ছেলেবেলায় স্বপ্ন দেখতাম বোম্বেটেদের মত জাহাজে করে ঘুরে বেড়াব দক্ষিন সাগরের প্রবাল দ্বীপগুলোতে। বাহামা, হাইতি, তাহিতি, ভানুয়াতু, বারমুডা... কত যে নাম! এক একটা দ্বীপ যেন স্বর্গের এক একটা টুকরো। 'বোহেমিয়ান' কথাটা মনে হয় এখান থেকেই এসেছে।
জাহাজী হবার সেই স্বপ্ন ছেড়ে চলে এসেছি বহুদূর। তবে এবারে সেই স্বর্গের টুকরো'র কাছাকাছি পৌছে ছুঁয়ে এলাম তাকে।
বাহামা ..... একটা দ্বীপ নয়। প্রায় ৭০০ দ্বীপের পূঞ্জে মাত্র ৩০ টিতে বসতি আছে। এক সময় কেবল আরাওয়াক ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল এখানে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার উত্তর আমেরিকা অভিযানে এখানেই প্রথম মাটির দেখা পান।
এরপর ১৭০০ শতাব্দীতে বাহামা হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের আস্তানা। মূলত জলদস্যুদের শায়েস্তা করতেই এখানে ব্রিটিশ কলোনির সূত্রপাত হয়।
গোটা ক্যারিবিয়ান তখন পাইরেটদের স্বর্গরাজ্য। ক্যাপ্টেন কিড, ডেভি জোনস, কাটলার বেকেট, সাও ফেং... এমন কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ক্যারিবিয়ানে সুযোগ বুঝে ডাকাতি করতো (এই তথ্যে আমি টাশকিত!!!)। এদেরকে তাড়াবার নিমিত্তে বাহামার রাজধানী নাসাউ তে ফোর্ট শার্লট আর ফোর্ট ফিনক্যাসল নামে দুটি দূর্গ গড়ে তোলে ব্রিটিশ সরকার।
পরবর্তীতে আরাওয়াকদের উত্তরপুরুষ ও আফ্রিকা হতে কৃতদাস হিসেবে ধরে আনা (অবশ্যই সভ্য! ব্রিটিশদের দ্বরা) মানুষদের প্রজন্মরাই বাহামার মূল বাসিন্দা হয়ে দাড়িয়েছে।
আগেই বলেছি নাসাউ হল বাহামার রাজধানী। একে নিউ প্রভিডেন্স ও বলা হয়। ২১ বাই ৭ মাইলের এই দ্বীপটা প্রশান্তির এক বিমূর্ত মূর্তি যেন। এর লাগোয়া আরেকটি ছোট্ট দ্বীপের নাম হল 'প্যারাডাইজ আইল্যান্ড'। নামেই যার পরিচয়। দুটি দ্বীপের মাঝে এখন একটি সেতু আছে। সেই সাথে ফেরী সার্ভিস তো আছেই।
চলুন ঘুরে আসি একটুখানি......
প্লেন থেকেই দেখা যাচ্ছিল অপার নীলের ক্যানভাস। আকাশ আর সাগর যেন মিশে একাকার হয়ে গেছে। আমার পেছনে দুই পিচ্চি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কেবল ওহ গড! ওহ গড বলে চিৎকার করছিল। একবার ভাবলাম আমি 'আল্লাহ রে.....' বলে একটা চিক্কুর দিই। কিন্তু ভদ্রলোক হবার বড্ড জ্বালা
ক্রমেই স্পষ্ট হল স্থলভাগ। উপড় থেকে চোখে পড়ছিল সবুজ ভূমির মাঝে আগুন রঙা লাল। আরে! এ যে আমাদের কৃষ্ণচুড়া!!! কিন্তু পরে আর ছবি তূলতে পারিনি।
নাসাউ কেবল বীচ এর একাংশ।
বাহামা'র বীচগুলো বিখ্যাত এর নীল রঙের জন্য। নীলের এমন সৌন্দর্য অন্য কোথাও চোখে পড়েনা। এর কারণ হল, পৃথিবী'র সবচে' বড় প্রবাল প্রাচীর বাহামায়। প্রবাল প্রাচীর বা দ্বীপের পানি এমনিতেই অনেক নীল হয়। আর নাসা'র সূত্র মতে বাহামার পানি সবচেয়ে পরিস্কার। বাহামার সমুদ্রে খালি চোখেই পানির ২০০ ফুট পর্যন্ত দেখা যায়।
নাসাউ পোর্ট অথরিটি আর কাস্টম বিল্ডিং। টুরিস্টদের জন্য দ্রস্টব্য স্থান।
সেন্টাল ক্যাথেড্রাল। বাহামিয়ানদের বেশীরভাগই খ্রিস্টান। তবে ধর্মের চাইতে তাদের কাছে নিজস্ব সংস্কৃতিই বেশী প্রাধান্য পায়।
নাসাউ ক্রিকেট ক্লাব। ইংরেজ শাসনামলে এই ক্লাব গড়ে উঠে। এখনো এখানে সেই প্রাচীন ক্লাব কালচারের দর্শন মেলে।
ক্রিকেট গ্রাউন্ড। সবেধন নীলমনি এই একটা প্লেয়িং গ্রাউন্ডই চোখে পড়বে। এছাড়া ২টা গলফ কোর্স ও আছে। কিন্তু খেলতে পারিনা, তাই যাইনি
নাসাউ ডাউন টাউন। এই যায়গাটিই নাসাউ এর প্রাণকেন্দ্র। শপিংমল, বানিজ্য কেন্দ্র, অফিস আদালত সব এখানেই অবস্থিত। নাসাউ ডক (এর আরেক নাম প্রিন্স উইলিয়াম রাফট) ও এখানেই। অন্য সব যায়গা থেকে এখানে বাস সার্ভিস আছে। বাসগুলোকে বলে 'জিটনি'। যেখানেই যান, ভাড়া সোয়া এক টাকা
নাসাউ পার্লামেন্ট হাউজ। আমাদের মত বিশাল না হলেও কাজে যে অনেক বিশাল তা বাহামার অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধি দেখলেই টের পাওয়া যায়। ওহ! এখানে গালাগালির নিয়ম নেই
নাসাউতে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়। তবে তা বেশীর ভাগ টুরিস্টরাই ব্যবহার করে। বেশীর ভাগ বাহামিয়ানদের গাড়ি আর বোট আছে। আর সামান্য যে আম জনতা, তাদের জন্য জিটনি।
নাসাউ স্ট্র মার্কেট। বাহামিয়ান কুটির শিল্পের এই হাটে পাওয়া যায় হরেক রকম হস্তশিল্প। মুখোশ, মিনি বঙ্গো (বাহামিয়ান ড্রাম), কৃষ্ণচুড়ার পাতায় তৈরী অ্যালবাম, ঝিনুকের মালা... আরও কত কি!
এখানে ছবি তোলা আইনত দন্ডনীয়। তবুও সাহস করে তুলে ফেললাম কয়েকটি।
বাহামিয়ান মুখোশের সাথে ইনকা আর ইস্টার আইল্যান্ডের মুখোশগুলোর দারুন মিল আমাকে অবাক করেছিল।
নাসাউ লাইট হাউজ। পেছনে প্যারাডাইজ আইল্যান্ড এ অবস্থিত আটলান্টিস হোটেল।
বে সাইড। বা পাশে প্যারাডাইজ আইল্যান্ড।
এই রিসোর্ট টি একেবারে লেগুনের মাঝে। এখানে রাখা বোটগুলো নিয়ে সরাসরি সাগরে চলে যাওয়া যায়।
লেগুন ধরে এগিয়ে গেলেই নীল জলের হাতছানি। সাগরের মাঝে অনেকদুর চলে যাওয়া এই ওশান গেজিবো টা ছিল আমার নিত্য বিকেলের গন্ডী। এখানে বসে বুঁদ হয়ে যেতাম নীলের নেশায়।
চলবে........
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১০ সকাল ৮:২৮