বিবির পীড়াপীড়িতে মোল্লা নাসিরুদ্দিন একটা গরু কিনলো। কিন্তু গরু ও গাধার জন্য গোয়ালঘরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় একটা ঘুমালে আরেকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
প্রিয় গাধার এই দুরবস্থা দেখে হোজ্জা একদিন খোদার কাছে প্রার্থনা করছে, হে আল্লাহ, দয়া করে গরুটাকে মেরে ফেলো যাতে আমার গাধাটা একটু আরাম করে ঘুমাতে পারে।
পরদিন সকালে সে গোয়ালঘরে গিয়ে দেখে গাধাটা মরে পড়ে আছে!
প্রাণপ্রিয় গাধার মৃত্যুতে হতাশ হয়ে হোজ্জা বিরস বদনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বল্লো, কোন অভিযোগ করবো না খোদা, কিন্তু তুমি এত দিন ধরে সারা দুনিয়ার মালিক হয়েও কোনটা গরু কোনটা গাধা এইটা চিনলা না!
ঈশ্বর সব প্রার্থনায় সাড়া দেন না। সাড়া দেয়া না দেয়া তার খেয়াল খুশির ব্যাপার। মানিক বাবু বলেছিলেন ঈশ্বর ভদ্রপল্লিতে থাকেন। এক ভিক্ষুক তাঁকে শুঁড়িখানায় পেয়েছিলোঃ
মন্দিরের বাইরে ভিক্ষুক পূজারীদের কাছে ভিক্ষা চাইছিলঃ ভগবানের নামে এই ক্ষুধার্ত লোকটির পেটে দেয়ার জন্যে কিছু পয়সা দিন। ভগবান আপনাকে আশীর্বাদ দেবেন।’ কিন্তু যারা মন্দিরে যায় তারা ভিক্ষুককে কালেভদ্রে এতো সামান্য পয়সা দেয় যা দিয়ে তার ক্ষুধা নিবারণের ডালরুটি কেনা সম্ভব হয় না। হতাশ হয়ে সে মন্দির ত্যাগ করে এক জায়গায় বসলো যেখানে লোকজন সন্ধ্যায় দেশি মদ পান করে। ‘ভগবানের নামে আমাকে কটা পয়সা দিন বাবা।’ সে কাতর মিনতি জানালো। মাতাল অবস্থায় লোকজন বের হচ্ছে। ভিক্ষুককে ভিক্ষা হিসেবে পয়সার বদলে কাগজের নোট ছুঁড়ে দিলো। ভিক্ষুক ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে বলল, ‘হে ভগবান, তোমার লীলা বুঝা দায়! এক জা’গার ঠিকানা দাও আর বাস করো আরেক জা’গায়।’
হোজ্জার প্রার্থনা আপাত-স্বার্থপর মনে হয়। তার জন্য খারাপ লাগে না। বরং তার গাধা মরে যাওয়া ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’ বলে ভ্রম হতে পারে। কিন্তু সকল অন্যায়কারীকে ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’ প্রিন্সিপলে ঈশ্বর ‘ধরে’ দেন না। তাই অন্যায়ের বিচার উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। দুনিয়ায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মগ্রন্থে সর্বাধিক নির্দেশ রয়েছে।
ন্যায়বিচারের অনিশ্চয়তা এক প্রকার জুলুম। নির্যাতিত মানুষের পাশে যখন কেউ থাকে না, তখন ব্যক্তি সব বিচার উপরওয়ালার উপর ছেড়ে দেন। খুদাতালার আদালতে শুনানির সুযোগ নাই। তবু মানুষ ভরসা করে। যেমন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। বউয়ের মুখের উপর না করতে পারে না। ফলে গরু কেনা লাগে। এবং গরুর মৃত্যু চেয়ে খোদার কাছে ফরিয়াদ করে গাধা হারায়!
ঈশ্বরের প্রতি অভিমান করে কি হবে বলুন, বিপদের সময় বন্ধুদের পাশে পাওয়া যায় না। প্রধান বিচারপতিকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনায় আইনজীবীদের হইচই করতে দেখা গেলো না। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ট্রাস্টি ও মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করার নিন্দা জানিয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি সহ কেউ কেউ। কিন্তু ডাক্তারদের রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। ওদিকে স্বাচিপ ছিল, এদিকে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ- কাউকেই দেখা যায় না কেন তা আপনারা জানেন।
বাইবেলে আইনজীবী ও ডাক্তার উভয়ের ব্যাপারে চমৎকার মিমাংসা আছে। চিকিৎসকদের বেলায় বলা হয়েছে ‘রেস্পেক্ট দাই ডক্টর’ অর্থাৎ ‘তোমার চিকিৎসককে সম্মান করো’ আর উকিলদের প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘উ আনটু ই লইয়ারস, ফর ই হ্যাভ টেকেন দ্য কি অব নলেজ’ অর্থাৎ ‘উকিলদের দুর্ভাগ্য হোক, কেননা তোমরা জ্ঞানের চাবি নিয়ে নিয়েছো।’
জ্ঞানের চাবি দিয়ে খুন করা যায় না। ডাক্তার বন্ধুরা কনগ্রাচুলেশনস। চেখভ বলছেন, ‘চিকিৎসক ও আইনজীবীরা একই গোত্রের; পার্থক্য শুধু এটুকু যে, আইনজীবীরা কেবল ডাকাতি করেন, অপরদিকে চিকিৎসকরা ডাকাতির সঙ্গে মার্ডারও করেন!’
এক নিষ্ঠাবান খ্রিষ্টান মৃত্যুশয্যায় পাদ্রির পরিবর্তে একজন উকিল ও একজন ডাক্তারকে ডাকলেন। তাদের দুজনকে তার বিছানার দুপাশে দাঁড়াতে বললেন। তারা জানতে চাইলো, ‘এ সময়ে আমাদের ডেকেছেন কেন?’ মৃতপ্রায় লোকটি উত্তর দিলো, ‘আমি যীশু খ্রিষ্টের মতো ক্রুশের দুপাশে দুজন চোরকে রেখে মরতে চাই!’
দুর্মুখরা বলছে দেশটা জিএমটিটি মানে জাতে মাতাল তালে ঠিকে ভরে গেছে। আবার স্বার্থ বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে রিয়াল মাতলামিও ছুটে যায়। খুশবন্ত সিং থেকে একটা কৌতুকঃ
ব্রিটিশ আমলের কথা। অন্ধ্র প্রদেশের এক এলাকায় তখনকার সাব-কালেক্টর ও তার মেম সাহেব সবসময় ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত থাকতেন। এক রাতে সাব-কালেক্টর খুব রেগে মেমসাহেবের উদ্দেশে চিৎকার করছিলেন, ‘তুই একটা কুত্তী, আমি তোকে কেটে দু’টুকরা করবো।’ ঐ সময় বাংলোর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলো এক মাতাল। সে চিৎকার করে বলল, ‘তাহলে দয়া করে আমাকে নিচের অংশটা দেবেন স্যার!’
গত সপ্তাহে একটা কাজে গুলশান গিয়েছিলাম। দুঘণ্টা অপেক্ষা করা লাগবে। মন খারাপ করে লাঞ্চের জন্য ‘সিপি ফাইভ স্টারে’ ঢুকে মুরগির ঠ্যাং চাবাচ্ছিলাম। দেখলাম দোকানদার সরকারের মুন্ডুপাত করছে। তার মতে ‘উন্নয়ন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সারা বিশ্ব আগাচ্ছে, বাংলাদেশ অটোমেটিক আগাবে। সরকারের নিজের কৃতিত্ব কোথায়? সরকারের কাজই হচ্ছে জনগনের সেবা করা। কোন দেশের সরকার এতো লুটপাট করে বলুন তো? এক ডলারে এক কেজি চাল পাওয়া যায় না। গতকাল হাতে একশ টাকা ছিল আজ পাঁচশ হয়েছে এটাকে উন্নয়ন বলে? ইত্যাদি...’
আমার পেশাগত পরিচয় পেয়ে বিচার ব্যবস্থাকে ধুয়ে দিলেন। সরকার ও প্রধান বিচারপতির লুকোচুরি নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন। লোকজন আসছে আর খেয়েদেয়ে বেরুচ্ছে। দোকানের ছেলেটা মুরুব্বিকে সাবধান করে, ‘বাদ দেন তো, কয়ে লাভ আছে? ক্ষমতায় গেলে সব এক।’
ক্ষমতায় গেলে হয়তো সব এক। তবু প্রতিটা সরকারের উন্নয়নের নিজস্ব গল্প আলাদা আলাদা। যেমন ধরুন কেউ বলছেন দেশের চিকিৎসা সেবার মান বেড়েছে। কিন্তু একটু কিছু হলে এম পি মন্ত্রীরা সিঙ্গাপুরে ডাক্তার দেখাতে যান। পাবলিক যায় ইন্ডিয়া। একটা গল্প মনে পড়ে গেলঃ
এক হিন্দু, একজন মুসলমান ও একজন শিখ তাদের নিজনিজ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে চমৎকার সাফল্য নিয়ে আলোচনা করছিলো। হিন্দু বলল, ‘আমি এক বৈদ্যকে জানি, যিনি আয়ুর্বেদিক আঠা লাগিয়ে কাটা হাত জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। জোড়াটা এমন নিখুঁত যে দেখে কেউ বলতে পারবে না কোথায় কাটা গিয়েছিলো।’ মুসলমান ভদ্রলোক হিন্দুর চেয়ে পিছনে পড়ে থাকতে পারেন না। তিনি বললেন, ‘এক হাকিম সাহেব জোড়া লাগানোর নতুন মলম আবিষ্কার করেছেন। মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এমন এক লোকের ওপর তিনি সেই মলম প্রয়োগ করেন। এরপর লোকটিকে দেখে আর বলার উপায় ছিল না যে তার গলার কোথায় কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো।’ এবার শিখের পালা। শিখ চিকিৎসার উৎকর্ষ বর্ণনা করতে দৃষ্টান্ত পেশ করলো। ‘আমরা আরো এগিয়ে গেছি।’ গর্বের সঙ্গে বুকে চাপড় দিলো সে। ‘আমার এক চাচার পেট বরাবর কেটে দু’টুকরা হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের শিখ সার্জন দ্রুত একটি বকরি বলি দিয়ে বকরির নিচের অংশ চাচার পেটের ওপরের অংশের সাথে জুড়ে দেয়। অতএব আমার চাচা বেঁচে আছে, পাশাপাশি দৈনিক দুই লিটার করে দুধও পাচ্ছি!’
উদ্ধৃতি দেয়া নিরাপদ। হোজ্জার গর্দভ ছাড়া জানের রিস্ক নেবে কে?
নিকিতা ক্রুসচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর এক জনসভায় পূর্বসূরি স্তালিনের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করছিলেন। শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলল, ‘আপনি তো তখন তার সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাকে থামাননি কেন?’
সহসা সভাস্থলে মৃত্যুর নীরবতা নেমে এলো। ক্রুসচেভ গর্জন করে উঠলেন, ‘কে বলল কথাটা?’ কেউ সাড়া দিল না। দীর্ঘক্ষণ অসহনীয় নীরবতার পর ক্রুসচেভ শ্রোতার প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি কেন চুপ ছিলাম।’
ঢাকায় মানুষ সম্ভবত এখনো মুখ খুলতে পারে। পাবলিক পরিবহণে মানুষের চাপা ক্ষোভ বুঝতে পারি। ভ্যাপসা পরিবেশ। চায়ের দোকানে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’ টাইপ লেখা দেখে বোঝা যায় মানুষ ভয় করে। অথচ সে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রাণী। উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমালোচনা বিরোধীদল ও সরকার উভয় তরফ থেকেই প্রত্যাশিত।
এক ভদ্রলোক ইসলামাবাদ থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে করাচি এসেছেন পোকা-ধরা দাঁতটি তুলে ফেলার জন্য। করাচির ডেন্টিস্ট তাকে বললেন, ‘ইসলামাবাদেই তো অনেক ডেন্টিস্ট আছে। কষ্ট করে এত দূরে আসার কি প্রয়োজন ছিল?’ লোকটির উত্তর, ‘আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা মূল্যহীন। ইসলামাবাদে মুখ খোলার অনুমতি নেই!’
সম্প্রতি পাকিস্তানের আদালত সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অ্যাকশন দেখালো মাইরি! নওয়াজ শরীফ কোমায়। শুনছি সেটাও রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থার বাহাদুরি নয়। তাই যদি হয় তাহলে ওদের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে বাংলাদেশে এতো লাফালাফির কিছু দেখি না।
আকবর কি আর এমনি এমনি গ্রেট? তার সভায় ছিল নবরত্ন। আমাদের যে-কোন সরকারের চারপাশে চোর ছ্যাঁচড়। ত্রাণের কম্বল কি কম হারালাম? অথচ প্রতিটি মানুষ আজ সেই অবরোধবাসিনী নারীর মত। চুরি হতে দেখে মাথায় ঘোমটা টানি! ফিসফিস করা লাগে। অথচ মুঘল দরবারে আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চয়তার নজির কত উদার হতে পারে দেখুনঃ
সম্রাট আকবর তার পকেট থেকে পড়ে যাওয়া কয়েকটি মুদ্রা কুড়ানোর জন্য নিচের দিকে ঝুঁকতেই বীরবল সম্রাটের রাজকীয় পশ্চাদদেশে আস্তে চাপড় দিলেন! সম্রাট সোজা হয়ে এতো ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করলেন যে সাথে সাথে বীরবলের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন। ধীরে ধীরে যখন শান্ত হলেন, সম্রাট ঘোষণা করলেন, বীরবল যে বেয়াদবি করেছে তার চাইতেও গুরুতর কোন অজুহাত দেখাতে পারলে তাকে ক্ষমা করা হবে। বীরবল অর্থাৎ মহেশ দাস উত্তর দিলঃ আসলে আমি বুঝতে পারিনি যে ওটা আপনি; আমি ভেবেছিলাম বোধ হয় রানি!’
বিচার ব্যবস্থার হালচাল ও অন্যান্য প্যাঁচাল # দেলাওয়ার জাহান
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২০