দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। ‘কালসি’ নিয়ে এই মুহূর্তে ফেসবুক জমজমাট। কারো দরদ উথলে উঠছে। কারো ঘৃণা। কেউ উস্কানি দিচ্ছেন তো কেউ আবার অপমানবোধে কাতর হচ্ছেন। স্ট্যাটাসের পরে স্ট্যাটাস। লাইকের পরে লাইক। এই বিষয়ে একটা লেখা না লিখলে কেমন দেখায়? সেলিব্রিটি হিসেবে মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে। ফলে কম বেশি দুকলম সবাই লিখছেন।
মৃত্যুর প্যাটার্ন নিয়েও কেউ কেউ লিখছেন। পুড়িয়ে মারা ব্যাপারটা বীভৎস হয়েছে। অন্যভাবে মারলে হয়তো খারাপ হতো না। কিংবা এতোটা প্রতিবাদ করতেন না। তাই এরপরে যেন ব্যাপারটা খেয়াল রাখা হয়। বারবার মনে করানো হচ্ছে ওরা মানুষ। পশু হলে পোড়ানো যেতে পারে, তবে মানুষের ক্ষেত্রে নতুন কিছু ভাবা উচিৎ। এক পরিবারের সাতজন। এই নিয়েও অনেকের আপত্তি। বিভিন্ন পরিবারে ভাগ করে মারা উচিৎ ছিল। যত বেশি পরিবারে আঘাত করা যায় ততো আনন্দের ব্যাপার।
আরও অনেক কিছু আসছে। সবচেয়ে বেশি আসছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’। বেচারা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পড়েছে বেশ সমস্যায়। যেকোন কাজ করে কোনভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ টেনে আনা গেলে আর কিছু লাগে না। এবার আপনি অনেকটাই নিরাপদ। আপনার বিরুদ্ধে কেউ বলেছে কি, জামাত বানিয়ে ফেলতে পারেন। রাজাকার, আলবদর। যা মন চায়। এরপরে মা, বোন যার সঙ্গে যৌনাচার করতে মন চায়, জানান। সেটাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে চালান, সমস্যা নেই। কেউ আপত্তি করলে, বলবেন ‘চুশিল’।
ইদানীং গালি দেয়ার আরও একটা অজুহাত জুটেছে। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। যেহেতু বিহারী মরেছে, আর বাঙালি মেরেছে—তাই প্রমাণিত—এর পেছনে কাজ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পটকা, বাজী, শবেবরাত, সিয়া, সুন্নি—রীতিমত এক খিচুড়ি অবস্থা। কেউ বোঝাতে চাইছেন এর পেছনে কাজ করছে ওয়াহাবী স্টাইল ধর্ম প্রচার। শিয়াদের স্টাইলের ধর্মীয় আচরণের বিরোধিতা করার সুদূর প্রয়াসী পরিকল্পনার অংশ। কেউ আবার পটকা, বাজী এসবের সব্দ দূষণ নিয়ে দুকথা শোনাচ্ছেন।
জেনেভা ক্যাম্প নিয়েও বেশ কিছু তথ্য আসছে। তাঁদের মানবেতর জীবন নিয়ে নাকি কান্না ও যেমন আছে তেমনি তাঁদের অত্যাচারে মিরপুর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে—এমন বক্তব্যও আসছে। বস্তি মানেই অপরাধের আখড়া। সে নিয়ে ভাবনা শুরু করার মোক্ষম সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। যে যেভাবে পারছেন, বুদ্ধি দিচ্ছেন। উপদেশ আর উপদেশ।
এদেশে বসবাসের কিছু ফর্মুলা দাঁড়িয়ে গেছে। কারো কোন জমি কিংবা সম্পত্তির ওপর নজর পড়েছে? প্রতিপক্ষ নরম সরম হলে নিয়ে ফেলুন। কাজটা একাকী করতে চাইলে, পুলিশ প্রশাসন এদের হাত করে করতে হবে। কিছু টাকা খরচ করে মিডিয়াকেও সামলাতে হবে। নেহাত নুর হোসেন টাইপ পাবলিসিটি না হলে পার পেয়ে যাবেন। মাথার ওপরে বড় হাত থাকলে হয়তো সংবাদ সম্মেলনে আপনার পরিবারের জন্য সহানুভুতির ঘোষণা আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, আগে যা খুশি করে তো ফেলুন। পকেটে টাকা থাকলে, আর গায়ে সরকার দলীয় সিল থাকলে সাময়িক কিছু সমস্যা হলেও, আখেরে পার পেয়ে যাবেন।
যদি নজরে পড়া এলাকা বড় হয় কিংবা সেখান কোন বস্তি বা লোকালয় থাকে, তার জন্য ব্যবস্থা একটু আলাদা। কোন বস্তি দখল কিংবা কোন ভালো জমি দখলের ক্ষেত্রে ফর্মুলা নির্ভর করছে, এই মুহূর্তে এলাকাটা কাদের দখলে আছে। তাঁদের কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় কি না। কোন ভাবে তাঁদের সংখ্যালঘু বানানো যায় কি না। আর সেই একি ফরমুলায় কোন না কোনভাবে আপনি নিজে সংখ্যা গুরু কি না। সে মুসলমান হিসেবে হোক কিংবা বাঙালি হিসেবে হোক। তেমন কিছু হলে, আর সমস্যা নেই।
এরপরে চাই শুধু একটা ইস্যু। ফেসবুকে অবমাননাকর ছবি থেকে শুরু করে আপনার বিধাতাকে অপমান করা। নবী, রসুল, পয়গম্বর যে কাউকে কটাক্ষ করা। জাতীয়তাবাদ হলে আনতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ। সেই সময়ের অত্যাচার। তখন ঘটে যাওয়া ‘রেপ’ এর বদলা হিসেবে এখন ‘রেপ’ করা যেতে পারে। তখন ঘর জ্বালানোর বদলায়, এখন ঘর জ্বালানো যেতে পারে। তবে ইস্যুটা হতে হবে আকর্ষণীয়। দশ টাকা নিয়ে মারামারি হলে চলবে না। বাজি ফোটানো, পতাকা উত্তোলন, ক্রিকেটে পাকিস্তান কে সমর্থন এধরনের ইস্যু হলে ভালো হয়। তবে আক্রমণ হওয়া চাই দলগত।
এরপরে অনেকেই এদের পাশে দাঁড়াবে। ব্লগ, ফেসবুক, রাজনৈতিক দল, এনজিও। এদের নিয়ে গালাগালি থেকে দরদ বিতরণ সব যথারীতি চলবে। শুধু আপনি আড়ালে থেকে যাবেন। যেখানে ধর্ম আর জাতীয়তাবাদ টাইপ ইস্যু আছে সেখানে দুই মাস্তানের এলাকা দখলের খবর বেজায় পানসে। সে নিয়ে রিপোর্ট যদি হয় ও, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। এক ইলিয়াস মোল্লার এলাকা দখলের গল্প লেখার যেমন কেউ নেই তেমনি এসব গল্পের কাটতি ও নেই। এসব নিয়ে ব্লগ, ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার লোক ও পাওয়া যাবে না।
‘কালসি’ র ঘটনা নিয়ে ইলিয়াস সাহেব মনে হয় না তেমন কোন সমস্যায় পড়বেন। এখন বিহারী, বাঙালি, মৃত্যুর পদ্ধতি, পুড়ে কাবাব, মানুষ, পশু, জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার, গণজাগরণ এসব নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কিছুদিন এমন যাবে। যেদিন পরিস্থিতি শান্ত হবে, তখন হয়তো আবিষ্কার হবে, বেশ কিছু বিহারী পরিবার ওখান থেকে পালিয়ে গেছে। কিছু এলাকা আর জেনেভা ক্যাম্পের অন্তর্ভুক্ত না। ‘মিশন অ্যাকমপ্লিসড’।