কে বেশি বাজার মাতাচ্ছে? ভিজুয়্যাল না প্রিন্ট মিডিয়া? প্রশ্নটায় সম্ভবতঃ বেশির ভাগ লোক ভিজুয়্যালের দিকেই থাকবেন। টাটকা খবর, মিনিটে মিনিটে আপডেট। প্রতিদিন টেলিভিশানে যেভাবে নতুন নতুন প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে, যেভাবে নতুন নতুন উপায়ে ট্রান্সমিশান হচ্ছে, বলা যায় অদুর ভবিষ্যতে ভিজুয়্যাল মিডিয়া, খবর সংগ্রহের জন্য প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠবে। সত্যিই কি তাই? আমরা কি এই মিডিয়ার মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করছি? না কিছু ইভেন্ট দেখছি?
মূল ব্যাপারটা এখানেই। কোন ইভেন্ট ঘটলেই, ভিজুয়্যাল মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই ঘটনার ওপর। একবারও ভেবে দেখছে না, কেন তাঁকে আগে থেকে ডেকে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কেন ক্যামেরা পৌঁছানোর পরে, ‘বাসে আগুন লাগানো হচ্ছে’। আর একারণেই প্রিন্ট মিডিয়া টিকে থাকবে। ‘কেন?’ আর ‘ব্যাখ্যা’ এই দুটি ব্যাপারে এগিয়ে আছে প্রিন্ট মিডিয়া। এখন যদিও কমে এসেছে, তবে একসময়, বেশ অনেক সাংবাদিকই প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন, এই ‘কেন?’ খুঁজে। সবার মনে স্থায়ী আসন গেড়েছিলেন, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাখ্যা দিয়ে।
আমরা দর্শকরা বোধহয়, কেবল দেখতেই পছন্দ করি। ‘টুইন টাওয়ার’ ভেঙ্গে পড়ল, কিংবা ‘আইসিস’ জবাই করল। ‘আহা’ ‘উহু’ করে নিজেদের দ্বায়িত্ব শেষ করি। আর তাই এমন মানুষদের জন্য, যেকোন ঘটনা সম্পর্কে কেবল দেখতে আগ্রহীদের জন্য, টেলিভিশান অবশ্যই প্রথম পছন্দ। ইন্টারনেট থাকলে, ’ইউটিউব’। রানা প্লাজা ভেঙ্গে পড়ল। সেই ভাঙ্গা দালান কিংবা উদ্ধারকাজ দেখতে আগ্রহীদের জন্য ভিজুয়্যাল মিডিয়ার বিকল্প নেই। তবে যারা আগ্রহী, কি কি অনিয়ম হয়েছিল, কেন এমনটা ঘটল, তাদের জন্য ভিজুয়্যাল মিডিয়ায় খবর খুব একটা বেশি নেই। ঘুষ খাওয়া কোন অফিসারই ক্যামেরার সামনে জানাবেন না, তিনি কত টাকা খেয়ে, কিংবা কার আদেশে, এমন দালান তৈরির অনুমুতি দিয়েছিলেন।
এমন অনুষ্ঠান হয় না, তা বলছি না। বিভিন্ন অন্যায়, অত্যাচারের ভেতরের খবর নিয়ে অনুষ্ঠান হয়, তবে তা বেশ সীমিত। এবং খুব একটা জনপ্রিয়ও না। আমাদের দেশে ‘গোপন ক্যামেরা’র ব্যবহার এখনও খুব বেশি চোখে পড়ছে না, তবে তেমন কিছু হলে, আর বেশ কিছু সাহসী সাংবাদিকের দেখা পাওয়া গেলে, হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। অন্যদিকে, প্রিন্ট মিডিয়া এই ধরনের খবরের ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে আছে। বিশেষ করে ‘কলাম’। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ‘স্কান্ডাল’, সব বিষয় নিয়েই, কেউ না কেউ, কম বেশি দুকলম লিখছেন। পত্রিকায় সুযোগ না পেলে ব্লগ, সেখানে না হলে ফেসবুক। পেছনে উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, ব্যাখ্যা খোঁজার যতটুকু যা চেষ্টা, তা আছে, প্রিন্ট মিডিয়া তেই।
‘ব্যাখ্যা’ আর ‘কেন’ বিহীন এই ভিজুয়্যাল মিডিয়া তাই ব্যস্ত থাকে নতুন ইভেন্ট খুঁজতে। একটু ‘সেনসেশান’ একটু ‘বিতর্ক’ কিংবা একটু ‘সহিংসতা’। এমন কিছু, যা অভিনব, কিংবা দর্শক টানতে পারবে। এর আগে দর্শক টেনেছিল এমন কিছু হলেও চলবে। ভিজুয়্যাল মিডিয়া সেখানে উপস্থিত হবেই। আমরা দর্শকরাও হয়তো দায়ী, বিভিন্ন বিনোদন চ্যানেলের মাঝে খুব অল্প সময়ই আমরা বরাদ্দ রাখি খবরের চ্যানেলের জন্য। আর সেখানেও বেশি ভাগ সময়ই চলে যায়, ‘টক শো’ আর নয়তো রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা দেখতে। ‘হরতালের ভাংচুর’ কিংবা ‘দলীয় হুমকি’। অভিনব কোন ঘটনা, ‘ধর্ম পরিবর্তন’। আর সেকারণেই এসব অনুষ্ঠান বেশ বাজার পায়।
ভিজুয়্যাল মিডিয়া যেমন খবর খোঁজে, উল্টোটাও হয়। ভিজুয়্যাল মিডিয়ার জন্যও খবর তৈরি করা হয়। ভিজুয়্যাল মিডিয়ার এই ইভেন্ট খোঁজার অভ্যাসকে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা বেশ অনেকদিন থেকেই শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে সমাজতন্ত্রকে শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমেরিকা অনেক আগে থেকেই এর ব্যবহার করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা ইরাক যুদ্ধে দেশের মতামত তৈরিতে ভিজুয়্যাল মিডিয়া নিজের অজান্তেই তার ভুমিকা পালন করেছে। আবার উল্টোটাও করেছে। ইজরায়েলকে রক্ষা করতে, সত্যি খবরকে গায়েব করা থেকে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সব ভালো খবর ভিজুয়্যাল মিডিয়া থেকে হাওয়া করে দিয়েছে। বলাই বাহুল্য বেশ কাজে দিয়েছে। সমস্যা দেখা দিল, মিডিয়ার এই ক্ষমতা, যখন এই একই ফর্মুলা, অন্যরা ব্যবহার শুরু করল।
ভারতে ঘটা সাম্প্রতিক ‘ধর্মান্তকরণ’ প্রক্রিয়া এমন একটি মজার উদাহরণ। ‘ইভেন্ট’ এর খোঁজে ঘুরে বেড়ানো ভিজুয়্যাল মিডিয়ার জন্য তৈরি করা হল একটি খবর। অনুষ্ঠানের আয়োজন হল, ভিজুয়্যাল মিডিয়াকে ডাকা হল, ঘটনা ঘটানো হল এবং যথারীতি তাকে হেডলাইন বানিয়ে দেয়া হল। ‘কেন’ খোঁজার অভ্যাস কোন কালেই ছিল না ভিজুয়্যাল মিডিয়ার। এই ঘটনা প্রচারের সাথে সাথেই যে সেই বস্তিবাসীদের দারিদ্র কিংবা প্রতিদিনের সমস্যার চেয়ে বড় হয় উঠল অপ্রয়োজনীয় একটি সমস্যা ‘ধর্ম পরিবর্তন’। সাধারণ মানুষের মূল সমস্যা থেকে চোখ সরানোর এই ফর্মুলায়, ভিজুয়্যাল মিডিয়া, বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক, অংশ নিয়ে ফেলল।
সেই একই ঘটনা যদি মিডিয়া কাভারেজ ছাড়া ঘটত, তবে কি হতো? কিছুই হতো না, দ্বিতীয়বার এমন কোন ঘটনা ঘটতো না, এমনকি এমন প্রথম ঘটনাটাই হয়তো ঘটতো না। অথচ এখন, যে কাভারেজ তারা পেল তারপর, সবাই আগ্রহী হয়ে উঠেছে এসব ঘটাতে। মিডিয়া কাভারেজ যে পাবেই, সে ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত। সুযোগ নিতে আগ্রহী সবাই। এই মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে রাতারাতি নায়ক হয়ে উঠতে আগ্রহীদের লাইনও দীর্ঘ হচ্ছে। সরকারী দলও সেটাই চাইছে। দেশের মানুষের মূল সমস্যা থেকে নজর সরে যাক।
আসলে যেসব ঘটনা, মিডিয়ার জন্য ঘটানো হয়, তার কাভারেজ না পেলে, সেসব ঘটনার অকালমৃত্যু হয়। নবীকে কটাক্ষ করা সিনেমার তেমনটাই হয়েছিল, যখন তা ইংরেজি ভাষায় ‘ইউটিউবে’ ছাড়া হয়েছিল। আরবিতে ডাব করে আর ইসলামী দেশ গুলোতে তৈরি সহিংসতা, খবরটিকে কাভারেজ দিয়েছিল। খবরকে কাভারেজ না দেয়ারও উদাহরণ আছে। ইজরায়েলের যেকোন সহিংস ঘটনাকে যেভাবে আমেরিকার মিডিয়া মেরে ফেলে, চীন কিংবা একসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে পুঁজিবাদী দেশের খবরকে মেরে ফেলত।
কাজটা ন্যায় না অন্যায়, সে বিতর্ক ভিন্ন, এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, কোন ঘটনা মিডিয়ার জন্য ঘটানো হচ্ছে আর কোন ঘটনা সত্যিই ঘটছে। ‘এক বস্তিতে ২০০ মুসলমান হিন্দু হয়েছে’ এই ঘটনা মিডিয়া কাভারেজ না পেলে, দ্বিতীয়বার আর কখনই ঘটতো না। যারা ঘটিয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বাড়ানো তাদের উদ্দেশ্য না। তাদের উদ্দেশ্য ‘নায়ক’ হওয়া, ধর্ম ঘটিত বিতর্ক উস্কে দেয়া। আর তেমন কিছু না ঘটলে, তারাও আর উৎসাহ পেত না। কারণ তাদের একটাই চাওয়া ছিল, ‘কাভারেজ’।
‘আইসিস’ এর জবাই থেকে শুরু করে বামিয়াং এর বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস। আমেরিকায় কোরান পুরানো থেকে শুরু করে নবীকে কটাক্ষকারী সিনেমা, সবকিছুর উদ্দেশ্য একটাই, ‘পরিচিতি’, ‘কাভারেজ’। খবরের জন্য ঘুরে বেড়ানো মিডিয়া, ইচ্ছায় হোক আর ইনিচ্ছায় হোক, পা দিচ্ছে এই ফাঁদে। কোন নিয়ম করে, এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বোধহয় সম্ভব না। যতদিন না মিডিয়া নিজেই সংবেদনশীল হবে, কোন খবর কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, কোন খবর আসলে একটি ফাঁদ, কখন তাঁরা নিজেরা ফাঁদে পা দিচ্ছে। যতদিন না তাঁরা নিজেদের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করবে, যতদিন না ভাবতে শিখবে, ‘কেন আমাদেরকে ডেকেছে?’ কিংবা ‘কেন ঘটাচ্ছে?’ ততোদিন মিডিয়াকে ব্যবহার করার এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। আমরাও পেতে থাকবো, বিতর্কিত সব ঘটনা। আর আলোচনা থেকে হারিয়ে যাবে মূল সমস্যা।