এই মুহূর্তের ‘মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন’ হচ্ছে ‘ঠিক আর কতদিন এই ঝগড়াঝাঁটি দেখতে হবে?’ খুব খারাপ লাগছে, তা না। তবে বেশ অনেকদিন হয়ে গেলে, খুব প্রিয় ‘সিরিয়াল’ও বিরক্তি তৈরি করে, এই কাঁদা ছোড়াছুড়ি এখন সেই পর্যায়ে চলে গেছে। টিভি খুললেই, কোন না কোন চ্যানেলে দেখা যাবে, কোন না কোন বুদ্ধিজীবী বা দলীয় কর্মী, বিপুল উৎসাহে তাঁদের শীর্ষ নেতা বা নেত্রীর হয়ে ঝগড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাস রোমন্থন, ইতিহাস শেখানো, ইতিহাস বিকৃতি এবং সারাংশ একটাই, ‘জনতা হচ্ছে বেকুব। এরা ইতিহাস জানে না। এদের ইতিহাস শিখাই।’
তবে একটা ব্যাপার ঠিক, আর তা হচ্ছে এই মিলিয়ন ডলার কোশ্চেনের উত্তরটা বোধহয় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কারোর নেতাকর্মীদেরই জানা নেই। জানা নেই, কারণ এদের নিজেদের কোন ‘ভয়েস’ নেই। এদের কারোরই সাহস নেই উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘দেশের সমস্যা নিয়ে বিতর্ক করুন’ শীর্ষ নেতাদেরকে এই কথা বলবার মুরোদ নেই, ‘ইতিহাস, ইতিহাসবিদের হাতে ছেড়ে দিন’। কারণ একটাই, নেতা যখন গালি দিচ্ছেন, আমার দ্বায়িত্ব তাঁর চেয়েও তিনগুণ জঘন্য গালি দেয়া।
এর একটি কারণ সম্ভবতঃ লুকিয়ে আছে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। এই সংস্কৃতি বলে, এখানে সবচেয়ে উপাদেয় ব্যাপার হচ্ছে ‘অপর পক্ষের ক্ষতি হওয়া’। কোন ঘটনায় যতক্ষণ অপর পক্ষের ক্ষতি হচ্ছে ততক্ষণ কোন ঘটনায়ই কেউ রাশ টানতে রাজী না। বিতর্কটি প্রয়োজনীয় কি না, এই মুহূর্তে দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরী কিছু কি না, তা নিয়ে ভাবা জরুরী না। জরুরী অন্য পক্ষের ক্ষতি হওয়া। জনগণের কাছে হেয় হওয়া।
সাম্প্রতিক ঘটনায় মজার একটি ব্যাপার আছে। প্রথমতঃ ঝগড়া শুরু হয়েছে, দুই দলেরই কহব স্পর্শ কাতর একটি ব্যক্তিত্ব নিয়ে। এবং দুই দলেরই ধারণা, জনগণ কিংবা তাঁদের অনুসারীরাও চাইছে, এই ঝগড়া চলুক। এবং এই ঝগড়ায় অপর পক্ষ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর বর্তমান ‘কাঁদা ছোড়াছুড়িতে’ অপর পক্ষের কতটা ক্ষতি হচ্ছে, দুই দলই সেটা নিরূপণ করছেন। ‘কার বেশি ক্ষতি হচ্ছে’ এই ব্যাপারটা নিরূপণ করে দুই দলেরই ধারণা ‘অপর পক্ষের ক্ষতি বেশি হচ্ছে’। আর তাই এই ঝগড়া চালিয়ে যেতে কেউই বিন্দুমাত্র আপত্তি করছেন না।
রেষারেষি আছে এমন দুই গ্রুপের মধ্যে এমন কামড়াকামড়ি নতুন না। এসব কামড়াকামড়িতে যে কারোই উপকার হয়না, এই ব্যাপারটা অনেকেই বুঝে গেছে। কেউ খুব দ্রুত বুঝেছে, কেউ দেরীতে। ভারতের মুম্বাইয়ের ‘আন্ডারয়ার্ল্ড’ বেশ বিখ্যাত। সেখানে মাফিয়া হয়ে বেশ অনেকেই নাম করেছেন। তাঁদের জীবনী নিয়ে বেশ অনেকগুলো সিনেমাও হয়েছে। ‘চাঁদাবাজি’ থেকে শুরু করে ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ কিংবা ‘স্মাগ্লিং’ করে বিখ্যাত হওয়া এসব সন্ত্রাসীবাহিনী একসময় পুরো এলাকা দখলের চেষ্টা করে। পরে বুঝেছিল, সেটা করতে গেলে, কেবল নিজেরা মারামারি করে শেষ হবে, এর বেশি কিছু হবে না। তাই নিজেদের মাঝে তৈরি হওয়া বিভিন্ন সমস্যা সামলাতে, তাঁরা নিজেদের মধ্যা বেশ কিছু অঘোষিত নিয়ম চালু করেছিল। এর একটি ছিল ‘এলাকা ভাগ’ আর অন্যটি ছিল, ‘পরিবারকে আঘাত না করা’।
এলাকা ভাগ ব্যাপারটা এদেশের কমবেশি সব রাজনৈতিক দলই চালু করেছেন। ‘আমাদের সময় সব টেন্ডার আমাদের’ এই অঘোষিত ফর্মুলা চলে আসছে এবং এটা দুদলই মেনে নিয়েছে। বিএনপি প্রত্যাশা করে না, আওয়ামী আমলে তাঁদের কপালে কোন টেন্ডার জুটবে, আর আওয়ামীরাও বিএনপি আমলে কোন টেন্ডার ফেলে না। ব্যাপারটা প্রশাসন থেকে শুরু করে সব সরকারী চাকুরীতেই চলে আসছে। কখনও অন্যদলের সঙ্গে দেখা করার জন্য কিংবা মঞ্চে ওঠার জন্য ‘বাধ্যতামূলক’ অপসারণ, অনেকটা অঘোষিত এবং সর্বজন মান্য একটি সমাধান হিসেবেই চলে আসছে। যে ব্যাপারটা চালু করতে পারেননি, তা হচ্ছে, ‘পরিবারবকে না টানবার’ ফর্মুলা।
ছোটবেলায় বন্ধুদের মধ্যে এক ধরনের ঝগড়া প্রায়ই হত। ‘আমার আব্বু বেশি পাওয়ারফুল’। যদিও বড় হয়ে এমন ঝগড়া করিনি, তবে এটাও বুঝিনি, সেই সময়ে এই ঝগড়া কেন করতাম। তবে এমন ঝগড়ার সাধারনতঃ কোন সমাধান আসতো না। নিজের ‘আব্বু’কে কমজোর মেনে নিতে কোন শিশুই কখনো রাজী হত না।’ ফলে যা হত, বা বলা যায়, যেখানে গিয়ে এই সমস্যা থামতো তা হচ্ছে, দুই শিশুর নিজেদের মধ্যের শক্তি প্রদর্শন।
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আবার সেই শৈশবে ফিরে গেছি। সেই সময়ে দুই অবোধ শিশু এই ঝগড়া করত, আর এখন দেশের সবচেয়ে বিদ্বান শ্রেণী এবং আমাদের বর্তমান এবং হবু শাসকরা এই কাজে মন দিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই ‘টক শো’ থেকে শুরু করে সাংবাদিক সম্মেলনে, এই একই ঝগড়ার ‘রিপিট টেলিকাস্ট’ চলছে। বেশ বিনোদন নিয়ে দেখছি কিভাবে এদেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে দুই দলই নেমে পড়েছেন নিজ নিজ দলের হয়ে যুদ্ধ করতে, আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রমাণ করতে যে ‘আমার আব্বু বেশি পাওয়ারফুল’।
এই সমস্যার কোন ‘শান্তি চুক্তি’ কি হবে? সম্ভাবনা বেজায় কম। শীর্ষ নেতারা যতদিন নিজেদের ‘পিতা’কে ভাজি করে খাওয়ার এই ‘ট্রেন্ড’ চালু রাখবেন, ততদিন এই সমস্যা থামবে না। যতদিন তাঁরা মনে করবেন, ‘পিতা’র ব্যবহারে ‘ভোটের’ যোগান হচ্ছে ততোদিন, মনে হয় না কোন দল, এই ‘পিতা’র ব্যবহার থামাবেন। কিন্তু এই ‘পিতা’র ব্যবহার যে কোন ভোট এনে দিচ্ছে না, এই সহজ কথাটা দুটো দলই বুঝতে রাজী হচ্ছে না।
নব্বইয়ের আগে এবং পরে, দেশকে নতুনভাবে দেখতে শেখা উচিৎ। নব্বইয়ের আগে, সেই অর্থে বর্তমান নেতৃত্বের ‘সরকার পরিচালনা’ সম্পর্কিত কোন কর্মকাণ্ড ছিল না। খালেদা জিয়াও সরকার চালাননি কিংবা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেননি। ফলে নিজেরা কিভাবে দেশ চালাবেন, কিংবা চালাতে পারবেন, তাঁর কোন উদাহরণ ছিল না। সেই যুক্তিতে তাঁদের পূর্বসূরিদের উদাহরণ দেয়ার একটি যৌক্তিকতা ছিল। কিন্তু এখন? দুজনই দুইদুইবার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন। সেই উদাহরণ দেয়ার অভ্যাস কবে তৈরি হবে?
এই কাঁদা ছোড়াছুড়ির শুরু যেখান থেকেই হয়ে থাক, মূল মন্ত্র তো একটাই, ‘পরিবার কিংবা নিজেদের দলের শ্রদ্ধেয় একজন মানুষকে আঘাত করা’ এবং এই কাজটা যে দুইপক্ষই করতে পারে কিংবা করার করার ক্ষমতা রাখে, তা নিয়ে তো সন্দেহ নেই। তবে কেন এই কাঁদা নিয়ে খেলা? আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়ারা ভয়ঙ্কর শক্তিধর হয়েও এই ‘পরিবারকে আক্রমণ না করার’ এই ফর্মুলা তো এমনি এমনি চালু করেনি। তাঁদের কাছ থেকে যখন এলাকা ভাগাভাগি শিখেছেন, এই ফর্মুলাটা শিখতে দেরী করছেন কেন? যতই বড় বড় ইতিহাস কপচান, আসল ঝগড়ার বিষয় তো ‘আমার আব্বু বেশি ভাল’!