আমি লক্ষ্য করেছি, কখনো কখনো কবিতা পড়ে বুঝা যায়। তবে কবির কণ্ঠে যদি আমরা শুনে ফেলি তখন ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়, অন্য একটা মেজাজ পাই। এ তো অন্যরকম শুনতে! এর কারণ কিন্তু অনেকগুলো। একটা কারণ হচ্ছে- ভাষার যে বিভিন্ন ধরনের ছায়া আছে সে ছায়ার ভেতর কোন কোন ভাষা বাংলাভাষা হয়েও বাংলাভাষা নয়। যেমন, আজকের আড্ডার কবি কাফি কামাল যে কবিতাগুলো পড়েছে। সেগুলো শুনে মনে হলো একি হুবহু বাংলা ভাষা? যে প্রমিত বাংলাভাষা নদীয়া থেকে এসেছে, কুষ্টিয়া থেকে এসেছে। যা প্রমথ চৌধুরীর কাছে, রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখেছি। সে বাংলা ভাষায় কাফি লিখছে, কিন্তু তার উচ্চারণে কেমন যেন অন্যভাব। আর ওর কবিতায় কিছু শব্দতো ঢুকেই গেছে। যেমন- তার মেইট্টাল। একই বিষয়টি অন্যভাবে আমাদের চিন্তা করতে হবে। একজন কবিতো লেখক, কারণ কবিও লিখেই নিজেকে প্রকাশ করেন। নতুন এবং মৌলিক কবি প্রকাশ করেন তার আশপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ, সে পরিবেশের গন্ধ। তা যতই অন্যের কাছে অপছন্দ হোক, অপরিচিত হোক। সে বিষয়টিকে দেখা, লেখা এবং কথা বলা। আমার দৃষ্টিতে এসব বিবেচনাই কাফি কামালের প্রথম স্বাতন্ত্র্য। এখন কাফি কামালের নাম কাফি কামাল না হয়ে নাফি কামাল হলে কোন অসুবিধা হতো? কোন অসুবিধা হতো না। যদি রাফি কামাল হতো তাতেও কোন অসুবিধা হতো না। ঘটনাচক্রে ও কাফি কামাল নামটি পেয়েছে। কিন্তু মুল কাফি কামাল কিন্তু এই কাফি কামাল নয়। তার চারপাশে গড়ে ওঠা যে মানুষ সেই মানুষই (ভাবমূর্তি) কাফি কামাল। আমি কাফি কামালকে প্রথমেই অভিনন্দিত করছি। তার প্রথম বই ‘ডলুতীরে টংঘর’, থেকেই সে নিজেকে সনাক্ত করতে চেয়েছে। নিজেকে নিয়ে, নিজের পরিবেশ, মা-দাদিদের কবিতায় তুলে এনেছে। এখন তার জন্মাঞ্চলে বাঘের বসবাস নেই, কিন্তু মানবিক বাঘ তো আছে। সে যে বাঘিনীর কথা বলছে- এ অকৃত্রিম প্রকাশ ভঙ্গির জন্য এ অভিনন্দন।
আমরা সবাই মনে করি গদ্যে কবিতা লিখতে পারাটাই একটি বাহাদুরি। তার কারণ দুইটি। প্রথম কারণ হচ্ছে- অনেকেই গদ্য ছাড়া আর কিছুই জানে না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- পদ্যে কবিতা লিখতে গেলে কিছু কাজ করতে হয়। পদ্যের ভেতর যে একটি ছন্দ আছে। সে ছন্দ যদি জানতে হয়, ভাঙতে হয়। আর ভাঙতে হলেই প্রথাগত ছন্দটাকে জানতে হবে। সে ছন্দ আমরা অনেকেই জানি না। মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, স্বরমাত্রিক, এগুলোর ব্যাপারে আমরা বলি যে এগুলো বাতিল হয়ে গেছে। কেন বাতিল হয়ে গেছে? এগুলো রপ্ত করতে পারিনি বলে। যে মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত রপ্ত করেছে, সে ওই ছন্দে একটি কবিতা লিখতে পারার আনন্দটা অনুভব করতে পারে। ধরুন, মাত্রাবৃত্তে- কবিতা লেখার পর মনে হবে পিংপং বলের মত টুং টাং টুং টাং করে লাফাচ্ছে। উৎফুল্ল হয়ে, মানে ভালবাসা-প্রেমের যে মনোভাব এর ছন্দ হচ্ছে মাত্রাবৃত্ত। স্বরবৃত্তের কবিতা লিখলে মনে হবে- রাস্তায় দাড়িয়ে স্লোগান দেয়া হচ্ছে। আর গভীর কথা, একেবারে কানের কাছে গিয়ে প্রেমিকাকে বলার- ‘তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি, শত রূপে শতবার, জনমে জনমে...’ বা দেখার কথা ‘হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ অথবা ‘তুমি যে তুমি ওগো সে ...’। এটা হচ্ছে বাংলাভাষার চিরায়ত সৌন্দর্র্য্য। এ সৌন্দর্য্য যে জানবে না- আমার ধারণা (বয়স যেহেতু ৬০ পেরিয়ে গেছে তাই বলতেই পারি) কেউ ভাল কবিতা লিখতে পারবে না। বাংলাভাষার ভাল কবিতা সে লিখতে পারবে না অক্ষরবৃত্তের উপর দখল যার নাই। বাংলাভাষার সব ভাল কবির, বড় কবির, প্রধান কবির, তাৎপর্যপূর্ণ কবির, এমনকি বলতে গেলে- যার কবিতা পড়তে ভাল লাগে তেমন কবির কবিতায়ও অবশ্যই অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার আছে। কাফি কামাল ভাল লেখে। তার কবিতায় অক্ষরবৃত্তের নিটোল ব্যবহার প্রথম থেকেই আমি লক্ষ্য করছি। তার যে কবিতার বইটি এখন আমার হাতে (ডলুতীরে টংঘর) তার একটি কবিতা যখন সে পাঠ করছে, তখন মনে হল কি করছে ও? তার কি পতন (ছন্দ) হচ্ছে! কিন্তু কবিতা পাঠ করার পর আমার মনে হয়েছে- আমার ধারণা ঠিক নয়। সে সচেতন না হলেও তার কান সচেতন ছিল। তাই একটি ছন্দের ভেতরে যে নিরীক্ষা, যেটা সহজে কবিরা করে না, সে তাই করেছে। কবিতার নাম ১৪১০। ‘দিনগুলো বড় নির্মম নিশ্চুপ, রাতগুলো ুব্ধ লাঙলের ফলা’। শুনতেই মনে হচ্ছে, এটাকি স্বরবৃত্ত? স্বরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত না হোক মাঝামাঝি ‘স্বরমাত্রিক’ মনে হলো। কবিতার এক জায়গায় ‘পরে শতছিন্ন থামি’ এদিকেও ছয়, ওদিকেও ছয়। অক্ষরবৃত্তে ছয়-ছয় কিন্তু হয় না। আট-ছয় হয়, আট-চার-ছয় হয়। তাহলে ছয়-ছয় দিয়ে সে কি বলছে? তাহলে কি মাত্রাবৃত্ত লিখছে? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে- আসলে এটা অক্ষরমাত্রিক। যেমন আমাদের মন্দাক্রান্তা ছন্দ আছে- ‘তোমাকে ভালবেসে বলতো কি পেলাম, বলতো কি পেলাম তোমাকে ভালবেসে’ এদিকে সাতমাত্রার দোল, ওদিকে ছয় মাত্রার দোল। একমাত্রা যে কোনদিকে কম থাকবে। এদিকে পাঁচমাত্রা হলেও ওদিকে হবে ছয়মাত্রা। রেলগাড়ি ঝমাঝম-এর মতো। জেনে হোক, না জেনে হোক; যেহেতু তার অক্ষরবৃত্তের কানটা ভাল ছিল, মাত্রাবৃত্ত জানাছিল, নিজের অর্ন্তবয়ানে - সে অক্ষরমাত্রিক একটি ছন্দ আবিস্কার করেনি, তবে লিখে ফেলেছে। এটা কারপক্ষে সম্ভব? যে ছন্দ সম্পর্কে মোটামুটি ভাল জানে। এটাও আমি বলব- তার কবিতার জন্য এটা একটা বড় ধরনের সাফল্য।
আরেকটি কথা অনেকেই বলেছেন- তা হচ্ছে ছন্দ। ছন্দ সম্পর্কে কাফি কামালের সচেতনতা অসম্ভব। ফলে সে বাংলাভাষার শব্দকে নতুন করে ভাংচুর করতে চেয়েছে। পাশাপাশি নতুন শব্দ তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন নতুন মাত্রায়। আমরা বলি, কবিতার ভাষাকে পাল্টাতে হবে। কবিতার ভাষাকে কিভাবে পাল্টাবেন আপনি? ‘আমি’র আর কোন শব্দ বাংলা ভাষায় আছে? আমি বলতে হলে আমি ছাড়া অন্য কোন শব্দে আপনি লিখবেন! ‘তুমি’ তুমি ছাড়া অন্য কোন শব্দে লিখবেন। সুন্দরকে সুন্দর ছাড়া মনোহর ... সবই তো জানা ভাষা। আমরা যে বলি, ভাষার নবায়ন আর হয়নি। এর অর্থ কি? এ বিষয়টা বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ভাষা লিখেছেন, নজরুল ইসলাম ভাষা লিখেছেন- ত্রিশের কবিরা ভাষা লিখেছেন। তাদের মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে? নাকি নেই, কি মনে হয় আপনাদের? আমি বলি আছে, শব্দের ব্যবহারে। শব্দের কোন ধরনের ব্যবহারে? ব্যবহারের ধরণটি কি? এটাই তো বুঝতে হবে। ‘বল বীর বল উন্নত মম শির, শির নেহারী আমার নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর’। অনেকেই নজরুলকে যেন তেন মনে করেন। চিৎকারের কবি মনে করেন। তারা কি চিন্তা করে দেখেছেন, ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’- এর মধ্যে ‘বীর’ ‘উন্নত শির’ ইত্যাদি সবই আমরা জানি। কিন্তু এর ভেতর শব্দের দ্যোতনার পাশাপাশি যে চিত্রটা আকা হয়েছে ‘হিমালয়ের সামনে মানুষ নয়, মানুষের সামনেই মাথানত করছে হিমালয়।’ এই যে চিত্রটা, কেমন এ দেখাটা! এ নতুন দেখা যদি না হয়, এ দেখা যদি বর্ণনা না করেন তবে আপনার ভাষা নতুন হবে না। অর্থাৎ এটা দেখতে হলে কি করতে হবে- উৎপেক্ষন করতে হবে। উৎপেক্ষন বলে একটা শব্দ আছে। উৎপ্রেক্ষা মানে ভেতরে-বাইরে ভালভাবে দেখা। এখান থেকে যে শব্দটি এসেছে বাংলাভাষায় যা হচ্ছে- উৎপ্রেক্ষা। ইংরেজিতে মেটাফর। একটা জিনিষের সঙ্গে আরেকটি জিনিষকে তুলনা করা নয়, একেবারে অভিন্নভাবে প্রমাণ করে দেয়া। যেমন, কাফি কামালের ‘দিনগুলো বড় নির্মম নিশ্চুপ’। এখানে সে বলতে পারতেন ‘দিনগুলো নির্মমের মত, নিশ্চুপের মত’। কিন্তু তা না বলে এ দিন মানেই ‘এটা নির্মমতা, এটা নিশ্চুপতা’। ভাষা পাল্টে যায় মুলত এ একটি কাজের জন্য, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে। এ জন্যই বড় কবিরা বলেছেন- যেমন, জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- উপমাই কবিত্ব। তুমি যদি নতুন উপমা দিতে না পার তবে তুমি নতুন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। নতুন উপমা দিলেই তোমাকে নতুনভাবে দেখতে হবে। একটির জন্য আরেকটি মিল যা প্রথাগত, সে তুলনাকে কোথাও ভাংচুর করে নিতে হবে। যেমন, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। খুবই ভাল একটি উপমা। তবে এটা প্রথম বলেছিলেন শেখ সাদি। আমরা জানি, সুকান্তের কথা। যাহোক, জেনে বা না জেনে সুকান্ত সেটা শেখ সাদির কাছ থেকে নিয়ে ভাংচুর করেন। তার যে বর্ণনাটা পাল্টে দেয়া, এ কাজটি করেছেন বলেই সুকান্তের ভাষা কিন্তু নতুনত্ব পেয়েছে।
কাফি কামালের কবিতায় রূপ সচেতনতা স্পষ্ট। তার কবিতায় সহজ-সরল বিবরনমূলক উচ্চারণের চেয়ে, অঙ্গিকারের চেয়ে; আলঙ্কারিক রূপক-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার প্রধান্য পেয়েছে। আমার ধারনা এটা একটি প্রক্রিয়া, একটি নিরীক্ষা। কবিতার তার এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হলে তিনি আমাদের সমকালীন বাংলার কবিদের ভেতর একজন আলাদা কবি হয়ে উঠবেন। সেদিন খুব বেশিদিন দূরে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ তার পরবর্তী যে কবিতাগুলো আমি এখানে এসে পড়লাম এবং শুনলাম তাতে দেখা যাচ্ছে, সে যে কোন বিষয়কে কবিতা করে তোলার চেষ্টা করছে। যেমন, কর্মক্ষেত্রে যখন সে বিচরণ করছে, রাজনীতির সংবাদ যখন করতে গিয়ে ভেতর-বাইরের পরিস্থিতি তুলে আনছে কবিতায়। ভাল কবির, বড় কবির লক্ষণ হচ্ছে- যে কোন বিষয়কে কবিতায় পরিণত করতে পারে। সে গুন তার আছে। আমি বলব, তার কবিতার মধ্যে একটা স্পর্ধা দেখা যাচ্ছে। কাফি কামালকে নিয়ে তাই আমি আশাবাদী। এ কবিতার আসরে যাদের কবিতা আমি শুনেছি, আড্ডার কবি হিসাবে অনেকের মধ্যে যে কয়জন তরুণকে পেয়েছে তাদের কবিতা আমাকে আশান্বিত করেছে। কাফি কামাল তাদেরই একজন। আরেকটি কথা বলেই আমি শেষ করব। ম্যাজিক লণ্ঠনের ৩৪৮তম আড্ডা হচ্ছে আজ। তার অর্থ কি? মানে সমকালীন বাংলা কবিতায় পুরোনোদের দিন প্রায় শেষ। শুরু হয়েছে নতুনদের, নতুন শতকের, নতুন দশকের কবির দিন। শুরুতেই নতুনদের অন্যরকম ভাষা, অন্যরকম নির্মাণ, অন্যরকম তৎপরতা দেখছি। আমার মনে হচ্ছে- বাংলা কবিতা অবশ্যই কাফি কামালের মত নতুনদের হাতে সযতœ চর্চিত হয়ে নতুন বাঁক নেবে। আর তাতেই বাংলা কবিতায় একটা জাদুকরি কাণ্ড ঘটে যাবে। জাদুকরি কাণ্ড সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রধান যে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে তা হচ্ছে একটি জাদুকরি বৈঠক। আমরা বলি- ম্যাজিক লণ্ঠন। কবিতা আসলেই ম্যাজিক লণ্ঠন। আজকের আড্ডার কবি কাফি কামালসহ সবাই সে জাদুকরি আলোয় আলোকিত হোন।
২৮শে অক্টোবর ২০১১, ১৩ই কার্তিক ১৪১৮।
ম্যাজিক লণ্ঠনে কাফি কামাল
Click This Link