একসাথে ৫/৬ দিনের বন্ধ পেলেই ব্যাকপ্যক নিয়ে বেরিয়ে যাই পাহাড়ের কোন এক কোণে। এবারের ঈদেও তার ব্যতিক্রম হল না। ৭ জন মিলে বেরিয়ে পড়লাম বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে।
ছোট ছোট মেঘের ফাকে অবিরাম বৃষ্টি চলেই যাচ্ছে। হঠাত এক কোনে কিঞ্চিত সূর্যি মামার হাসি ফুটে উঠে। পরক্ষণের ঝর্ণার কলকলানিতে মুখরিত চারিদিক। ব্যাথা চেপে যাওয়া পায়ে জোকেদের নৃত্য যেন সাধারণ খেলা। ছোট ছোট ঝিরি গুলো স্রোত পাথুরে মৃত্যু কুপে পরিণত হয়েছে। পিচ্ছিল পথের আইল ধরে এগিয়ে যাচ্ছি অজানা এক দিশায়....
বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি রাস্তা গুলো খুব পিচ্ছিল হয়ে যায়, সাথে ঝিরি গুলো হয়ে যায় এক একটা মৃত্যু কুপ। সেতসেতে রাস্তায় বসে জোকেদের মেলা। কিন্তু এই বর্ষাতেই দেখা যায় পাহাড়ের ফাকে ফাকে ছোট ছোট মেঘের আড্ডা, ঝর্ণা গুলোর পূর্ণতা, রোদ বৃষ্টির খেলা ইত্যাদি।
ঈদের ২য় দিন আমরা ৭ জন বের হয়ে গেলাম বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে। বাস আগে থেকেই বুক করা ছিল, তাই টিকেট নিয়ে কোন সমস্যা হলনা।
সকালে বান্দরবান শহর থেকে চান্দের গাড়িতে করে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে রুওনা হলাম। গ্রুপ মেম্বারদের অনেকেই বান্দরবান ১ম এসেছে, তাই বান্দরবান-রুমা/থানচি রাস্তার ২ পাশের দৃশ্য দেখে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আমি শুধু বললাম, “এটাই শেষ নয়, আসল সৌন্দোর্য তো ভেতরে... :।
রুমা বাজার নেমে গাইড ঠিক করে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে বের হতে প্রায় ২টা বেজে গেল। এর মধ্যে বাজার থেকে তেল, মশলা ও যাবতীয় রসদও কেনা হয়ে গেল।
এবারও চান্দের গাড়িতে করে বগালেকের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। রাস্তার অবস্থা দেখে সবাই রীতিমত ভয় পেয়ে গেল। কিছুটা খাড়া আবার ডানে নয়ত বায়ে বাক, কিছু রাস্তা ভাঙ্গা। এভাবেই চলতে থাকল আমাদের গাড়ি। আমি একেবারে সামনে ড্রাইভার এর পাশেই বসেছিলাম তাই দেখতে পেলাম সামনে খুব খাড়া ১টা রাস্তা আছে, যার পুরোটাই ভাংগা। আমি আসলে বুঝে উঠতে পারছিলাম না গাড়িটা কিভাবে ওই রাস্তায় উঠবে!!!
যা ভাবলাম তাই হল...। ৬০ ডিগ্রি(আনুমানিক) খাড়া জায়গাটায় এসে আমাদের গাড়ি আর উঠছে না। পুরো এক্সিলারেটর চেপেও গাড়ি কোন ভাবেই উঠানো যাচ্ছে না বরং আসতে আসতে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। পেছন থেকে অনেকের চীৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি নিজেই ভয়ের মধ্যে ছিলাম। একবার ভাবলাম গাড়ি থেকে নেমে পড়ব কিনা পরক্ষণেই ভাবলাম এটা হয়ত ড্রাইভারদের কাছে সাধারণ বিষয় ঠিক হয়ে যাবে। এই উঠা নামা অবস্থায় প্রায় ১৫ মিনিট প্রচন্ড ট্রাজেডির মধ্যে ছিলাম। তারপর গাড়িটি আমাদের নিয়ে উঠে যেতে সক্ষম হল।
পরে জানতে পারলাম আমাদের গাইড পেছন দিয়ে নেমে গাড়ির নিচে ইট ঠেস দিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল যার ফলেই আমরা বেচে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস আমাদের গাইড টা আগে গাড়ির হেল্পার ছিল। রাস্তার করুণ অবস্থার জন্য গাড়ি বেশী দূর যেতে পারে নি। পরের রাস্তাটুকু আমাদের হেটে যেতে হয়েছিল। ওই দিন সবাই সুস্থভাবেই বগালেক চলে গেলাম তবে তখন প্রায় সন্ধ্যা পড়েগিয়েছিল।
এতটা ধকল এর পর সবাই মিলে লেকে কিছুক্ষণ ঝাপাঝাপি করলাম। পুরানো কিছু ট্রেকার ভাইদের সাথেও দেখে হয়ে গেল। বগালেকের ১টি কটেজে রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। এতটা জার্নির পর সবারই খুব ভাল ১টা ঘুম হল।
সকাল সকাল উঠেই লেকের কিছু ছবি তোলার জন্য চলে গেলাম। এই ফাকে অন্যরাও রেডি হয়ে গেল। খিচুরি আর ডিম দিয়ে সকালে নাস্তা সেরেই বের হয়ে গেলাম চিংড়ী ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।
বর্ষা মৌসুমে ঝর্ণা গুলো তার আপন সৌন্দর্যে জাগরিত হয়ে উঠে যা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। চিংড়ী ঝর্ণাও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে বেশ কিছু সময় পার করে রওনা দিলাম কেউক্রাডং এর উদ্দেশ্যে।
রৌদ্রজ্জল পাহাড়ী ট্রেইল ধরে এগিয়ে যেতে বেশ ভালই লাগছিল। কিছুটা ক্লান্তি, বিশ্রাম, আবার সময়ের কথা ভেবে তাড়া দেয়া, মাঝে মাঝে কিছু মুহুর্ত স্ত্বব্ধ হয়ে দূর পাহাড়ের পানে তাকিয়ে থাকা সাথে ছবি তোলার সেশন তো রয়েছেই । সবমিলিয়ে বেশ উপভোগ্য ১টা ট্রেইল।
৩ ঘন্টা বিশ্রামসহ ট্রেক করার পর আমরা কেউক্রাডং পৌছে গেলাম। কেউক্রাডং থেকে এর আশে পাশের ভিউ গুলো অসাধারণ। এক তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ধরণীকে কতটা বিশাল এবং কতটা সুন্দর করে তৈরী করেছেন তা না দেখে বোঝা সম্ভব না।
কেউক্রাডং এর চূড়াতে বেশ কিছুক্ষণ থাকলাম।
অনেকগুলো ফটোসেশনও হল তারপর আবার রুওনা হলাম সুংসাং পাড়ার উদ্দেশ্যে। এই পথটা কেউক্রাডং থেকে নেমে যেতে হয়। ১টা পথ রয়েছে বেশ খাড়া ভাবে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে।
তবে কেউক্রাডং থেকে সুংসাংপড়ার পুরোটা রাস্তা আমার অনেক ভাল লেগেছে। তাই আমি জোরে জোরে ট্রেক করে সবাইকে পেছনে ফেলে একা এই স্বাদ গ্রহণ করেছি।
জংগলের ভেতর দিয়ে হেটে হেটে এগুচ্ছি সামনের দিকে, পাতার ফোকর দিয়ে মাথার উপর থেকে কিছু আলো এসে পড়ছে মাটিতে। বেশ নিস্তব্ধ পরিবেশ। হঠাত কোন গাছের নিচ দিয়ে কি যেন নড়ে উঠল, কিন্তু তাকাতেই কিছু নেই। পুরোটা মুহুর্ত ছিল বেশ গা ছমছমে। মাঝে মাঝে কিছু কিট পতঙ্গের ম্যাক্রো ছবিও তোলার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম একা একা স্বাদ গ্রহণ করার স্বিদ্ধান্ত নেয়াটা মোটেই ভূল ছিল না। ওতগুলো মানুষ সাথে থাকলে কোনভাবেই এরকম পরিভবেশ পাওয়া যেত না।
অবশেষে সুংসাংপড়াতে পৌছে গেলাম আর সাথে সাথেই ১টা শক খেলাম। এতবড় পাড়া...!!!!!
আমার দেখা বান্দরবানের সবচেয়ে বড় পাড়া হচ্ছে সুংসাং পাড়া। বেশ পরিচ্ছন্ন এই পাড়াটি। এ পাড়ায় বেশ কয়েটি চার্চ রয়েছে ১টি ফুটবল খেলার মাঠও রয়েছে।
এ পাড়াতেই থাকার জন্য ১টা পাহাড়ির ঘরে আমরা উঠে গেলাম। আমাদের সব ব্যাগ গুলো রেখেই আবার রওনা দিলাম ডাবল (তাবলং ঝর্ণা) ফলস এর উদ্দেশ্যে। এবারে বেশ জোরে সোরে শুরু হল বৃষ্টি। আমরা ততক্ষণে পাড়া থেকে অনেকটা পথা চলে এসেছি তাই বৃষ্টিতে ভিজেই সামনের দিকে আগালাম। পাহাড়ের প্রত্যেকটা রাস্তারই আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আমি খুজে পাই এটাও ব্যতিক্রম না। বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তা কাদায় মাখা মাখি অবস্থা। রাস্তায় অনেক গোবর পরে থাকতে দেখলাম, তাই আর বুঝতে দেরি হল না কেন রাস্তাটা এত কাদাপূর্ণ।
কাদাময় রাস্তার পর এবার জুম চাষের রাস্তা ধরে আগাতে লাগলাম। জুমের রাস্তা গুলো খুব সুন্দর হয়। ২ পাশে শস্য আর মাঝে পাহাড়ি ট্রেইল ধরে এগুচ্ছি। জুমের রাস্তা পার হয়ে এবার পেলাম খুব খাড়া ১টা রাস্তা। তার উপর রাস্তা প্রচন্ড পিচ্ছিল ছিল। এই রাস্তা ধরেই আমাদের নিচে নেমে যেতে হবে। নিচ থেকে ঝর্ণার গর্জন বেশ ভাল ভাবেই শুনতে পাচ্ছিলাম।
ফাহিম প্রথমে নামতে শুরু করল। ওর পেছনে আমি ছিলাম। কিছুটা পথা নামার পর ফাহিম খুব বিশ্রী ভাবে পিছলে নিচের দিকে পড়তে থাকে। এই দৃশ্য দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এই বুঝি ফাহিম পাশের খাদে পড়ে গেল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় এ যাত্রায় একটু খানির জন্য বেচে গিয়েছিল। তারপর আমিও নামতে শুরু করলাম। কিন্তু পেছন থেকে কয়েকজন এই রাস্তা ধরে যেতে চাইল না, কারণ রাস্তাটা খুবই রিস্কি। আমিও তাদেরকে জোর করলাম না। যারা যারা যেতে চাইল, তাদেরকে নিয়ে নিচে চলে গেলাম আর বাকীরা সুংসাং পাড়ায় ফেরত গেল।
যতই নামছি ততই ঝর্ণার গর্জন আরো স্পস্টতর হতে লাগল। সবাই দৌড়ে নামতে লাগলাম যদিও রাস্তাটা একটু রিস্কি ছিল। ১৫ মিনিট নামার পর আমাদের কাঙ্খিত ডাবল ফলসে পৌছে গেলাম। সে কি রূপ...!!!! এই রূপ দেখে, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সব কষ্ট এক নিমিষেই ভুলে গেলাম। অনেকটা দূর থেকেও ঝর্ণার পানির আমাদের শরীরে এসে পড়ছিল।
সবাই এখানে নেমে গোসল সেরে ফেললাম। এই ঝর্ণার পানি এতই বেগে পড়ছিল যে, পানির নিচে তো দূরের কথা এর ৫০ গজের কাছাকাছি যাওয়াটাও কষ্টকর হয়ে যায়। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কি? এভাবেই কিছুক্ষণ ঝাপাঝাপি করে উঠে গেলাম।
সুংসাংপাড়াতে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। ফিরেই আমাদের গাইডকে বলে দিলাম রান্না শেষ করতে। আর কিছু মুরগি কিনে নিলাম। আজকে রাতে বারবিকিউ পার্টি হবে।
আমাদের গ্রুপে একজন শেফ ছিল, তাই বারবিকিউ দায়িত্ব টা প্রণয় (শেফ) ভাইকেই নিতে হল। প্রণয় ভাইকে ওইদিন খুব কষ্ট দিয়েছিলাম আমি।
সবকিছু এরেঞ্জ করে দিয়ে আমি পাড়ার ফুটবল খেলার মাঠে চলে এলাম। সাজানো গোছানো পাড়া বলেই হয়ত সবকিছুই ভাল লাগছিল। ওইদিকে বারবিকিউ এর গন্ধ নাকে চলে আসল। এই মূহুর্তে কি আর ফুটবল মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? এক দৌড়ে চলে গেলাম বারবিকিউ এর কাছাকাছি। সুন্দর ১টা গন্ধে মনটাই ভরে গিয়েছিল। ফটাফট কিছু ছবি তুলে ফেললাম।
কিছুক্ষণ পর প্রণয় ভাই এর কনফার্মেশন পেলাম যে, “বার-বি-কিউ রেডি” আমায় আর পায় কে... নুডলসের সাথে ঝলসানো মাংস, মজাই আলাদা। যদিও নুডলস টা একটু বেশিই স্বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। :p
রাতে আমাদের কিছু সদস্য ফিরে যাবে বলে আমাকে জানাল। তারা সামনের পথ সম্পর্কে অবগত হয়ে, সেখানে যাবার দুঃসাহস করতে চাচ্ছে না।
যাই হোক, সর্ব সাকুল্যে আমরা ৮ জন সকালে বের হয়ে গেলাম রুমানা পাড়ার উদ্দেশ্যে। বের হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি। আমাদের কঠিনতম পথটা বৃষ্টি দিয়েই শুরু হল। ভাবতেই কেমন যেন গা ছমছম করে।
সুংসাং পাড়া থেকে ৩০ মিনিট ট্রেক করে রুমানাপাড়া চলে আসি। এখানে ভাত আর ডাল রান্না করতে দিয়ে আমরা চলে যাই জিংসিয়াম সায়তার এর উদ্দেশ্যে।
একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, প্রতিটা ঝর্ণাই পাহাড়ের নিচে অবস্থিত এবং প্রতিটা পাহাড়ি পাড়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। তাই এবারো আমাদের রুমানাপাড়া থেকে নিচে নামতে হল। এবারে রাস্তাটাও বেশ খাড়া আর ঝুম বৃষ্টিতে মারাত্মক পিচ্ছিল অবস্থা। বৃষ্টি তখনও চলছিল। আর এ রাস্তা থেকেই জোক বাবাজিদের দেখা মিলে গেল।
জিংসিয়াম সায়তার এর ৩টা স্টেপ। আমরা ২য় স্টেপ থেকে শুরু করি। ২য় স্টেপ এর রাস্তায় ১টা জুমের ট্রেইল পরে। জুম ট্রেইল গুলো বৃষ্টিতে খুব ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল হয়ে যায়।
এই রাস্তা দিয়ে ৩য় স্টেপের চূড়ায় যাওয়া যায়, যেখান থেকে ৩য় স্টেপের পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
ঝুম বৃষ্টির ফলে ঝর্ণাতে প্রচুর পানি ছিল, যা ঝর্ণা টিকে এক নতুন রূপে সাজিয়েছে। ২য় স্টেপ শেষ করে ১ম স্টেপ এর দিকে রওনা দিলাম। ৫ মিনিট উঠে যাবার পর বুঝতে পারলাম নামতে কি রকম কষ্ট হবে।
বাকী অংশ খুব শীঘ্রই পরের পর্বে প্রকাশ করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৪৫