দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে
দিনটি ছিল ২০ জুলাই ২০১২। ৪৩ বছর আগে এরকম দিনেই কী ঘটেছিল, জানা তো সবারই। মানুষ প্রথম পা রেখেছিল পৃথিবীর বাইরে ভিন কোনো মাটিতে। চাঁদে। মহাকাশচর্চার ঐতিহাসিক এমন দিনে বসেছিল এক আলোচনার আসর। ডিসকাশন প্রজেক্টের ২৫১তম ডিসকাশন, তবে গ্রুপ ডিসকাশন। ধানম-ি ১৯-এ ডিসকাশন প্রজেক্টের বর্তমান ঠিকানায়। দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে; এই নিয়ে ছিল ডিসকাশন প্রজেক্টের এ আসরের বিজ্ঞান-আলোচনা। মানে, হচ্ছে ভিন কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা? কেন ওদের খোঁজ করব আমরা (পাছে ভয় তো আছেই, যদি এসে আমাদের ওরা ধ্বংস করে যায়!)_ এমন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই দুই ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেছেন আসিফ। বক্তৃতার বিশেষ অংশে ছিল দরকারি সস্নাইড শো এবং গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও প্রদর্শনী। ৩০ টাকা দর্শনী দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু আসিফের এ বক্তৃতার ধরন ছিল ভিন্ন ধারার। দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দার্শনিক। উপস্থাপনা ছিল নাটকীয় ও উপভোগ্য। কিন্তু তার বক্তৃতার বাক্য বেড়েছে বলা চলে, কিছুটা কৌশল গায়ে মেখে। কেমন? ধরুন, আলোচনা ছিল পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু শুরুটা হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাস দিয়ে। অবশ্য শুরুটা করেন ডিসকাশন প্রজেক্টের আর এক বিজ্ঞানকর্মী খালেদা ইয়াসমিন ইতি। এরপরই আসিফের নাটকীয় উপস্থাপনা। বিজ্ঞানমনস্ক শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপলব্ধি করেন। পুরো অনুষ্ঠানটিকে সুসম্পন্ন হওয়ার জন্য বিজ্ঞানকর্মী জাহাঙ্গীর সুর করেছেন। উল্লেখ্য ডিসকাশন প্রজেক্ট দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এ ধরনের বিজ্ঞান বক্তৃতার আয়োজন করে আসছে। পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তন নিয়ে আলোচনার শুরু, এরপর বিবর্তনের ইতিহাসে আমাদের অবস্থান, মানবসভ্যতার ইতিহাস। আমরা নিজেদের গঠন ও অবস্থান সম্পর্কে ঠিকঠাক না জানলে অন্যদের কী করে জানব ও বুঝব? এরপর আসিফ কার্ল সাগানের কসমিক ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি থেকে এখন পর্যন্ত সময়কে যদি পার্থিব এক বছরের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে মানুষের জন্ম ৩১ ডিসেম্বর রাত ১০টা ৩১ মিনিটে। আর যদি বলা হয়, মানুষের লিখিত ইতিহাস কত দিনের? তবে তা মাত্র ১০ সেকেন্ড আগের! দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে মানুষের যে প্রচেষ্টা তা একদিন সফল হবেই। ইতোমধ্যে সাড়ে ৫০০ ভিন গ্রহ আবিষ্কৃৃত হয়েছে। আসিফ মনে করেন, লাখখানেক গ্রহ আবিষ্কার হলে আমরা 'নিশ্চিত' তেমন কোনো প্রাণ অধ্যুষিত পৃথিবীও পেয়ে যাব। আর ১০ বছরের মধ্যেই অন্তত মঙ্গল গ্রহে অণুজীবের সম্ভাব্য জীবন ধারণ নিয়ে আমরা সুনিশ্চিত হতে পারব_ মন্তব্য করেন বক্তা আসিফ। ভয়েজার, পাইওনিয়ার, কেপলার_এ রকম অনেক মহাকাশযান ভিনগ্রহের সন্ধানে সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। বেতার বার্তা পাঠিয়েছে মানুষ। যদি ওরা থেকে থাকে, আর সঙ্কেত পাঠোদ্ধার করতে পারে আর যদি ফিরতি বার্তা ওরা পাঠায় তবে সেও হবে অনেক দীর্ঘ সময়ের এক হিসাব। কিন্তু ওরা যদি হয় মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান প্রাণী। হতেই পারে, এ ব্যাপারে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ফ্রাঙ্ক ড্রেকের সমীকরণের। তিনি এ সমীকরণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন আমরা ছাড়াও ১ কোটি প্রাযুক্তিক সভ্যতা থাকতে পারে এ গ্যালাক্সিতে। আর আমাদের অবস্থান? তাও দেখিয়েছেন নিকোলাই কারডাশেভের সভ্যতার শ্রেণী বিভাগের মাধ্যমে। সেখানে আমাদের অবস্থান টাইপ১ ও টাইপ২-এর মাঝামাঝি। প্রাযুক্তিকভাবে ওরা যদি হয় আরো বেশি উন্নত, টাইপ৩-এর মত বা এর কাছাকাছি হয়, তাহলে? আসিফ মজা করে বললেন, 'আমরা যেমন ব্যাকটেরিয়া কালচার করার সময় ভাবি, থাক ওদের বিরক্ত করব না। ঠিক তেমনি হয়তো ভিনগ্রহের বুদ্ধিজীবীরাও আমাদের ওরকম চোখেই দেখছে। মানুষ যা করছে করুক, ওরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে!' যেন ওরা করছে হিউম্যান কালচার! আমরা কি পারব সভ্যতাকে আন্তঃণাক্ষত্রিক সভ্যতায় নিয়ে যেতে? পারব কি সে পর্যন্ত আমাদের এ সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে? এসব প্রশ্নের উত্তর এসেছে প্রশ্ন উত্তর পর্বে। আমাদের এ সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। বিদ্যালয়গুলোয় দিতে হবে সাংস্কৃতিকমুখী শিক্ষা। মানবতা ও মানবিকতাই পারে এ সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে। আর মানবতাই হওয়া উচিত শিক্ষার্জনের মূল লক্ষ। সব প্রশ্নোত্তরের পর শ্রোতাদের আরো উৎসাহী মনে হলো। তারা পরের আলোচনায় অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের পরবর্তী ওপেন ডিসকাশনের বিষয় হিগস কণা বা ঈশ্বর কণা যা সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে সম্প্রতি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।
২০ জুলাই ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:১৮