আমার মৃত্যুটাকে ঠিক আচমকা মৃত্যু বা ‘সাডেন ডেথ’ বলা যায় না। দীর্ঘ রোগ ভোগের পরের মৃত্যু বলাটাও ঠিক হবে না। খুন বলা যেতে পারে, তবে মৃত্যুটা হয়েছিল আমার ওপর আসা উপর্যুপরি আঘাতের বেশ অনেক বছর পরে। ছোট খাট ঝড় ঝাপটা গেলেও আমি মোটামুটি বহাল তবিয়তেই টিকে ছিলাম। তিন তিনটে নির্বাচনও করলাম। বিরোধী পরাজিত দল ছাড়া বাকী সবাই বলল নির্বাচন ভালোই হয়েছে। বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও ঘুরে দেখে বলেছিলেন, নির্বাচন ভালোই হয়েছে। রিপোর্ট কার্ডে একশোতে একশো না দিলেও কমবেশি সবাই নব্বইয়ের ওপরেই নম্বর দিয়েছিলেন। এরপরও আমার শেষরক্ষা হল না। বলা যায়, সেটাই আমার কাল হল।
আমার ওপর প্রথম বেশ বড়সড় আঘাত এসেছিল বিএনপি আমলে। মানে বিএনপির দ্বিতীয় আমলে। সেবার মউদুদ সাহেব সংবিধানে একটি সংশোধন করেন। সেই সংশোধনের ফলাফল যা দাঁড়াল, তাতে দেখা গেল একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি, যিনি একসময় বিএনপির সদস্য ছিলেন, তিনি হয়ে যাচ্ছেন আমার প্রধান। ঠিক তাঁকে প্রধান করার জন্যই এই পরিবর্তন, না সত্যিই বিচারক সংকটের জন্য এই পরিবর্তন, তা হলফ করে কারো পক্ষে বলা সম্ভব না। আর এদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে একটি দলের দেয়া ব্যাখ্যা আরেকজন মেনে নেবে, প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। প্রায় বললাম, কারণ নিজেদের বেতন বৃদ্ধি আর শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির জন্য কেবল এরা একমত হয়।
যাই হোক, সেই সংশোধনীর পরে আওয়ামীরা ভাবল, সেই হাসান সাহেবকে প্রধান করার জন্য এই কাজ করেছে বিএনপি। তাই তাঁরা আন্দোলনে নামলো। প্রচুর হরতাল দিল। জ্বালাও পোড়াও ও কম করল না। তারপরও তেমন কিছু করতে পারল না। বহু জল ঘোলা করে অবশেষে আমার প্রধান হিসেবে আসলেন রাষ্ট্রপতি। কাজটা ঠিক হল কি না তা নিয়ে বেশ বিতর্ক হলেও আওয়ামীরা মেনে নিল। ঠিক সেই সময়টায় সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকবার কারণে হয়তো আওয়ামীরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে সাহস করেনি। এরপরে বেশ যাচ্ছেতাই ভাবে আমাকে ব্যবহার করতে লাগলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব। আমার বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাও পদত্যাগ করলেন।
এর কিছুদিন পরে আসলো সেই যুগ সন্ধিক্ষণ। অনেকের মতে আমার মৃত্যুর সেটাও একটি কারণ। ১১ই জানুয়ারী, আমার পরিচালনায় হতে যাওয়া চতুর্থ নির্বাচনটির মাত্র কিছুদিন আগেই আমার প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলেন বা করানো হল। নতুন প্রধান হিসেবে আসলেন, ফখরুদ্দিন সাহেব। নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ হল। তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করার বাধ্য বাধকতা থাকলেও, আইনের কিছু ফাঁক গলে, নির্বাচন অনুষ্ঠান পেছানো হল। এই ফাঁকে বেশ সাহসী কিছু পদক্ষেপও নেয়া হল। দুই দলের তাবৎ বড় বড় নেতাকে আটক করা হল। কারো মতে, ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার মাধ্যমে দেশের দুই বড় দলের যবনিকা পতনের চেষ্টা হল।
এরপরে অনেক ঘটনা ঘটল। দুই বড় দলের বেশ কিছু নেতা বিদ্রোহ করল। শীর্ষ পদ দখলের জন্য, কিংবা দল দুটিকে ধ্বংস করার জন্য, বেশ অনেকেই একত্রিত হল। তবে সফল হল না। আমার শীর্ষ পদে থাকা মানুষগুলো ঠিক কি চেয়েছিল, জানি না। তবে প্রথম প্রথম তাঁরা যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কিংবা দুই বড় নেত্রীকে গ্রেফতারের পরেও যে মৌন সম্মতি তাঁরা পেয়েছিল, তা ধরে রাখতে পারল না। বাগাড়ম্বর আর দুরাভিসন্ধি তাঁদের কাল হয়ে দাঁড়াল। ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করে ক্ষমতায় আরোহণের চেষ্টা শুরু করেছে কি না তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিল। ফলাফল যা হল, দুই দলের সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও ক্ষেপিয়ে তুলল আমার বিরুদ্ধে।
সেই দুই বছর পার করে অবশেষে আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করলাম। আগের তিনবারের মত এবারও বেশ স্বচ্ছ নির্বাচন হল। পরাজিত দল ছাড়া বাকী সবাই এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিল। মনে হচ্ছিল এই যাত্রা হয়তো বা আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু তা হল না। আমার কারণে অন্য আরেকটি যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেই কারণ দেখিয়ে আমার মৃত্যু সনদ জারী করা হল। সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে জানাল, আমি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমার কারণে বিচারালয় ধ্বংস হতে বসেছে। আওয়ামীরা সুযোগটা লুফে নিল। দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁদের ছিলই। রায়ের বাহানায়, আমার মৃত্যু নিশ্চিত করতে সংবিধানে সংশোধনী আনা হল। অনেকটা আমার আদল রাখলেও, শীর্ষ পদে, নির্বাচন কালীন সময়ে, দল নিরপেক্ষ ব্যক্তির পরিবর্তে একজন দলীয় লোক রাখবার ব্যবস্থা করা হল।
আমার মৃত্যু যদিও অবস্বম্ভাবী ছিল, তারপরও এতো দ্রুত হবে, সেটা অনেকেই ভাবেনি। দুই দল যে কেবল চর দখলের জন্যই নির্বাচন করে, এই তথ্য জনগণ বুঝে গেলেও, মেনে নিয়েছিল। একের পর এক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে হওয়া কারচুপি আর তারপরে হওয়া সহিংস কিংবা অহিংস রাজনীতি দেখতে দেখতে ক্ষুব্ধ দেশবাসী আমাকে পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ভেবেছিল, দুই দল তাঁদের জন্য কিছু করুক আর না করুক, নির্বাচন এবং নির্বাচন নিয়ে হওয়া সহিংসতা থেকে তো অন্ততঃ রেহাই পেলাম। তাঁদের কপালে সেই সুখ সইল না।
যদিও আমার মৃত্যুর দিন ক্ষণ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ ভাবেন চতুর্দশের পরেই মৃত্যু হয়েছে, কেউ বলেন ১/১১র কারণে, আবার কারো মতে পঞ্চদশের কারণে। আসলে আমার মৃত্যুর বীজ লুকিয়ে আছে, আমার অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলোর ফলাফলে। সেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে তেমন কোন প্রশ্ন না থাকলেও যে সমস্যাটা দেখা দিল তা হচ্ছে প্রত্যেকবারই তৎকালীন বিরোধী দল জয়লাভ করল। এমন একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেল, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন মানেই, নিশ্চিত বিরোধী দলের বিজয়। বিরোধী দলের সুনিশ্চিত বিজয়, সেই নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা আর সর্বোপরি সুষ্ঠু নির্বাচন করার এই সক্ষমতাটিই হয়ে দাঁড়াল আমার মৃত্যুর মৃত্যুর কারণ। ‘আপনা মাংসে হরিণ বৈরী’।
৯৬এ আমার অধীনে হওয়া দ্বিতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পরই সম্ভবতঃ বিএনপি ঠিক করেছিল, আমার ওপর ‘সার্জারি’ করার। ২০০১এ ক্ষমতা পাওয়ার পরেই, খুব ভালমতোই জানতো, ২০০৭এ আমার অধীনে নির্বাচন হলে, সেখানে তাঁদের শিকে ছিঁড়বে না, আবার আওয়ামীরা আসবে। আর সেই পরিস্থিতি আটকাবার জন্য, আইনগত ভাবে তাঁদের করণীয় তেমন কিছু ছিল না। আমাকে বাতিল করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ৯৬এ তেমন কাজ করতে যেয়ে তাঁরা বেশ ভুগেছে।
বিচারবিভাগে দলীয়করণ শুরু করলেও তার সুফল পেতে এখনও ঢের দেরী। সেই মুহূর্তে তাঁদের মাথাব্যাথা ছিল ২০০৭। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে। স্বাভাবিকভাবে চললে নিজেদের পছন্দের লোক আমার প্রধান হতে পারবে না। তাই আপাততঃ যে ফর্মুলার আমদানি করল তা ছিল বিচারকের বয়স বৃদ্ধি। ২০০১এ দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়াতে, সুযোগটাও তাঁরা পেয়ে গেল। গলা টিপে না মারলে, বেশ মারাত্মক আঘাত আসল আমার ওপর। তবে বিএনপির শেষরক্ষা হল না। ১/১১ আসল।
১/১১এর পরে মনে হয়েছিল আমার ওপর থেকে দুর্যোগের মেঘ সরে গেছে। আমার ওপর ‘সার্জারি’ করতে গিয়ে বিএনপি যেভাবে ভুগল, তাতে মনে হয় না আমাকে আর কাঁটা ছেঁড়ার সাহস কেউ দেখাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। ১/১১এর সময় আমার দ্বায়িত্বে থাকা মানুষগুলো যেভাবে দুই নেত্রীকে শ্রীঘরের হাওয়া খাওয়ালো, তারপর আমাকে শৃঙ্খলিত কিংবা নখদন্তহীন করার একটা চেষ্টা যে হবে, বোঝাই যাচ্ছিল। তবে একেবারে মেরে ফেলা হবে, কেউই হয়তো বোঝেনি। যাই হোক, সেই সময়ের শাসনকাল কিংবা বিরোধী দলের বিজয়ের গ্যারান্টি, যেকারনেই হোক, আমাকে আমার পরিণাম ভোগ করতেই হল।
আমার মৃত্যু নিয়ে আমার তেমন কোন নালিশ নেই। আমাকে ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচন হচ্ছে, এবং বেশ ভালভাবেই হচ্ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এদেশেও আমাকে ছাড়া নির্বাচন হবে। তবে সেজন্য জরুরী রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বিরোধী দলের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আচরণ। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের লোক বসানোর মানসিকতার পরিবর্তন। সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে, পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিকতা।
যে কাজগুলো করে আমি সুষ্ঠু নির্বাচন করতাম তার বেশির ভাগ কাজই নির্বাচন কমিশনকে দিয়েই করানো যায়। সেখানে প্রধান হিসেবে কে নিয়োগ পাবে, তার যদি একটি সুষ্ঠু উপায় বের করা যায়, সরকার, বিরোধী দল সহ আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি একটি প্যানেলের মাধ্যমে এর প্রধান নির্বাচন করা যায়, নির্বাচনকালীন সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাঁদের অধীনে রাখা যায়, প্রশাসনের রদবদলের কিছু ক্ষমতা তাঁদের হাতে রাখা যায়, তবে হয়তো আমাকে আর প্রয়োজনই পড়বে না।
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না, তেমন কিছু হবে। আওয়ামীরা যেভাবে আমার অবসান চাইছে, নিতান্ত বাধ্য না হলে, মনে হয় না আমাকে আর জীবিত করবে। বিএনপির যা অবস্থা, আমাকে বাঁচাবার আন্দোলন করবার তেমন কোন ক্ষমতাও ওদের নেই। সুশীল সমাজের উচ্চবাচ্য নিয়েও অনেকে সন্দেহ করছে। ভাবছে, আমার মাধ্যমে কিছুদিনের জন্য ক্ষমতা পাওয়ার লোভে তাঁরা এসব চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ফলে, স্বাভাবিকভাবে আমার জীবিত হওয়ার তেমন কোন পথ নেই। জানিনা আমার কি হবে। পুনরায় জীবন ফিরে পাব, না আমার চিরস্থায়ী মৃত্যু হয়েছে, সময়ই বলে দেবে। আমাকে নিয়ে আরও কিছু আন্দোলন, আরও কিছু মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে, আওয়ামীদের নতুন ফর্মুলায় সবাই সায় দেবে, তার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী। এই শীতকালের মধ্যে কিছু একটা না ঘটলে, মনে হচ্ছে, ২০১৯এর আগে আমার ব্যাপারে নতুন কোন সিদ্ধান্ত হবে না। কি আছে আমার ভাগ্যে তা দেখার জন্য, আপনাদের মত আমিও অপেক্ষায় আছি।