রাজধানীর যানজট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে উড়াল সড়ক। কিন্তু এসব উড়াল সড়ক যানজট নিরসনে কার্যত কোনো ভূমিকাই রাখছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সঠিক পরিবহন বা যোগাযোগ পরিকল্পনা না করে এসব উড়াল সেতু নির্মাণ শুধুই দেশের দেনা বাড়াবে।
ফ্লাইওভার বা উড়াল সেতুর সঙ্গে রাজধানীবাসীর পরিচয় মহাখালী ও খিলগাঁও উড়াল সড়কের মাধ্যমে। ১১৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম উড়ালসেতু নির্মাণ করা হয় মহাখালীতে। ৬৬৭ দশমিক ৭৮ মিটার দীর্ঘ এই উড়ালসেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০০৫ সালে। এটি মহাখালী রেলক্রসিং থেকে বনানী পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করেছে। উত্তরা, বিমানবন্দর, খিলক্ষেতগামী গাড়িগুলো মহাখালী রেলক্রসিংয়ের দীর্ঘ সিগন্যাল থেকে রক্ষা পেয়েছে এই উড়ালসেতুর কল্যাণে। কিন্তু গুলশান, বনানী, বাড্ডা রুটে চলাচলকারী পরিবহনের জন্য কোনো সুফলই আনতে পারেনি এটি। ফলে মহাখালী এলাকার চিরচেনা যানজট এখনো পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
একই বছর ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও-বাসাবো উড়ালসড়ক খুলে দেয়া হয় যান চলাচলের জন্য। রামপুরা-খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া ও আশপাশের এলাকা থেকে মতিঝিল যাতায়াতের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই এতে। ফলে খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘ যানজট রয়েই গেছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নেয়া তেজগাঁও-বিজয় সরণি উড়ালসড়কটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০১০ সালে। এটি কার্যত কোনো যানজট নিরসন তো করেইনি, বরং বিজয় সরণিতে সৃষ্টি করেছে দীর্ঘ যানজটের।
খিলগাঁও, মহাখালী উড়াল সড়ক যেখানে যানজট নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সেতু ও সড়ক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। রাজধানীর সবচেয়ে বড় উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্থান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়কটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা।
হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদাননির্ভর এসব উড়াল সড়কও সেতু কতটুকু কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনেকেই মনে করছেন, এসব ফ্লাইওভার শুধুই দেনা বাড়াবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “যেকোনো মেগাসিটিতে ফ্লাইওভার প্রকল্প যানজট নিরসনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রহণ করা হচ্ছে কি না। ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ফ্লাইওভার প্রকল্প গ্রহণ করলে তা অবশ্যই ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার সব কটিই ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে না।”
ইকবাল হাবীব বলেন, “অপরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করা এসব প্রকল্প দেখে মনে হয়, শুধু বৈদেশিক মুদ্রা খরচের জন্যই এগুলো করা হচ্ছে।”
এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, “আমাদের ভাবতে হবে, এসব ফ্লাইওভার কাদের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর ওপর দিয়ে কোন ধরনের পরিবহন চলাচল করছে। আসলে এসব ফ্লাইওভার দিয়ে প্রাইভেট কার ছাড়া অন্য কোনো পরিবহন চলাচল করবে না। এর কারণ হচ্ছে, গণপরিবহনকে প্রতি আধা কিলোমিটারের কম দূরত্বে যাত্রী ওঠানো-নামানো করতে হয়। ফলে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে কখনোই এসব গণপরিবহন চলাচল করবে না। যদি দূরপাল্লার পরিবহন হতো তাহলে এসব ফ্লাইওভার ব্যবহার করা সম্ভব ছিল।”
ইকবাল হাবিব বলেন, “হিসাব করলে দেখা যাবে, মাত্র ১৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য এসব ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। বাকি ৮৩ শতাংশ মানুষকে পোহাতে হবে দুর্বিষহ যানজট।”