সবার আগে আসি যে, বিশ্ববিদ্যালয় আসলে কি ... প্রাচীনকালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোন ইন্সটিটিউট সমাজে ছিল না ... সেই হাজার বছর আগে সক্রেটিস, এরিস্টটল বা ডারউইনদের যুগে, উনাদের মত পণ্ডিত ব্যক্তিদের লোকে সম্মান করত ... অনেকেই তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করত ... উনারা দিনের কিছু সময় শিষ্যদের জ্ঞান বিতরণ করতেন বা শিক্ষা দিতেন ... আর বাকি সময়টা নিজ নিজ গবেষণায় ব্যস্ত থাকতেন ...
.
এই ধারণাই আধুনিক কালে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার জন্ম দেয় ... শুধু ছাত্র পড়ানো যেমন, সেই সব প্রাচীন পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল না ... ঠিক সেই রকম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কিনতু শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে গ্রাজুয়েট, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা আর সার্টিফিকেট বিতরণ নয় ...
.
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাই হল, বিশ্ববিদ্যালয় গুলো হবে গবেষণার আধার ... অর্থাৎ যে সমস্ত প্রফেসররা সেখানে জব করবেন তাদের প্রধান কাজই হবে, গবেষণা করা ... এটাই তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ আর ছাত্র পড়ানোটা তাদের দ্বিতীয় প্রধান কাজ ...
.
আমাদের আধুনিক কম্পিউটিং থেকে শুরু করে চিকিৎসা, প্রকৌশল সব কিছুর পেছনেই আছে কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বা গবেষকের গবেষণা … যেমনঃ ইমেইল আদান-প্রদানে ওয়েব সার্ভারে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় MTA গুলোর অন্যতম EXIM, Cambridge University এর গবেষণা ল্যাবরেটরিতে উন্নয়ন করা …
.
C যাকে বলা হয় Father of all Programming Languages … সেই C এর জনক Dennis Ritchie ছিলেন Harvard University এর প্রফেসর …
C++ এর জনক Bjarne Stroustrup প্রফেসর হিসেবে Texas A&M University তে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন ...
.
যে Android … Android আর Android Apps করতে করতে আমরা মুখে ফেনা তুলি … সেই Android যে Linux Kernel এর উপর বেজ করে ডেভেলপ করা … সেই Linux Kernel, University of Helsinki এর এক ছাত্রের প্রজেক্টের ফসল … তা না হলে আজ হয়তোবা আমরা Android ই পেতাম না … এই রকম হাজারটা উদাহরণ দেয়া যায় ...
.
ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাচীন ধারণাকে ধরে রাখলেও ... আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কি তা হচ্ছে ? ... সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা কি করছেন? ...
.
সকালে হাজিরা দিচ্ছেন ক্লাস নিচ্ছেন ... ব্যাস ক্লাস শেষেই কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসালটেন্সি করতে দৌড় দিচ্ছেন ... অথচ নিয়মিত ক্লাস নেবার ডিউটি পালন করার পর কিনতু সেই প্রফেসরের বাকি সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণায় কাটানোর কথা ... তাই নয় কি? ...
.
আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবস্থা আরও করুণ ... ঢাকার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় দেখা যায় নিচে মার্কেট উপর তলায় কয়েক রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ! ... পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় জোক আর কি হতে পারে ! ... এগুলোকে কি আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়? ... এখান থেকে কি গবেষণার মাধ্যমে Postfix MTA বা Linux বা C++ এর পরবর্তী ভার্সনের আপডেটের গবেষণা আশা করতে পারি? …
.
বনানী বা গুলশানের দিকে যান … আপনি দেখবেন আরও ভয়াবহ চিত্র … এক বিল্ডিং এর তিন ফ্লোরে তিনটা বিশ্ববিদ্যালয় … অনেক গলিতে দেখবেন গলির মুখে একটা বিশ্ববিদ্যালয়, শেষ মাথায় আরেকটা আর মাঝে আরও ৪/৫ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের … এগুলো কি আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় ? ...
.
ইউরোপ আমেরিকানরা যদি আমাদের দেশে এসে সার্কাস দেখতে চায় … আমার মনে হয় কোন সার্কাস পার্টির তাবুতে নিয়ে না গিয়ে … তাদের গুলশান, বনানী বা ধানমন্ডির একটা গলিতে এনে ছেড়ে দেয়াই শ্রেয় … সেটা হবে তাদের জন্য বিনা টিকিটে ইউনিক সার্কাস ...
.
বাঙালি কোচিং সেন্টার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে আর কোন পার্থক্য রাখে নাই ... এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসালটেন্সি করা প্রফেসররা এক প্রাইভেটে পড়ানো শেষে আরেক প্রাইভেটে দৌড়চ্ছেন ... দৌড়চ্ছেন বললে ভুল হবে অনেকটা উড়ে উড়ে যাচ্ছেন ...
.
ঢাকা শহরে, ১০ মিনিটের পথ পারি দিতে যেখানে ১ ঘণ্টা লেগে যায় ... সেখানে এই সব কনসালটেন্ট প্রফেসররা মোটামুটি যথা সময়ের মাঝেই ভার্সিটি নামক এক কোচিং থেকে আরেকটিতে হাজির হচ্ছেন ...
.
কিভাবে যাচ্ছেন? ... কোন রকম একটা লেকচার দিচ্ছেন আর ছুটছেন ... টাকার পেছনে ছুটছেন ... ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি নেই তাদের কোন দায়-বদ্ধতা ... মাস শেষে ব্যাংক একাউন্টে কয়েক লাখ টাকা ট্রান্সফার হচ্ছে কিনা সেটাই মেইন ফ্যাক্ট ...
.
এগুলোকে কি আপনি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয় বলবেন ??
.
শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর জাতি গুলোর তালিকা করা হলে আমরা বোধহয় টপ লিস্টেই থাকব ... আবার শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ফালাফালি করা জাতির তালিকায়ও আমরা থাকব শীর্ষে ... ঐ যে কথায় আছে না, যত গর্জে তত বর্ষে না ...
.
এস.এস.সি বা এইচ.এস.সি'র পরীক্ষার পরবর্তী ৭ দিনের পত্রিকা ঘাঁটলেই দেখা যায় শিক্ষা নিয়ে আমরা কতটা ফালাফালি করি ... পৃথিবীর আর কয়টা দেশে পাবলিক স্কুল/কলেজ পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে এত খবর হয় তা আমার জানা নেই ...
.
সেই সাথে রয়েছে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের লুইচ্চামি ... যে পত্রিকাই খুলবেন দেখবে প্রধান শিরোনামের ছবিতে এক ঝাঁক মেয়েদের ছবি ... কেন ভাই?? ... এই দেশে কি ছেলেরা এস.এস.সি বা এইচ.এস.সি দেয় না নাকি? ...
.
শিক্ষাকে আমরা অনেক আগেই জোক বানিয়ে ফেলেছি ... বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে বানিয়ে ফেলেছি মাস শেষে মোটা ফি নেয়া রক্ত চোষা জোঁক নামক কোচিং সেন্টার ...
.
আমাদের দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রয়োজন আছে ... কারণ প্রতি বছর এইচ.এস.সি পাস করা ছাত্র-ছাত্রীদের একটা চুল পরিমাণ অংশেরই ঠাঁই হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ... আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ? ... সেতো আরেক বিভীষিকার নাম ... ৪ বছরের কোর্স করতে কখনও কখনও ৬/৭ বছরও লেগে যায় ...
.
তাই দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনেক ... কিনতু এই সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়া হয় ... এগুলোর টিউশন ফি দেখলে আমি ইংরেজ নীলকর বাবুদের সাথে এদের কোন পার্থক্যই খুঁজে পাই না ...
.
অথচ সরকারের এই সব মনিটর করার একটা বিভাগ আছে, সেই ইউজিসির কাজ দেখলে মনে হয় তাদের যেন একটাই কাজ, বেশ মোটা অংকের ঘুষ নেবার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমিশন দেয়া ... অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকারটা দেখাও যে তাদের দায়িত্বের মাঝে পরে সেটা তারা দেখেও দেখে না ... জেনেও জানে না ...
.
যে সব প্রফেসররা এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকা ওয়াস্তে টিউশন দিচ্ছে তাদের কাজ মনিটর করাও এই ইউজিসির কাজ ... কিনতু তারা তা করছেন কি ? ... আমি যত দূর জানি ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ২ টির বেশি জায়গায় কনসালটেন্সি করতে পারবেন না ... করলে জরিমানা সহ অনেক শাস্তিমূলক বিধান আছে ...
.
কিনতু আমি এখনই এই রকম একটা প্রফেসর লিস্ট দিতে পারব যারা ৪/৫ টি বা ততোধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন ... আর আজ পর্যন্ত ইউজিসি এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কি? ...
.
আপনি হয়ত বলবেন যে কেন ভাই আপনি টাকা ইনকাম করবেন আর তারা ইনকাম করলেই দোষ ? ... না ভাই দোষ নয় ... দোষটা হল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে পুতুল খেলা খেলাটা ... কারণ শিক্ষা এমন কোন টার্ম নয় যে এটা নিয়ে ব্যবসা করতে দেয়া উচিত ... অথচ আমাদের দেশে তাই হচ্ছে ...
.
প্রতি বছর এই সব বিশ্ববিদ্যালয় নামক কোচিং সেন্টার থেকে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার নয় বরং লাখ লাখ শিক্ষিত পঙ্গু বের হয়ে আসছে ... ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখোশ পড়া এই সব কোচিং সেন্টারের সার্টিফিকেট পাওয়া মানে মনে হবে ... আপনি একজন সার্টিফায়েড পঙ্গু লোক ... আর কিছু নয় ...
.
নামকরা প্রফেসরদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে টানার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতাও দেখা যায় এদের মাঝে ... ধরা যাক, একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোন প্রফেসরকে হায়ার করল মাসিক ১ লক্ষ টাকা চুক্তিতে … তখন অন্যজন আবার কোপ মারল আমরা ২ লক্ষ টাকা দেব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন …
.
এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল কিনতু ভোগ করতে হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের ... প্রতিযোগিতামূলক প্রলোভনে টেনে আনা এই সব প্রফেসরদের ... লোভের নেশা মেটাতে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অযৌক্তিক টিউশন ফি ... তার উপর যদি আবার তার উপর ১০% ভ্যাট বসানো হয় তবে অবস্থা কি দাঁড়ায় ?? ...
.
আর প্রফেসরদের দায়িত্বহীন টিউশন-তো রয়েছেই ... একজন প্রফেসর যখন ধানমন্ডির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিচ্ছেন তখন তার মাথায় যদি ঘুর পাক খায় আমাকে ১ ঘণ্টার মধ্যে বনানী গিয়ে আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় লেকচার দিতে হবে ... তাহলে সেই প্রফেসরের কাছ থেকে আমরা কি মানের টিউশন আশা করব? ... তার উপর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বানিজ্যতো বাদই রইল ...
.
শিক্ষা একটা জাতির মেরুদণ্ড আর আমাদের সেই মেরুদণ্ড নিয়েই চলছে পুতুল খেলা ... যেখানে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মাত্র ১৫-২০%ই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় আর সিং ভাগই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল ...
.
তার মানে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই ৮০% কে কি মানের শিক্ষা দিচ্ছি ? ... ধীরে ধীরে আমরা এমন এক জাতিতে পরিণত হতে চলেছি যার কোন মেরুদণ্ড নেই ... তার উপর শিক্ষার উপর ১০% ভ্যাট আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে জোক ছাড়া আর কিছুই নয় ...
এখনই সময় এই সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলার ... এখনই সময় প্রতিবাদের ... নইলে বড্ড বেশিই দেরি হয়ে যাবে ...
ফেসবুকে আমিঃ https://goo.gl/NJFsPu