somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অরণ্যে পাখির চোখে-৪: রিরংসার উৎসের খোঁজে

১৯ শে মার্চ, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অরণ্যে পাখির চোখে-৪: রিরংসার উৎসের খোঁজে
২৬ ফেব্র“য়ারি একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠলাম। নাস্তা করতে বেরুতেই পূর্ণিয়া আর জুবেরী বললেন, তারা সাজেক যাচ্ছেন। আগের রাতেই তারা পরিকল্পনা করে রেখেছেন। সাজেক হচ্ছে- রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। ওপারেই মিজোরাম। আর সাজেকের পথেই বাঘাইছড়িতে আসল সহিংসতার ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শন করা। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম- আমিও তাদের সঙ্গে আছি। দূরের পাহাড়ী দূর্গম পথ, তাই দিনে দিনে ফেরা কঠিন। আমরা একটি রাত সেখানে কাটাব। এ জন্য কিছু বাজারও করা হয়েছে। ১২টার দিকে শহর থেকে সাজেকের দিকে রওনা দিলাম। শাপলা চত্ত্বর থেকে ডিসি অফিসের পাশ ঘেষে দীঘিনালার দিকে চলে গেছে সাজেক রোড। যতই যাচ্ছি ততই কৌতুহল বাড়ছে। শহর ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই হাতের বামপাশে হর্টিকালচার ইন্সটিটিউট। ইতিমধ্যে আমার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। কেমন বমি বমি ভাব হচ্ছে। সাধারণত জার্নিতে আমার এ ধরনের পরিস্থিতি হয় না। হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ ঠেকছে। কিছুদূর যেতেই আর্মার যৌথফার্ম। ডান পাশে অদ্ভুত সুন্দর পাহাড়ী দৃশ্য। কাছেই একটি সেনা ক্যাম্পের চিহ্ন। কিছুদিন আগে সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আবার আকাবাকা-উচুনিচু পাহাড়ী পথ চলা। চালক এ ধরনের পথে নতুন হলেও ভালই ড্রাইভ করছে। কিছুনের মধ্যে জামতলী আনসার ক্যাম্প পার হয়ে আমরা পৌছালাম দীঘিনালা বাজার। সেখানে আমাদের জন্য অপো করছেন ভোরের কাগজের প্রতিনিধি। দীঘিনালা নেমেই এক পাহাড়ী দোকান থেকে কয়েকটি কলা ও দুইটি ডাব খেলাম। এতে শরীরটা কিছুটা চাঙা হল। কয়েকটি তেতুলের আচারও নিলাম। তবে আমার মাথাব্যাথার কথা শুনে জুবেরী আর পূর্ণিয়া কেয়ারী ভাঙার (হ্যাঙওভার) জন্য একপেগ মদ খেতে পরামর্শ দিলেন। তবে আমি মদের বদলে ডাবের পানি খাওয়াতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। দীঘিনালা বাজার থেকে দনি-পূর্বদিকে চলে গেছে লংগদু রোড। মোড়টার নাম মারমা মোড়। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে গ্র“প ছবি তুললাম।
একদা এ দীঘিনালা ছিল শান্তিবাহিনীর সবচেয়ে নিরাপদ বিচরণস্থল। লোকজন দীঘিনালার নাম শুনলেই আতকে উঠতেন। ছোটবেলায় বাপ-চাচাদের কাছে কত গল্প শুনেছি। দীঘিনালা থেকে কিছুনের মধ্যেই সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুদূর যেতেই মাইনী নদী। ব্রীজটা পার হতেই বামদিকে উত্তরমুখী চলে গেছে বাবুছড়ার রাস্তার। এ পথেই গভীর পাহাড়ে আবিস্কার হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এবং বিচিত্র .........জলপ্রপাতটি। তবে আপাতত সেদিকে নয়, আমাদের যাত্রাপথ নির্দিষ্ট। পূর্ব দিকে একটু পরেই কবাখালী পেরিয়ে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প। পাশেই একটি হেলিপ্যাড। ক্যাম্পের সামনে অনুমতির জন্য কিছুন দাঁড় করিয়ে রাখা হল। ইত্যবসরে আমাদের প্রত্যেকের নাম ও ঠিকানা খাতায় টুকে নিলেন দুই জওয়ান। খাগড়াছড়ি থেকে রওনা দেয়ার আগেই জুবেরী তার এক সহকর্মীর মাধ্যমে একজন ঊর্ধতন সেনাকর্মকর্তার সহযোগীতায় অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন। তবে সে মেসেজ পেতে কিছুন সময় লাগল। তাদের অনুমতি পেয়ে আমরা নতুন উদ্যোমে ছুটে চললাম। অল্পখানি এগোতেই হাতের ডানদিকে চলে গেছে মারিশ্যা রোড। মারিশ্যা বাঘাইছড়ির একটি বিখ্যাত বাজার।
এবার শুরু হলো- ধ্বংসস্তুপের দেখার পালা। রাস্তার পাশে থেকে থেকেই আগুনে পোড়া বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। বাঘাইবাজার পূর্বপাড়ায় রবিকা চাকমা নামে এক মহিলাকে দেখা গেল শিশুকোলে দাঁড়িয়ে অপো করছে। মুখে ুধার ছাপ। গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুলতে গেলেই আগুনে পোড়া পশুর গন্ধে বমি আসতে চায়। সেখানে তিগ্রস্ত পাহাড়ীদের তালিকা করছিলেন এমএসএফ পাড়ার গোবিন্দ কার্বারী (৫৫)। হিংসার আগুন থেকে রা পায়নি তার ঘরটিও। জুবেরী রবিকার শিশুটি কোলে নিয়ে দাড়াতেই আমি তাদের ছবি তুললাম। শিশুটি জুবেরীর গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে চুপ করে আছে। কোন কান্নাকাটি নেই, উদ্বেগ নেই। বাঘাইবাজার পূর্বপাড়ায় রাস্তার দুইপাশে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ৮টি ঘর। চারপাশের পাহাড়গুলোতেও পোড়া ঘরের ধ্বংসাবশেষ। একটি ধ্বংসস্তুপের সামনে এক বছরের ছোট্ট শিশু হৃদয়কে নিয়ে ত্রান সংগ্রহে যাওয়া স্বামীর অপোয় বসেছিলেন রবিকা চাকমা (২৫)। জানালেন, ২০ ফেব্র“য়ারি দুপুরে অপরিচিত কিছু বাঙালী পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িগুলো। এরপর আতংকে পাহাড়ের আরও গভীরে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেছেন। দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। প্রথম তিনদিন কাচাকলা আর পাহাড়ের এটা-ওটা খেয়ে কেটেছে।
সামনে এগোতেই দেখা হল একদল পাহাড়ীর সঙ্গে। গাড়ি দেখেই তারা লুকাচ্ছিলেন পাহাড়ের ঝোঁপে। পরিচয় দিয়ে ডাকতেই সামনে আসেন ভয়ার্ত মুখগুলো। ভাইবোন ছড়ার খিনচং চাকমা (৫০) জানান, ১৯ ও ২০শে ফেব্র“য়ারি তাদের পাড়ায় আগুন দেয়া হয়। এরপর দুইদফা ত্রান হিসেবে যা পেয়েছেন তা দিয়ে তাদের ৭ জনের সংসারে দুইদিনও কাটেনি। এখন ছোট ছেলেটি জ্বরে ভুগলেও আতংকের কারণে বাঘাইবাজারে যেতে পারছেন না। কিছুদূর যেতেই লাদুমনি বাজার। বাড়িয়ে বললে বাজার অন্যথায় কয়েকটি পাহাড়ী দোকান। জুবেরি জানাল, এ বাজার নিয়েই বেধেছে জটিলতা। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে লাদুমনি চাকমাকে হত্যা করে বাঙালীরা। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এক ধরনের চাপের মধ্যে রাখা হয় পাহাড়ীদের। এক ধরনের ভয় ও নির্যাতনের মধ্যেই কেটেছে পাহাড়ীদের সে সময়। পরে লাদুমনির জমি দখল করতে চাইলে যুগ যুগের নির্যাতনে ফুসে ওঠে পাহাড়ীরা। নির্যাতনের ভয়ে পাহাড়ি পুরুষরা সংগঠিত হতে না পারলে এক পর্যায়ে মেয়েরা সে ভূমিকা নেয়। তারা প্রতিষ্ঠা করে সাজেক মহিলা সমিতি। এরপর তারা নির্যাতনের প্রতিবাদে বাঘাইহাট বাঙালী অধ্যুষিত বাজার বয়কট করে। তারই সূত্র ধরে সহিংসতা।
লাদুমনি বাজার পেরুতেই সেনা ক্যাম্পের ৫০ মিটারের মধ্যেই এমএসএফ কিনিক। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে পাহাড়ের অন্যতম আধুনিক কিনিকটি। ৮-১০টি বাড়ির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত কিনিকের ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। সেখানে ছবি তুলতে গিয়ে দেখি পুড়ে যাওয়ার বাড়ির মধ্যে চিউক-চিউক ডাকছে কয়েকটি মুরগীর বাচ্চা। গৃহপালিত এ মুরগীর বাচ্চাগুলোর আর্তনাত দেখে নিজেকেই খুব ছোট ছোট মনে হয়। বাঘাইবাজারের কিছু আগে হল্যাণ্ডের অর্থায়নে পরিচালিত এমএসএফ-এর কিনিকটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কিনিকে রোগীদের আবাসিক রুম, প্যাথলজি, চিকিৎসক ও নার্স রুম এবং স্টাফ কোয়ার্টারসহ ৬টি টিনশেট সেমিপাকা ও বেড়ার ঘরের একটিও অবশিষ্ট নেই। আগুন লাগার এক সপ্তাহ পরও সেখানে পুড়ে যাওয়া মেডিসিন বক্স থেকে ওড়ছিল ধোঁয়া। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কিনিকের নানা চিকিৎসা সরঞ্জামের ভস্ম। দূর্গম পাবর্ত্য অঞ্চলের এ কিনিকটি পুড়িয়ে দেয়ায় মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে পাহাড়ীরা। গোবিন্দ কার্বারী জানান, ১৪৪ ধারা জারি করার পরই পোড়ানো হয়েছে এ কিনিক। আগুনে পুড়ে গেছে কিনিকের চারপাশে গাছের কলা, পেপেসহ নানা ফল। আমি যখন সে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে হাঁটাহাটি করছি তখন সালাম আমার সাহসের প্রশংসা করছে। আর আমি মনে মনে আমার স্বজাতি ভাইদের হিংস্র মানসিকতার কথা চিন্তা করে আপসোস করছিলাম। আমার মাথায় আসছে না, কিনিকের মত একটি নির্দোষ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান কেন অপরাধের আগুনে পুড়বে?

৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×