জনগণের বন্ধু হউন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বাহিনীর সদস্যদের এ পরামর্শ দিয়েছেন অসংখ্যবার। বলেছেন, জনগণকে সম্পৃক্ত করে সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে হবে। কারণ, পুলিশের একার পক্ষে এতোবড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপরাধী আর অপরাধ প্রবণতাকে দূর করা সম্ভব নয়। জনগণের বন্ধু হবার পরামর্শের আরেকটি প্রধান কারণ হলো, অপরাধী ও অপরাধের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে পুলিশকে সহায়তা করে। কারণ, প্রকৃত বন্ধুই বন্ধুর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। যেখানে থাকে অনেক ব্যক্তিগত আর গোপন বিষয়ও।
কর্মকর্তাদের ওই পরামর্শগুলো নিঃসন্দেহে অতুলনীয় ও চরম বাস্তবতা। সম্প্রতি জঙ্গি হামলা প্রতিহত করাসহ অনেক বিষয়ে পুলিশ বাহিনী দেখিয়েছে নৈপূন্যতা, তাদের ভূমিকা হয়েছে প্রশংসিত।
তবে, ধানের মধ্যে যেমন চিটা থাকে, এ বাহিনীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই ধরুন, যে ছবিটি ঘিরে আজকের এ দু’কলম লেখা, সেটি কি বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার মতো নয়?
৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকশ হয়েছে গণমাধ্যমে। যেখানে দেখা যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তাদের দুই টেবিলের মাঝখানে উল্ট করে বেঁধে বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এক যাবককে। যেন এক টুকরো জাহেলিয়াত।
খবরে বলা হয়, এ কা- ঘটেছে যশোরের কোতোয়ালি থানায়। কিন্তু এমন চিত্র ধারণ করা হলেও সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না। তাহলে এ কাজ করেছে কে?
উত্তর খুব সোজা। ‘না’ বলে দিলেই বোধয় কুল্লু খালাস! এমনটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার-বিবেচনাহীন কথায়। না জানার ভান করে এক কর্মকর্তা বিষয়টি জানার ভার তুলে দিচ্ছেন অন্য জনের ওপর।
তবে, এতোটুকু অন্তত নিশ্চিত করেই বলা যায়, এভাবে একজন মানুষকে উল্টো করে বেঁধে ঝুলানো একজনের পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়, একাধিক লোকের প্রয়োজন।
প্রথম আলো’র খবরে বলা হয়, যশোরে পুলিশের হাতে আটক এক যুবকের কাছ থেকে ‘ঘুষের’ টাকা না পেয়ে থানায় ঝুলিয়ে পেটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘দুই লাখ’ টাকা ঘুষ দাবি করা হলেও শেষ পর্যন্ত আবু সাঈদ (৩০) নামের ওই যুবক ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেয়েছেন। আবু সাঈদ যশোর সদর উপজেলার তালবাড়িয়া গ্রামের নুরুল হকের ছেলে।
পুলিশ সূত্রে জানায়, কোতোয়ালি থানার এসআই নাজমুল ও এএসআই হাদিবুর রহমান বুধবার রাতে আবু সাঈদকে আটক করেন। পরে তার কাছে ‘দুই লাখ টাকা’ ঘুষ দাবি করেন ওই দুই কর্মকর্তা। ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় আবু সাঈদকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে থানার মধ্যে দুই টেবিলের মাঝে গাছের মোটা ডালের সঙ্গে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। পরে ‘৫০ হাজার টাকা’ দিয়ে ওই রাতেই ছাড়া পান আবু সাঈদ।
ব্যাপারটি নিয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইলিয়াস হোসেনের বক্তব্য হলো, বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি থানার এসআই নাহিয়ানের সঙ্গে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন। নাহিয়ান নামের ওই কর্মকর্তাও বললেন, তিনি আটক পর্যন্ত জানেন। এর পর কি হয়েছে তা তিনি জানেন না।
কিন্তু সেই থানারই এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এস আই নাজমুল ও এএসআই হাদিবুর রহমান আবু সাঈদকে আটক করে ‘দুই লাখ’ টাকা ঘুষ দাবি করেন। এ টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে কোতোয়ালি থানার ভেতরে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে।এদিকে অভিযুক্ত এএসআই হাদিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নয়।’
নির্যাতিত আবু সাঈদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তার এক স্বজন মোবাইলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আবু সাঈদের নামে মামলা রয়েছে। তবে সব মামলায় তিনি জামিনে আছেন। বুধবার রাতে বিনা অপরাধে তাকে আটক করা হয়। ঘুষ নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ঘুষ আদায়ে যদি একজন সাধারণ মানুষকে এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাহলে কেন জনগণ বন্ধু হবে পুলিশের? এ প্রশ্ন উঠা কি অস্বাভাবিক? বাহিনীর কিছু সদস্যের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের লজ্জা নিশ্চয় অন্য সদস্যরাও বোধা করেন। সেইসঙ্গে দেশের জনগণেরও লজ্জা। কারণ, তারা যে আমাদেরই একজন।
তবে, দু’একজন সদস্যের বিতর্কিত কর্মকা-ে পুরো বাহিনীকে দোষী করার সুযোগ নেই। আবার পুলিশের শান্তি-শৃঙ্খলার পোশাকের আড়ালে থাকা কুৎসিতমনা অপরাধীকে ছেড়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। তাই, তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। যাতে আর কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ রোধের বিপরীতে নিজেই অপরাধী হয়ে না উঠেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:০৫