একটা কমন সাইকোলজি হচ্ছে, যখন আমরা কাউকে কোন প্রশ্ন করি, নিজের অজান্তেই তার একটা উত্তরও মনে মনে ঠিক করে রাখি। ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রত্যাশা করে থাকি, ‘ভালোই আছি’ কিংবা ‘চলে যাচ্ছে একরকম’ এজাতীয় উত্তর। ‘আর বলেন না ভাই’ বলে একরাশ দুঃখের গল্প খুব কমই প্রত্যাশা করি। আমাদের এই ‘প্রেডিক্ট’ করার অভ্যাসের সবচেয়ে বড় ভুক্তভুগী হচ্ছেন বিবাহিত পুরুষরা। এক বাক্যের একটি কৌতুক পড়েছিলাম। ‘বিবাহিত পুরুষরা কখনও নরকে যাবে না, কারণ পৃথিবীতেই তাঁরা নরক ভোগ তো করেই ফেলেছে।‘
একমত হওয়া জরুরী না। বিবাহিত এবং সুখী ব্যক্তির সংখ্যা নেহাত কম না। আবার ‘ভাগ্যবানের বউ মরে’ প্রবাদটি শুনে একবারের জন্যও দীর্ঘশ্বাস ফেলেননি, এমন লোকের সংখ্যাও কম না। তবে ‘দিল্লি কা লাড্ডু’ বলে কথা। অবিবাহিত কোন পুরুষই কথাটা বিশ্বাস করেন না। এবং যথারীতি নরকবাসে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি জনৈক রিক্সাওয়ালা এবং তাঁর স্ত্রীর মাঝে নাটক দেখা নিয়ে রক্তারক্তি হয়ে গেছে। খবরটি পড়ে সহধর্মিণী বললেন, ‘সিরিয়ালের কোন এপিসোড মিস করলে পরে বুঝতে খুব সমস্যা হয়। একটু অপেক্ষা করলে কি হতো?’
সম্ভবতঃ এদেশের সব বিবাহিত পুরুষই, বেশ অনেকদিন হল বাড়ীর টিভির রিমোটের দখল হারিয়েছেন। ‘খবরটা একটু দেখতে দাও’ এমন আকুতি কমবেশি সব বিবাহিত পুরুষই, প্রতিদিন করে থাকেন। সেই আকুতিতে কখনও কাজ হয়, কখনও হয় না। একদিন বুকে সাহস নিয়ে তর্ক শুরু করলাম। ‘এই শাশুড়ি ননদের কুট কাচালি দেখে কি মজা পাও?’ প্রশ্নটার সরাসরি কোন উত্তর পেলাম না। বরং লতিফ সিদ্দিকি টাইপ গালির কাছাকাছি টক শো সম্পর্কে একটি সারাংশ পেলাম, ‘আর তুমি যে এসব ঝগড়া দেখো, সেটা দেখে কি হয়?’
এই ভয়ানক সমস্যার সমাধান করতে, বেশ অনেক বাসাতেই দুটি টিভি এসেছে। কেবল কোম্পানির মালিকের অজান্তেই বাড়ীর অন্য রুমে রাখা অপর টিভিটিতে একটি কানেকশান অনেকেই লাগিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ ইন্টারনেটে মনোনিবেশ করেছেন। এসেছ ফেসবুক, ব্লগ। আমার মত যাদের দুকলম লেখার শখ, তাঁরা শুরু করেছেন লেখালেখি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস কিংবা ব্লগে ঘ্যানঘ্যান। বিভিন্ন সাহিত্য পেজ এ লেখা শেয়ার দিয়ে জনতাকে জানানো। আর কখনও কোন সম্পাদকের চোখে পড়লে, নিয়মিত লেখার সুযোগ।
খবর জোগাড় করতে প্রায়ই তাই আমাকে দেশি বিদেশি পত্রিকা পড়তে হয়। ফেসবুকে বিভিন্ন পত্রিকার ফ্যান পেজে ‘লাইক’ দিয়ে রেখেছি। তারাও আমার ‘নিউজ ফিডে’ তাঁদের অবাক করা খবরগুলো পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নারীঘটিত খবরের বাজার বেশ রমরমা। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, ফেসবুক খুললেই সেই খবরের লিঙ্কগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ‘ভাবীর চুমুর কারণে দেবরের বিয়ে ভেঙ্গে গেল’ জাতীয় খবর হেন পত্রিকা নাই যে রিপোর্ট করেনি। কখনও যদি সহধর্মিণী, ‘কি এতো দেখছো ইন্টারনেটে?’ বলে পাশে এসে বসেন, তিনি দেখতে পান ল্যাপটপের মনিটরে ভেসে আছে, ‘একজন মেয়েকে পটানোর পাঁচটি সহজ উপায়।‘
এই অবস্থায় যারাই পড়েছেন, তাঁরা হয়তো জানেন এরপরে কি ঘটে, তবে বাকীদের জন্য জানিয়ে রাখছি, এরপরে নরকের যে জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে স্বর্গের বাতাস আসতো সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। ‘ও, এসব দেখার জন্য সারাদিন ইন্টারনেটে বসে থাকো?’ রিক্সায় একসাথে চলতে গেলে এদিক ওদিক তাকাতে পারেন, তবে খুব সাবধান যখন অপর দিক থেকে আসা রিকশায় একজন রুপবতী থাকবে। নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার সহধর্মিণী আড় চোখে দেখে নিয়েছেন, আপনার নজর কোনদিকে। আপনি হয়তো ভাবছেন, সহধর্মিণী দেখতে পায়নি। ভুলটি অচিরেই ভাংবে এবং আপনার সহধর্মিণীর ভেতরে থাকা ‘শার্লক হোমসে’র দেখা পাবেন বাড়ী পৌঁছেই।
‘পুরুষরা আগ্রাসী হবেই’ এমন বক্তব্যে নিন্দার ঝড় উঠলেও, এর পেছনে লুকিয়ে থাকা নরকবাস অনেকেই দেখতে পাননি। নরকে এভাবে অত্যাচারিত হতে হতে অনেকে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। কোন ফোন আসলে, ‘কার ফোন?’, বাসায় আস্তে দেরী হলে, ‘এতো দেরি হল কেন?’ এমনতর ছোটখাট ঝামেলাকে ইদানীং আর ঝামেলা মনে হয় না। বরং উল্টোটা হয়। দেখবেন হঠাৎ কোন এক শুভক্ষণে যখন হাতে রিমোট পাবেন, বিশ্বাস হবে না। নিজেকে চিমটি কাটতে হবে, দেখতে হবে আপনি জেগে আছেন না ঘুমাচ্ছেন। তবে সাবধান, কোন প্রসাধনের বা পারফিউমের অ্যাড আসবার সাথে সাথে যদি রিমোটের বোতামে চাপ দিতে দেরি করেন, পাশ থেকে হুঙ্কার আসবে ‘এসব কি দেখছো, দাও রিমোট দাও। তোমাকে দেখতে হবে না।‘
সেদিন, একটি খবর শুনে ঠোঁট বাঁকা করে একটু হেসেছিলাম। ঠোঁটের বাঁকা ভাবটা বোধহয় একটু দীর্ঘসময় ধরে ছিল। ব্যাপারটা আবিস্কার করলাম যখন সহধর্মিণী পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন।
--হাসছো কেন?
বোঝার চেষ্টা করলাম, কি উত্তর চাইছে? এবং সত্য উত্তর বলাটা কতোটা আত্মঘাতি হবে। খুব ভালো বুঝতে পারলাম না। আমার ধারণা আমার সহনরকবাসীরাও এমন পরিস্থিতিতে ঠিক করতে পারতেন না, কি করবেন। অভিনব এই সমস্যার ব্যাপারে, তেমন কোন ‘পরিত্রাণের পাঁচটি সহজ উপায়’ জাতীয় কোন লেখা চোখে পড়েনি। এমন পরিস্থিতিতে যা করি, এবারও তাই করলাম। সততার পথে হাঁটলাম। এবং অচিরেই আবিস্কার করলাম আমার জন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে ‘অষ্টম নরক’। জানালাম
--খবরটা দেখে হাসলাম।
--কি খবর?
--সাউথ আফ্রিকার এক লোক ওর স্ত্রীকে হত্যা করেছে।
--কেন?
--একটা ছেলেরে সঙ্গে প্রেম ছিল।
--কার? মেয়েটার?
--না। ছেলেটার।
প্রথমে বিস্ময়, এরপরে হতাশা এবং সবশেষে আসলো আমার অষ্টম নরকে প্রেরণের সিদ্ধান্ত
--ছেলেদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে না।