অরণ্যে পাখির চোখে-৫: মৃত্যু উপত্যাকা
২৬ শে ফেব্রুয়ারী ২০১০। বাঘাইহাট বাজারে ঢুকেই দেখা গেল থমথমে পরিস্থিতি। দোকানপাট বন্ধ। দুইএকজন বাঙালি বন্ধ দোকানের সামনে বসে গুমড়া মুখে আড্ডা করছে। খোলা দোকানগুলোর সামনে জড়ো হয়েছেন বাঙালীরা। বাজারে হাতের ডানপাশে ছোট্ট একটি খাল। খালের পূর্বপাড়ে পাহাড়ীদের একটি গুচ্ছগ্রাম। সাজানো-গোছানো সে গুচ্ছগ্রাম এখণ বিরানভূমিতে পরিণত। সেখানে পোড়ানো হয়েছে প্রায় শতাধিক ঘর। ওই ঘটনার দিন গুলিতে নিহত হয়েছে লীবিজয় ও বুদ্ধপুদি নামে দুই পাহাড়ী। এর মধ্যে বুদ্ধপুদি নামের মেয়েটি খাল থেকে পানি আনতে গিয়ে গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। পুরো গ্রামের দিকে তাকালে পোড়া বাড়ির দগ্ধ খুটি আর পোড়া টিন ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। পুড়ে গেছে বাড়ির পাশের নানা ফল-মূলের গাছও। গাছে কলার ছড়া কোনটি পুরো আর কোনটি অর্ধেক, গাছের নারকেল ও পেপে পুড়ে গেছে। সেখানে বিরাজ করছে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। পুড়েছে কয়েকটি বাঙালী ঘরও। ভয়ার্ত পাহাড়ীরা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সেখান থেকে ৮-১০ কিলোমিটার ভেতরের পূর্বজারুলছড়ি ও বঙ্গলতলির গভীর জঙ্গলে। অন্যদিকে বাঘাইহাটের প্রাইমারী স্কুল ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল কয়েকটি বাঙালী পরিবার। তবে তারা সে আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন কাজের খোঁজে। খোঁজাখুজি করেও তাদের সাাত মেলেনি।
বাঘাইহাট ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই মৈত্রীপুর বনানী বনবিহার। রাস্তা থেকে একশ মিটার দুরে এ বৌদ্ধ বিহারটি অঞ্চলের সবচেয়ে বড়। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিহারের বড় বড় ৬টি ঘর। ২ থেকে ৬ করে এ বাড়িগুলোর পাঁচটিই থাকতেন ভিু ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাওয়া শ্রমনরা। ভেঙে ফেলা হয়েছে বিহারের আলাদা কাঁচঘেরা মন্দিরের জলবুদ্ধ বা উপগুপ্তের মুর্তিটি। পোড়া বিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে উকি দিচ্ছে আরও কয়েকটি ভাঙা বৌদ্ধ মুর্তি। একটি ঘরে শ্রমনদের খাবারের জন্য রাখা ধানগুলো পুড়ে গেছে। তখনও ওড়ছে ধোঁয়া। পড়ে আছে পানি তোলার কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি দামি পানির পাম্প। আরেকটি ঘরে সিঙ্গার সেলাই মেশিন। আরেকটি ঘরে শ্রমনদের ব্যবহৃত শতাধিক মগ, বাসন ও বেশকিছু পোড়া হাড়িপাতিল। ঘটনার পর বিহার ছেড়ে চলে গেছেন ভান্তে পূর্ণমাছ ও শ্রমনরা। সেখানে কোনটি কি ঘর সেটা দেখিয়ে দিতে গিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন বেশ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ী। উপগুপ্তের মুর্তির পাশে একটি সাইনবোর্ডে চাকমা আদলে বাংলায় লেখা রয়েছে- নংটা মনে ফুল শিরবেন না (অপবিত্র মনে ফুল ছিড়বেন না)। অথচ পাশের মুর্তিটিই ভেঙে ফেলা হয়েছে অপবিত্র মনে। সেখানে পুর্ণিয়া ও জুবেরীর সঙ্গে আমি নিজেও কিছু ছবি তুললাম। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। মানুষ যখন ক্রোধে বিবেকহীন হয়ে পড়ে তখনই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। মন খারাপ হয় এ জন্য যে, আবহমানকাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী বৃহত্তর চট্টগ্রামে অবশেষে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই আগুন। ছবি তুলতে তুলতে দেখি একটি পোড়াবাড়ির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আধপোড়া ধোয়া ওঠা ধানের মধ্যে পানি দিচ্ছে সালাম। তখন আমি বললাম, যারা এ অপকর্ম করেছে মৃত্যুর পর পরজগতে স্রষ্টা নিশ্চয় তাদের উপোস রাখবেন। আমরা বিহার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ওঠতেই একটি গাছে সাদারঙের খুব সুন্দর থোকা থোকা ফুল দেখে ভোরের কাগজের প্রতিনিধির কাছে জানতে চাই- কি ফুল। হেসে বললো- এটিই বান্দরওলা ফুল। বান্দরওলা নিয়ে অনেক হাসির গল্প প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। তবে কোন রাশভারী লোককে অপদস্ত করে দুষ্ট ছেলেরা এর ফলের ব্যবহার করে।
কিছুদুর যেতেই গঙ্গারামমুখ সেনা জোন। গঙ্গারাম ও নন্দরাম নদীর মোহনাই গঙ্গারামমুখ। দুই নদী এখানে থেকে কাসালং নদী নামে বয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর নন্দরাম ও গঙ্গারাম সংযোগস্থলে কাসালং ব্রীজ। ব্রীজের দনিপ্রান্তে সেনাবাহিনীর বাঘাইহাট জোন আর অপরপ্রান্তে গঙ্গারামমুখ দোরপাড়া। যেখান থেকে ডানদিকে চলে গেছে বাঘাইছড়ির রাস্তা। সেখানেই ঘটেছে এবারের আগুনের সূত্রপাত। ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা অনেকগুলো ছবি তুললাম। একটি পাহাড়ী ছেলে আনাড়ি হাতে আমার কয়েকটি ছবি তুলে দিল। ব্রীজ পেরিয়ে প্রথম বাড়িটিই ভস্মিভুত। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কি যেন খোঁজছে একটি শিশু। চোখ মুছে তাকে সেখান থেকে ডাকলেন তার মা। ব্রীজ ছাড়িয়ে সামনে যেতেই কয়েকটি ঘরের সামনেই বসে থাকতে দেখা গেল- শিশুসহ কয়েকজন পাহাড়ি নারীকে। তারা প্রত্যেকেই বসে আছেন ত্রানের আশায়। বাসন্তি চাকমা, হালাবি চাকমা, আরতি চাকমা নামে তিন পঞ্চাশোর্ধ পাহাড়ী নারী। তাদের ঘিরে বসে আছে বেশ কয়েকটি শিশু। পাশের ঘরের সামনে শান্তি রানী চাকমা ও চাত্তিরানী চাকমা। দুইজনের সঙ্গে তিন-চারটি করে শিশু। নিজের ঘরের সামনেই একা একা বসে আছেন প্রিয়রানী চাকমা ও সুচিরানী চাকমা নামের দুই ত্রিশোর্ধ নারী। তাদের প্রত্যেকের গল্পই একরকম। সারাদিনের কাজের কান্তিতে সেদিন প্রত্যেকের চোখে ঘুম নেমে আসছে মাত্র। এমনিতেই বিদ্যুৎ সংযোগবিহীন এ অঞ্চলে সন্ধ্যার পরপরই নেমে আসে ভুতুড়ে অন্ধকার। রাত নয়টার দিকে হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠলো ইউনিসেফ স্কুলের পাশের সমদিনী চাকমার (৫২) বাড়ি। এরপর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একে একে আগুনে পুড়ে গেল ৩৬টি ঘর। ভস্মিভুত পাশের ইউনিসেফ স্কুলটিও।
দেখা গেল, একটি পোড়া খুটিতে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সমদিনী। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই চোখ মুছে নিলেন। জানালেন, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে তার বাড়িতে আগুন দেয়ার মাধ্যমে সেখানে আগুন দেয়ার সূত্রপাত করে নতুন সেটেলাররা। তিনি পাশের টিলার ভস্মিভুত বাঙালী ঘরটি দেখিয়ে দিয়ে অভিযোগ করেন, ওই জমি নিয়েই তার সঙ্গে বিরোধ চলছিল নতুন সেটেলারদের। তিনি জানান, আগে সেখানে ছিল একটি বিহার। জগাসিদ্ধি নামে এক বড় ভান্তে সে বিহারে থাকতেন। তবে পরে সেটি সরিয়ে ফেলা হয়। কয়েক বছর আগে বাঘাইছড়ি রোড তৈরিকে কেন্দ্র করে সেখানে কয়েকজন বাঙালী থাকতেন। তারা পরে ওই টিলাসহ আশপাশের জমি দখল শুরু করলে বিরোধ দেখা দেয়। এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেটেলাররা তাদের বাড়িতে আগুন দেয়। বৃদ্ধা সমদিনীর মতে, নতুন রাস্তাকে কেন্দ্র করে সেখানে পাহাড়ীদের সরিয়ে সেটেলারদের প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী প্রশাসন। সমদিনী চাকমার সঙ্গে ছবি তুললাম। তখন আশপাশের আশ্রয়হীন মানবসন্তানগুলো করুণ নয়নে আমাদের দেখছিল। সেখানে যাওয়ার পর আমরা রীতিমত হতবাক হয়ে পড়ি। তবে ব্রীজের দনিপ্রান্তে সেনা কার্যালয় ঘেষা দুইটি বাড়ি রা পেয়েছে আগুন থেকে। এদিকে গঙ্গারামমুখ থেকে বাঘাইছড়ির রাস্তার মুখে যাত্রী চাউনিতে স্তুপ করে রাখা হয়েছে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা ত্রান সামগ্রী। কোন পাহারা নেই অথচ পাহাড়ীরা কেউ সেখানে হাত লাগাচ্ছে না।
তবে নিজেদের বাড়ি আগুনে পোড়ার পর ুব্দ পাহাড়ীরাও পুড়িয়ে দিয়েছে বাঙালী সেটেলারদের কয়েকটি বাড়ি। সেখানে বাঙালীদের কাউকে পাওয়া যায়নি। গঙ্গারামমুখ থেকে ডান দিকে নির্মানাধীন বাঘাইছড়ির কাচা রোড ধরে সামনে কয়েক কিলোমিটারও রাস্তার দুইপাশে পুরোনো চিত্র। এক জায়গায় আগুনের ছড়িয়ে পড়ে পুড়ে গেছে সৃজন করা একটি সেগুনবাগান। গঙ্গারামমুখ থেকেই আমাদের সঙ্গি হয় সাজেক নারী সংঘের আহ্বায়ক অম্পিকা চাকমা। তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন- পাহাড়ীরা যেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সে গহীন অরণ্যে। গঙ্গারামমুখের ইউনিসেফ স্কুলে শিকতা করেন এ সাহসিনী। স্কুলটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সর্বত্র বয়ে গেছে হিংসার দাবানল। কোথাও ৮-১০টি একত্রে, কোথাও বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বংসস্তুপ। বিশেষ করে বাঘাইবাজার গুচ্ছগ্রাম, গঙ্গারামমুখ, মৈত্রীপুর বনানী বনবিহার, শুকনাছড়া, এমএসএফ পাড়া, সীমানাছড়ার দৃশ্য অবর্ণনীয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১১ রাত ৮:৫৪