এদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলে আসছে, তাতে বেশ কিছু অলিখিত নিয়ম আছে। এখানে নেতা কর্মীদের নীতিনির্ধারণী কোন বক্তব্য দেয়ার তেমন কোন সুযোগ নেই। উপদেশ, অনুরোধ সেসবও না। কাজ একটাই, হুজুর হুজুর করা। মূল বক্তব্য আসবে শীর্ষ নেতা বা নেত্রীর কাছ থেকে। এরপরে শুরু হবে বাকিদের কাজ। জীবন বাজী রেখে তাঁদের নেমে পড়তে হবে সেসব বক্তব্যকে ‘জায়েজ’ প্রমাণ করতে। ইতিহাস ঘেঁটে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রমাণ করতে হবে, ‘এই কথাটি বলে নেতা অথবা নেত্রী সঠিক কাজটিই করেছেন।’ চাটুকারিতায় আর এক ধাপ এগিয়ে যদি যোগ করতে পারেন যে ‘এর চেয়ে অমোঘ সত্য আর কিছু হতে পারে না’ ‘কিংবা ‘এমন সত্য কথা বলার সাহস এর আগে কেউ কোনদিন দেখাননি’ তবে তাঁর অবস্থান শীর্ষ নেতা বা নেত্রীর চোখে আরও একধাপ উঁচু হয়ে যাবে। সবচেয়ে বেশি আশীর্বাদ পাবেন যদি বিরোধী নেতা বা নেত্রীকে কিঞ্চিৎ গালমন্দ করতে পারেন।
যেহেতু আমাদের দেশের নেতা নেত্রীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা বেশ সীমিত তাই ঘুরে ফিরে সেই হুমকি, ‘সাবধান করে দিচ্ছি’ ‘ভালো হবে না’ কিংবা ‘দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিব’। মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় জনগণের কথা। তখন ভাষায় কিছু অদল বদল হয়। ‘জনগণ আপনাদেরকে ক্ষমা করবে না’ কিংবা ‘জনগণ এবার উচিৎ শিক্ষা দিবে’। এভাবেই চলে আসছিল বছরের পড় বছর। কথাগুলো একবার আওয়ামী নেত্রী বলতেন একবার জাতীয়তাবাদী নেত্রী বলতেন। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এসব উপদেশ কিংবা সাবধান বাণী, তাঁরা যে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করতেন না, তবে আমরা, জনগণ করতাম। বেশ মজা নিয়েই দেখতাম, ‘কত বড় হুমকি দিতে পারে।’
নেতা নেত্রীরা সম্ভবতঃ ব্যাপারটা জানেন। অন্যপক্ষ এসব কোথা শুনুক আর না শুনুক, জনগণ শুনছে। ‘ফ্রুটিকা’ খাইয়ে যদি কোন নেত্রীর মুখ থেকে সত্যি কথাটা বের করা যেত তবে জানা যেত, এই কথাগুলো আসলে আমাদের, অর্থাৎ সাধারণ জনতার জন্য। ‘দেখো আমার কত সাহস, প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দিচ্ছি’। উল্টোটায় যদিও এই সাহসিকতা প্রমাণ হয় না, তবে বোঝানো হয়, সরকারী পেটোয়া বাহিনী, আমাদের অধীনেই আছে। তাঁরা আমাদের কথাই শুনবে। তবে সেকথা অন্যভাবে বলে কারণ, সরকারী দলের পক্ষে বলা সম্ভব হয় না, ‘দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেব’। কারণ তেমন জবাব দিলে ব্যাপারটা ‘ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মত শোনাবে’। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাল্টা হুমকি আসে না। আসে পরিণাম নির্দেশিকা। ‘সরকার বসে থাকবে না’ জাতীয় সাবধান বাণী।
কমবেশি এভাবেই চলে আসছিল। হুমকি ধামকি দিয়ে পাঁচ বছর পার করছিল বিরোধী দল। এরপরে ক্ষমতায় আসছিল। আর ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধী দল হওয়া এই দলটি প্রাক্তন বিরোধী দলের এতদিনের শোনানো রেকর্ড বাজানো শুরু করতো। ব্যাপারটায় জনগণ এতোটাই অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল যে, আজকাল পত্রপত্রিকাও এসব হুমকি ধামকির খবর পড়ার চেয়ে বরং ‘রুবেল হ্যাপি’র প্রেম কাহিনীতে অনেকে নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছিল।
সেই ফর্মুলায় নতুন সংযোজন হিসেবে আসলো গালি গালাজ। কে প্রথমে শুরু করেছে, তা নিয়ে রিসার্চ করা যেতে পারে। তবে সেই গবেষণাকারী যদি দল বা লীগ, কারো সমর্থকই না হন, তবে ‘ডিম আগে না মুরগী আগে’ সেই প্রশ্নের মতোই ব্যাপারটা অমীমাংসিত থেকে যাবে। আরও একটা কারণ আছে। তিনি কোন এক দলকে দায়ী করলে কপালে জুটে যাবে তকমা। অমুক দলের দালাল’। একজন নিরপেক্ষ থাকতে চাওয়া মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর এক গালি।
আমাদের একঘেয়েমি দুর করতে রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবতঃ নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন। অতি সম্প্রতি রাজনৈতিক খবরের বাজার মাতাতে তাঁরা বাজারে ছাড়ছেন ‘কটূক্তি’। এবং সেখানে বিনোদন অব্যাহত রাখতে চলছে, ‘ইটের বদলে পাথর’ ফর্মুলা। প্রথম ইট কে মেরেছে, তাঁর উত্তর যে পাবেন না তা তো বললামই। তারপরও যদি চেষ্টা করেন তবে জাতীয়তাবাদীদের কাছে উত্তর পাবেন, ‘ইট’ এর শুরু ওদিক থেকে যখন ‘জিয়াকে আই এস আই এর এজেন্ট বলা হয়’। আর লীগের বক্তব্য ‘কিন্তু সেই কথাটা কখন বলা হয়েছিল? যখন...’ এভাবেই চলছে। কেউ নাহি কম যায় সমানে সমান। আমরা জনগণরাও অধীর আগ্রহে থাকি, কালকে কি বলবে। তার উত্তরে কি বলা হবে। গালাগালিতে কে জিতবে।
বিএনপির সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বেশ অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত হাজির করছিলেন। বিভিন্ন ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আওয়ামী মনোপলি ভাঙবার চেষ্টা করছিলেন। বেশ কিছু বই তাঁর কাজেও লাগল। তিনি আপ্রাণ দুটো প্রশ্ন জাগানোর চেষ্টা করছেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী নেতাদের ভূমিকা’। আর সামনে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছেন, সেনাবাহিনীর ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ আসলে করেছিল সেনাবাহিনী আর সঙ্গে ছিল মুক্তিবাহিনী, কোন আওয়ামী নেতা না। আর আগে থেকেই বিতর্কিত কিছু বিষয় যেমন, ‘বাকশাল’ কিংবা ‘তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মনমালিন্য’, এসব ছোটখাট ব্যাপারগুলোতেও মাঝে মাঝে খোঁচাখুঁচি করছেন।
খুব নতুন কিছু না হলেও শুনে সময়টা পার হচ্ছিল ভালোই। ‘টক শো’তে ঝগড়ার একটা টপিক হয়েছিল। নেতাকর্মীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বুদ্ধিজীবীরাও নিজ নিজ দলের হয়ে ঝগড়া চালাচ্ছিলেন। বিনোদন খুব উচ্চস্তরীয় না হলেও ভালোই লাগছিল। গালিগালাজ একটা পর্যায়ে থেমে ছিল। ওপর মহল থেকে নির্দেশনা না আসায়, তাঁরা নিজেরাও খুব আগ্রাসী হচ্ছিলেন না। নিজস্ব নেতা নেত্রীর বন্দনাতেই সময় কাটছিল। সেই একঘেয়েমি কাটাতে, এমন সময় আসলো নতুন সংযোজন, ‘বঙ্গবন্ধু কি তবে রাজাকার ছিলেন?’ ব্যাস আর যায় কোথায়? মুহূর্তে পাল্টে গেল পরিস্থিতি। গালি গালাজের নতুন মাত্রা যোগ হল। বিএনপির এই সেকেন্ড ইন কম্যান্ডকে পাতি নেতারা ‘পাগল’ ‘অর্বাচীন’ ‘বেয়াদব’ এসব আগেই বলেছিলেন। বুঝে উঠতে পারছিলেন না আরও আগ্রাসী কিছু বলবেন কি না।
তাঁদের এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন নেত্রী স্বয়ং। বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখালেন। তিনি যে ভয়ানক ক্ষিপ্ত তা বোঝাতে আসলো ‘কুপুত্র’ ‘জানোয়ার’। এর সঙ্গে আসলো ‘জিহবা সামলানোর উপদেশ বা অনুরোধ। মতান্তরে হুমকি। ইতিমধ্যে কেস হয়ে গেছে। পাতি নেতারাও কোমর বেধে লেগে পড়েছেন। কে কত জাতের গালি আমদানি করতে পারেন। গালিগুলো ‘চ’ বর্গীয় হবে কি না এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটি ব্যাপার প্রমাণ হয়ে গেছে, বিএনপির সেকেন্ড ইন কম্যান্ড, আওয়ামী নেত্রীর সহ্য ক্ষমতা পার করতে পেরেছেন।
উত্তর আসতেও দেরী হল না। লন্ডন থেকে উত্তর এখনো আসেনি। এসেছে এদেশ থেকেই। ‘ছাত্রলীগ’ এবং ‘আওয়ামী নেত্রীর জিহবা’ সামলানোর উপদেশ। যথারীতি কেউই এই জিহবা সামলানোর উপদেশ মানছেন না। জনগণ হয়তো চাইছেও না, এমনটা ঘটুক। প্রতিটি গালির পরেই উৎসুক হয়ে তাঁরা টিভি সেটের সামনে বসে, ‘দেখি কি উত্তর দেয়’। শুধু তাই না, ইদানীং, ‘জানোয়ার’ কিংবা ‘বেয়াদব’ শুনে অনেকেরই মন ভরছে না। প্রতীক্ষায় আছে, আরও আগ্রাসী কিছুর।
আমাদের নেতা নেত্রীরা সম্ভবতঃ ভাবেন, যত বাজে গালি, তত বড়ো জয়। ‘টক শো’তে আসা পাতি নেতা আর বুদ্ধিজীবীরা ভাবেন, যত গলার জোড়, ততো বড় বিজয়। আর আমাদের, জনগণের জন্য, যত ঝগড়া, ততো মজা। কিছু চ্যানেল তো আবার দেখলাম যোগ করেছে, ‘কে জিতল?’ জাতের ভোটিং সিস্টেম। বিশ্বাস করুন, আপনাদের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আমরা প্রত্যাশা করি না। শুধু একটাই প্রত্যাশা, আমাদের এই বিনোদন নষ্ট করবেন না। প্লিজ আপনাদের জিহবা সামলানোর কোন চেষ্টা করবেন না। তেমন কিছু হোলে, আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনের অন্যতম একটি বিনোদন আমরা হারাবো।