পুরো মাত্রায় চলে যাচ্ছে বিএনপির ঝুলিতে।
আওয়ামীদের বদান্যতায় কিংবা নির্বুদ্ধিতায় পাওয়া এই সুবিধাগুলো পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না বিএনপি। প্রথম সারির নেতারা বেশ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, গ্রেফতার হতে তাঁরা রাজী না। হুমকি ধামকি দিতে বলেন, আমি আছি কিন্তু রাস্তায় মিছিল বের করতে পারব না। কোন সমাবেশে ভাষণ দিতে পারবো না। হরতালের দিনে রাস্তায় থাকতে পারবো না। তাই বলে আমাকে বা আমার চামচাদের কোন কমিটিতে রাখবেন না, তাও করতে দেব না। নতুন কোন নেতাদের আমদানী করবেন, সেটাও বরদাশত করব না। ফলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিএনপির রাজনীতি পুরোপুরি নেত্রী নির্ভর হয়ে বসে আছে।
প্রথম সারির নেতাদের এই স্বার্থপরতা দৃষ্টিকটু দেখালেও, তাঁদের এই অবস্থানের একটি নিজস্ব যুক্তি তাঁদের কাছে আছে। তাঁরা বেশ ভালো করেই জানেন, বিএনপি এই আন্দোলনে জিতলে, তাঁদের পায়ের তলায় আর কোন মাটি থাকবে না। বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণ মানেই লন্ডন প্রবাসী নেতার প্রত্যাবর্তন। আর তিনি ফিরে দলের দ্বায়িত্ব নিলেই যাত্রা শুরু হবে তার নতুন ‘টীমে’র। আর সেই টীমে, পুরনোদের জায়গা হবে না। উপদেষ্টা জাতের কিছু আলংকরিক পদ দেয়া হতে পারে, তবে কর্তৃত্ব বলে কিছু থাকবে না। তাঁদের চোখের সামনেই তাঁদের এলাকায় নতুন আরেকজন নেতার উদয় হবে। দেখতে দেখতে তাঁদের চোখের সামনেই তাঁদের রাজনৈতিক মৃত্যু হবে। ফলে পুরনো নেতাদের এক বিশাল অংশ চাইছেন না, সেকেন্ড ইন কমান্ড দেশে ফিরুক।
এই মুহূর্তে বিএনপি দ্বিতীয় যে সমস্যায় আছে তা হচ্ছে, বিশ্ব ইজতেমা। সেকারণে অবরোধে ছাড় না দিলেও সমস্যা আবার দিলেও সমস্যা। ছাড় না দিলে, বিশাল এক জনতা অভিমান করবে। ভাববে, আমাদের কষ্টের কথা একবারও ভাবল না? আর অবরোধের কারণে যদি তাঁরা যোগ দিতে না পারে, তবে সেই অভিমান নতুন মাত্রা পাবে। দেশের অবস্থা ভেবে অনেকে মেনে নিলেও, সংখ্যায় তাঁরা হবেন বেশ কম। ওদিকে অবরোধে একবার ছাড় দিলে, আন্দোলনে আবার গতি আনা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। হয়তো অসম্ভবও। আর তেমনটা হলে, এই বছরের মত আন্দোলনের ইতি। এরপরের বছর আবার কিছু করবার চেষ্টা করলে, এই বছরের ব্যর্থতা তাঁদের পিছু ছাড়বে না।
এতোসব সমস্যার মধ্যে যুক্ত হয়েছে বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবী আর তার্কিকের আকাল। তাঁদের পক্ষ হয়ে লেখার জন্য নেই তেমন কোন কলামিস্ট, টক শো তে গিয়ে তাঁদের হয়ে ঝগড়া করবার জন্য নেই তেমন কোন তার্কিক। সঙ্গে যোগ হয়েছে, বিএনপি পন্থী চ্যানেল আর পত্রিকার অভাব। যাও দুএকটা ছিল, আপাততঃ বন্ধ আর নয়তো কেউই সেসব দেখে না বা পড়ে না। ফলে মিডিয়া ফ্রন্টে তাঁরা তাঁদের কথা, বলতেও পারছে না। আর যাদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাঁদের পারফর্মেন্স বেজায় ভয়ংকর। সঙ্গে যোগ হয়েছে তারেক রহমানের বাণী। দলের কার্যক্রমকে যদিওবা কোন ভাবে ‘ডিফেন্ড’ করছে, ‘রাজাকার’ ইস্যু একেবারেই তাঁদের নাকাল করে ছেড়েছে। পুরনো নেতারা এখন আত্মগোপনে, নতুন নেতারা এখনও ভালো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেননি।
এমন একটা ফাঁকা মাঠ আওয়ামীদের জন্য মজার এক সমস্যা তৈরি করে দিয়েছে। নিশ্চিত জয় দেখতে পেয়ে তাঁরা এই মুহূর্তে খেলার বদলে উল্লাসের দিকেই মনোযোগী হয়ে উঠেছে বেশি। সারাক্ষণ শ্লেষাত্মক কথা, বিএনপি নেত্রীকে অপমান করা, বাকি নেতাদের ‘নেড়িকুত্তা’র মত পিটুনি দিতে চাওয়া, এসবের ভেতরে তাঁরা তাঁদের জয় দেখতে পাচ্ছেন। গায়ের জোরে পাওয়া বিজয়কেই তাঁরা রাজনৈতিক বিজয় ভাবছেন। ভুলে যাচ্ছেন, রাজনীতির খেলায় সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে জনগণের বিবেচনা। তাঁরা কি ভাবছে, সেই ব্যাপারটা মাথায় রাখা। আর বিরোধী দলের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হতে না দেয়া। ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে গিয়ে, তাঁরা বিরোধী দলকে অত্যাচারিত একটি দল হিসেবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে ফেলছে।
এতো কিছুর পরও হয়তো কিছু নাও হতে পারে। বিএনপির যে দৈন্য দশা, হয়তো তাঁরা আন্দোলনে বিফলও হতে পারে। বলা যায়, এদেশের সব আন্দোলনই বিফল। এক ৯৬ ছাড়া বাকী সব আন্দোলনই একটি কাজ করেছিল, আর তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই আন্দোলনগুলোর কোনটিই হয়তো সফল হত না, যদি না সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলে আগ্রহী হত। তবে ১/১১এর পরে নিজেদের যেভাবে তাঁদের গুটিয়ে নিতে হয়েছে তাতে এই মুহূর্তে তাঁরা তেমনটা আর করবেন বলে মনে হচ্ছে না।
ঘুরে ফিরে বিএনপির এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বন্ধু হচ্ছে আওয়ামীরা এবং তাঁদের অতি আত্মবিশ্বাস। বিএনপির দৈন্য দশা, বিএনপির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা তাঁদের ইনফর্মাররা, যেভাবে প্রতিনিয়ত বিএনপির আন্দোলনকে ‘স্যাবোটাজ’ করছে আর তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে অচিরেই তাঁরা বিএনপির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুতে পরিণত হতে যাচ্ছেন। আর শত্রু কিংবা বলা যায় ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন হচ্ছে, বিএনপি নিজে। এই নতুন শত্রুর সঙ্গে কিভাবে মোকাবেলা করবে, কিভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেবে, সেটাই এখন দেখার ব্যাপার।