somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অরন্যে পাখির চোখে-৬: আশ্রয়, গভীর থেকে গভীরে

১১ ই মে, ২০১১ রাত ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গঙ্গারামমুখ থেকে বাঘাইছড়ির রাস্তা ধরে ৭-৮ কিলোমিটার ভেতরে জারুলছড়ি। রাস্তাটি নতুন হয়েছে। এখনও কাজ চলছে। তো সে আকাবাকা সরু রাস্তা ধরে একের পর এক বিপজ্জনক বাঁক পেরিয়ে এক জায়গায় গিয়ে আমাদের চোখ থমকে গেল। জারুলছড়ির কয়েকটি পাহাড়ী দোকানের সামনে পুটলীসহ অবস্থান করছে একদল পাহাড়ী। আমাদের গাড়ি দেখেই তারা দ্রুতবেগে পাহাড়ী পথে বিভিন্ন দিকে চলে যেতে শুরু করল। পরে অম্পিকা চাকমা নেমে বুঝিয়ে বলার পর তারা ফেরত এল। তাদের পেছনে রেখে কিছুদুর যেতেই দেখা গেল একদল পাহাড়ী তরুণ ভলিবল খেলছে। পাহাড়ীরাই পারে এ ধরনের একটি সংকটময় মুহুর্তে নির্বিকার চিত্তে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকতে।
কিছুদুর যেতেই বঙ্গলতলী জঙ্গল। বাঘাইহাট গুচ্ছগ্রামের আতংকগ্রস্ত পাহাড়ীরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। একটি পাহাড়ী দোকানের সামনে দেখা গেল অর্ধশতাধিক পাহাড়ীকে। তাদের কারও কাধে কাপড়ের পুটলি। কারও পিঠে ছোট ছোট শিশু। গাড়িতে বাঙালী দেখেই জঙ্গলের দিকে ঢুকে পড়ে। একজন পাহাড়ীকে বুঝিয়ে বলার পর তারা সেখানে ফিরে আসে। বেশিরভাগই পালিয়ে এসেছেন বাঘাইছড়ি গুচ্ছগ্রাম থেকে। তাদের অনেকেই কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলেন না। আবার কেউ কেউ তাকিয়ে আছেন, সব হারানোর শোকে পাথর হয়ে অবাক দৃষ্টিতে। সবারই একটাই অভিযোগ প্রশাসন তাদের অভয় দিতে পারছে না। আর সেনাবাহিনীর প্রতিই তাদের সবচেয়ে বড় অবিশ্বাস। সেখানে শান্তিমনি চাকমা, ওম্পিকা চাকমাসহ বেশ কয়েকজন এ অবিশ্বাসের কথা জানাল। তাদের কাছে খোঁজ পাওয়া গেল আর দুই কিলোমিটার ভেতরে বঙ্গলতলির বটতলীতে আশ্রয় নিয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক পাহাড়ী। দেখা গেল, রাস্তার একটু ভেতরে খোলা আকাশের নিচে মশারী টাঙিয়ে বসবাস করছেন কয়েকটি পরিবার। মাটির নতুন গর্তে রান্না করছেন পাহাড়ী সব্জি আর বুনো শাক। সেখানে কথা হয় গৌরবষ্যি চাকমা (৬০) ও পত্যাধি চাকমা (৭০) নামে দুই বুড়োবুড়ির সঙ্গে। তারা জানান, ভয়ের কারণে নিজেদের পুড়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। গৌরবষ্যির স্ত্রী সেদিন পালাতে গিয়ে পা পিছলে আহত হয়েছেন। তাদের পাশে কাপড়ের পুটলিসহ বসে আছেন আরও দুই বুড়োবুড়ি। একটু দূরে সুখীসোনা চাকমা (৩০) নামে একটি মেয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। বিমল চাকমা নামে একজন জানালেন গর্ভবতী সুখীসোনার কয়দিন পর সন্তান হবে। অথচ তাকে এ অনিশ্চিত জঙ্গলের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। বঙ্গলতলীর বটতলীতে পালিয়ে যাওয়া পাহাড়িদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ছুটে এলেন পাশের পাহাড়েই আশ্রয় নেয়া সাজেক ইউনিয়নের (৪-৫-৬) ওয়ার্ডের নির্বাচিত মহিলা মেম্বার স্বপনিকা চাকমা। নিজে একজন নির্বাচিত মেম্বার হয়েও গুচ্ছগ্রামে নিজের বাড়িটি রা করতে পারেননি। এখন সেনাবাহিনী ও বাঙালীদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গভীর জঙ্গলে। প্রশাসনের সহযোগীতা চেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি কেঁদে ফেলেন। জানালেন, প্রশাসনের সহযোগীতা পেলে কি তিনি এ জঙ্গলের মধ্যে কি আনন্দে হাওয়া খাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন!
বিবেকবান মানুষের উদ্দেশ্যে তার প্রশ্ন- আমার বাড়ির একশ গজের মধ্যে সেনা ক্যাম্প। তাহলে সেখানে সন্ত্রাসী থাকে কি করে আর তারা আগুনও দেয় কি করে? সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আগুন লাগার সময় মুহুমুর্হু গুলি হয়েছে। কারও দিগি¦দিক জ্ঞান ছিল না। সবাই যে যেদিকে পারে সরে গেছে। নিহত বুদ্ধপুদি মৃত্যুর কিছুন আগেও আমার সঙ্গে গল্প করেছেন। আমাকে ভাবি বলে ডাকতেন। এখন তার ছবি চোখের পর্দা থেকে সরছে না। আমাদের প্রশ্ন পাশে সেনাক্যাম্প থাকা অবস্থায় গুলি করল কারা? তবে এটা বুঝতে পারছি যে, বাঘাইহাট থেকে গঙ্গারামমুখ হয়ে বাঘাইছড়ির নির্মানাধীন রাস্তার দুইপাশে কোন পাহাড়ীকে থাকতে দেয়া হবে না। কারা থাকতে দিতে চায় না সেটা বলতে পারব না। জানি না, কবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে আর কবে বাড়ি ফিরতে পারব।
কথা বলতে বলতেই সেখানে এলেন নিহত বুদ্ধপতির ছোটভাই বুদ্ধরঞ্জন চাকমা। বোনের মৃত্যু ও সেদিনের কথা বলতে বলতে বারবার চোখ মুছছেন। কথা বলতে বলতেই সেখানে তাদের জন্য রান্নাকরা ভাত বেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন এক গৃহকর্ত্রী। মৃদু অসম্মতি জানাতেই অভিমান কর তিনি বললেন, আমরা পাহাড়ী তাই খাবেন না তাই না? এ জিজ্ঞাসার পর আর কথা থাকে না। আমরা সেখানে সব্জিও একটি মাছের টুকরো দিয়ে পাতের ভাতগুলো খেয়ে নিলাম। তবে মনের মধ্যে খচখচানি চলছে। শেষে পূর্ণিয়া একটি ৫০০টাকার নোট দিতে চাইলেও তিনি রাগ করলেন। বললেন, মেহমানের কাছে টাকা নেব? সেখানে বেশকটি ছবি তোলার পর ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। জারুলছড়ি আসতেই আমাদের গাড়ি দাঁড় করালেন পাহাড়ীরা। ইতিমধ্যে সেখানে আমাদের জন্য শুটকি ও অন্য একটি সব্জিসহ উন্নত পাহাড়ী জাতের চালের ভাত রান্না করা হয়েছে। পাহাড়ীদের জোর জবরদস্তি ও ুধায় ১৫ মিনিটের মাথায় আমরা সেখানে দ্বিতীয়বার ভাত খেলাম। আমরা যখন গঙ্গারামমুখ ফিরছি তখন সূর্য পাটে বসেছে। হিংসা আর অবিশ্বাসের আগুনে পুড়ে বাঘাইছড়ির সবুজ অরণ্য এখণ বিরানভূমি। ছাই উড়া সে বিরান পাহাড়ে গোধুলীর রেনুগুলো খেলছে বড় অদ্ভুত মন্তাজে!

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×