প্রিন্ট মিডিয়ার কি হবে? বেশ কিছুদিন আগে সাপ্তাহিক ২০০০ আর অতি সম্প্রতি অর্থনীতি প্রতিদিন আর দৈনিক বর্তমানের মৃত্যুঘণ্টা বাজল। দুএকটি ছাড়া সম্ভবতঃ সব পত্রিকাই অর্থনৈতিকভাবে লোকসানে চলছে। এবং যেভাবে মালিকপক্ষের কেউ কেউ আর লোকসান গুণতে রাজী হচ্ছেন না, আর পত্রিকাগুলো টপাটপ পটল তুলছে, প্রশ্নটা জাগা বোধহয় খুব অস্বাভাবিক নয়,’কি পরিণতি হতে যাচ্ছে প্রিন্ট মিডিয়ার’। শুধু কি তাই, কাগজের পত্রিকার সঙ্গে টেক্কা দিতে যেভাবে ইন্টারনেট আর ভিজুয়াল মিডিয়ার স্রোত বইছে, তাতে সন্দেহটা আরো বেশি করে জাগছে, ‘পারবে কি টিকে থাকতে?’
ইন্টারনেট আর ভিজুয়াল মিডিয়ার মুল সুবিধা, প্রতি মুহূর্তে পাওয়া খবর। আর সেখানে প্রিন্ট মিডিয়া চব্বিশ ঘণ্টায় খবর দিচ্ছে মাত্র একবার। যেখানে প্রতিনিয়ত ঘটনা ঘটছে, যেখানে প্রতিমুহূর্তের খবর আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে, সেখানে সারাদিনে মাত্র একবার খবর জানতে পারলে কি চলবে? এই ভাবনা থেকে অনেকে সান্ধকালীন পত্রিকা বেরও করেছিলেন, তবে খুব ভালো করতে পারেননি। কিছুদিন আগে একটি সাপ্তাহিক আর সাম্প্রতিক দুই দৈনিক পত্রিকার মৃত্যু, প্রশ্নটা আরও অনেক বেশি জোরালো করে দিয়েছে, ‘কি হতে যাচ্ছে এই প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ?’
উত্তর খুঁজতে এদিক ওদিক তাকালাম। খবর জানবার আধুনিক এই সাধনগুলো এদেশে নতুন আসলেও, পাশ্চাত্য বিশ্বে বেশ অনেক দিন আগেই এই দুই মিডিয়া ছিল। আর সেখানে যেহেতু প্রিন্ট মিডিয়া বহাল তবিয়তেই টিকে আছে, তাই মনে একটা আশ্বাস পেলাম, এদেশেও এই ফর্মুলার ব্যত্যয় হবে না, প্রিন্ট মিডিয়া থাকবে। আঙ্গিক পাল্টালেও, থাকবে। টিমটিম করে হলেও তারা জ্বলবে। হয়তো বেছে বেছে খবর পরিবেশন করবে, কলাম কিংবা ‘এনালাইসিস’ বেশি জায়গা দখল করবে। তারপরও থাকবে।
সার্বক্ষণিক সঙ্গী মুঠোফোনটিকে আরো বেশি কাজে লাগানোর জন্য ফোনের আকার বড় হচ্ছে, ট্যাবলেট আসছে--- যা দিগন্ত খুলে দিচ্ছে অনলাইন মিডিয়ার। মোবাইলে ম্যাসেজ সার্ভিসের মাধ্যমে অনেকে খবর পৌঁছে দিচ্ছেন। টিভিতে সার্বক্ষণিক চলা স্ক্রলিং, ফেসবুক, টুইটার সবই আছে। হয়তো আরও নতুন কোন সাধন আসছে, তারপরও, কাগজে ছাপা লেখা পড়বার লোক হয়তো থাকবেন। তাই বলা যায় প্রিন্ট মিডিয়ার ম্যাজিক এখনও বর্তমান।
অধিকাংশ পত্রিকাই যেখানে লোকসানে চলছে সেখানে মুল প্রশ্ন আসে, এই ব্যবসায় আসছেন কারা? এবং কেন? চারদিকে লোকসানের এতো উদাহরণ থাকতেও কেন অনেকেই আসছেন এই ব্যবসায়? এই লোকসানটা কি খুব লাভজনক? একটু ভেতরের খবর জানা একজন সম্পাদকের সাথে কথা বলে বুঝলাম, অ্যাড না পেলে একটি পত্রিকা বিক্রি করে লাভজনক ভাবে চালাতে হলে আট পাতার একটি পত্রিকার দাম রাখতে হবে দশটাকা। এবং বলাই বাহুল্য মাত্র আট পাতার পত্রিকা কেউই দশটাকা দিয়ে কিনবেন না। যেখানে ২৪পাতার পত্রিকা পাওয়া যাচ্ছে আট থেকে দশ টাকায়। তাহলে? কিভাবে চলছে এসব পত্রিকা? সোজা উত্তর, আপাততঃ লসে। আর নয়তো অ্যাড এর পয়সায়।
অ্যাড পাওয়া যায় সরকারী এবং বেসরকারী উৎস থেকে। সরকারই অ্যাড পাওয়ার সোজা নিয়ম, চাটুকারিতা কিংবা দলীয় মানুষের মালিকানা। আর প্রাইভেট বা ব্যক্তি মালিকানাধীন কোন প্রতিষ্ঠানের অ্যাড পাওয়া যায় নিজ যোগ্যতা আর পরিচিত দিয়ে। এবং একজন ব্যবসায়ী তখনই কোন পত্রিকায় অ্যাড দেবেন, যখন সেই পত্রিকার সার্কুলেশান ভাল হবে। আর সেটা ভালো না হওয়া পর্যন্ত লসেই চালাতে হবে। ফলে খুব সহজ যে প্রশ্নটা জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে দাঁড়াচ্ছে তা হচ্ছে, এই সার্কুলেশান ভালো হওয়া পর্যন্ত লসে পত্রিকা চালাবার ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতা কয়জনের আছে? এবং কতদিনের জন্য আছে?
খেলা এখানেই। চারদিকে তাকালে যে কয়টি পত্রিকা নিয়ে সকালে হকার সাহেব বের হন, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই কোন না কোন গ্রুপের। বিখ্যাত সব ধনকুবেরের। লসে পত্রিকা চালাবার আর্থিক সামর্থ্য যাদের আছে। এবং কেন তাঁরা এই লস গুনছেন? একটি হতে পারে, আপাততঃ লস হলেও একসময় লাভ আসবে। এই লস এক অর্থে ইনভেস্টমেন্ট। তবে সৎ উত্তর হচ্ছে, বিশাল লাভের উৎস প্রিন্ট মিডিয়া কখনই ছিল না এবং সম্ভবতঃ হবেও না। এই শিল্পের সঙ্গে বর্তমানে যারাই যুক্ত হচ্ছেন তাঁদের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘স্ট্যাটাস’। মিডিয়া এখন প্রায় সব ধনকুবেরের স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি পত্রিকা এবং সম্ভব এবং সামর্থ্য থাকলে একটি চ্যানেল।
স্ট্যাটাসই কি একমাত্র কারণ? না। সেটা অর্ধসত্য। আরও কিছু কারণ দেখানো হয়। যদিও এসব কারণ, যেমন সত্য সংবাদ পরিবেশন, সাহসী সাংবাদিকতা ইত্যাদি ইত্যাদিকে গাল ফোলানো বুলি ছাড়া খুব বেশ কিছু মনে করা হয় না, তারপরও এগুলোই বলা হয়। বলা হয় কারণ কোন এক সময়, যখন সততা দেখতে পাওয়া যেত, তখন এগুলোই ছিল সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মুল কারণ। তবে বর্তমান সময়ের জন্য সৎ উত্তর হচ্ছে, ‘ক্ষমতা’।
মিডিয়ার অসীম ক্ষমতা কমবেশি সবাই বুঝতে শুরু করেছেন। জেমস বন্ডের একটি মুভি তো মিডিয়ার ক্ষমতাকেই ভিলেন বানিয়ে ফেলল। কমবেশি সব সরকারই বুঝে গেছে মিডিয়ার ক্ষমতা। তাই এদেশে কোন সরকারই এখন নিজের লোক ছাড়া অন্য কাউকে কোন চ্যানেল শুরু করার অনুমুতি দেয় না। পত্রিকা ক্ষমতার দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে আছে দেখে, সেখানে এই নিয়ম এতো কড়াকড়িভাবে মানা হয় না। সেখানে স্ক্রু টাইট দেয়া হয়, সরকারি বিজ্ঞাপনের যোগান না দিয়ে।
মুল যে প্রশ্নটা চিৎকার করে উত্তর চাইছে তা হচ্ছে, ‘উপায় কি?’ কিভাবে কোন পত্রিকার পক্ষে, কারো ক্ষমতার হাতিয়ার না হয়ে, কেবল সৎ সাংবাদিকতার উপকরণ হওয়া সম্ভব। কিংবা আদৌ সম্ভব কি না। সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার লোভে কোন পত্রিকাই সেই অর্থে সরকারের সমালোচনা করে না। প্রায় সব কলামিস্টই কোন না কোন দলের লেজ হয়ে বসে আছেন। পত্রিকাগুলোর ওপরও ট্যাগ লেগে গেছে, কোনটা কোন দলের লেজুড় পত্রিকা। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যাপারটা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়।
সম্ভবত সেকারণেই গজিয়ে উঠেছিল ‘ব্লগ’। সেখানে দেখা দিয়েছিল বেশ কিছু অকুতোভয় লেখক। যারা, যেকোনো বিষয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দল, সবারই সমালোচনা করতে পারতো। ফলে একটি আশার আলো দেখা গিয়েছিল, হয়তো এখান থেকে আসল খবর পাওয়া যাবে। কিছু লোক দেখানো খবর কিংবা ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া খবর না শুনে সত্যিকারের খবর জানতে অনেকেই ব্লগ আর ফেসবুক থেকে খবর সংগ্রহ শুরু করেন। কিছু সময়ের জন্য বেশ কিছু অনলাইন পত্রিকা জমজমাটও হয়ে ওঠে। তবে পরিস্থিতি পাল্টাতে সময় লাগলো না। রাজনীতি সেখানেও হানা দিল। ব্লগও এখন বিএনপি, আওয়ামী, জামায়াত আর বাম গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের কবর খোঁড়ার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছে।
ফলে, সংবাদপত্রশিল্প আবার এসে দাঁড়িয়েছে সেই ‘স্কয়ার ওয়ানে’। কোন উপায় কি নেই? কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে, কেবল পত্রিকা বিক্রির আয় দিয়ে নিজেদের খরচ তোলার লক্ষ্য নিয়ে কোন পত্রিকা কি আসবে না? পাবো না এমন কোন পত্রিকা, যেটা হাতে নিয়ে বলতে পারি, ‘এরা কারো দালালি করে না।’