স্বাধীনতা তুমি
বর্ষার জল খুব তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যাচ্ছে। আর বেড়ে চলেছে মুক্তিফৌজের হামলা! রাজাকার আর পাকবাহিনীর রাতের ঘুম হারাম। কবর খুঁড়ে তার চারিদিকে বালির বস্তা রেখে, লোহার টুপি পরে, বাহিরের দিকে বন্দুক তাক করে সারারাত কার ভয়ে জেগে থাকে ওরা! পালদের পাকা দালান ছাড়া বাদবাকি ঘরগুলো, রাজাকাররা নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেছে। দুর্গের মত দালানটাই এখন পাহারার বস্তু।
মা যেন দিন দিন বদলে যাচ্ছে! মাঝে মাঝে বমি করে! শোক, লাজ, ভয় অহর্নিশি সঙ্গী বলেই বোধ হয়, অপ্রয়োজনীয় আবর্জনার মত শরীরের স্বাভাবিক কৌমার্য ঢেকে দেয়। অনাকাংখিত আগাছায় শরীর ভারী হয়।
একদিন হঠাৎ মায়ের বমির মত, আকাশ থেকে পড়ে ঠাডা। পাল বাড়ির উঠোনে পুকুরের মত বিরাট একটা গর্ত হয়ে গেল। খান সাহেবেরা পাগলের মত, মুখের কাছে কী একটা বাক্স এনে কথা বলছে। ভোরের স্নিগ্ধতা কাটিয়ে সূর্য খরতাপের পৌরুষে দীপ্ত হচ্ছে। গুলির মালা গলায় আর রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে, রাজাকারদের হাতে ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে, পাকবাহিনী পলায়ন করছে! রাজাকার ভাইয়েরা রাজ বেশ রেখে, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে, পাকবাহিনীর একটু পরেই, গা ঢাকা দিলেন।
খোলায় মায়ের খই ভাজার মত, গুলির শব্দ। নতুন দিনের তোপধ্বনিতে কান জ্বালাপালা। কৌতূহলী শেরালী সবকিছু দেখতে চায়! মায়ের বাহুবন্ধন থেকে মুক্তির উপায় নেই।
গর্তে লুকিয়ে থাকা কালসাপের ছোবল থেকে রক্ষা পেতে, বেয়নেট লাগানো রাইফেল তাক করে ঘিরে রেখেছে, বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা, আমাদের আশ্রয় নেওয়া বালির বস্তাবেষ্টিত, কবরটি। সাহসী মানুষটি মায়ের জবুথুবু অবস্থা আবিস্কার করে একটু অস্বস্তিই বোধ করল! দীপ্তকন্ঠে বললেন: তোমার ভয় নেই মা।
এতদিন মা এই কান্না কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন! শাশুড়ি ননদিনীর জ্বালায় অতিষ্ট বধু ভাইয়ের দেখা পেয়ে যেন, সব ব্যথার পূজা আগে সেরে নিচ্ছে! পালদের বাড়িতে পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র আর গোলাবারুদ পাহারা দিতে তিনজন মুক্তিসেনা রয়ে গেল। অনেকদিনের, ঘর বোলানো সুরের সাধকদের, সবকিছু, সাধনার তীব্রতায় মলিন। আপাতত তাদের পেটপূজার আয়োজনে, মায়ের অঞ্জলি নিবেদনের শাঁখাহীন হাত দুটি ব্যস্ত।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১:১৩