সচরাচর যা ঘটেনা তা ইতিবাচক ভাবে ঘটলেই বলা হয় দৃষ্টান্ত। যা সাধারণের মাঝে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়, উদাহরণ দেয়া হয় সেই ঘটনাকে উল্লেখ করে। এমনই একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছেন সদ্য নির্বাচিত নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। ফলাফল ঘোষণার পর দিনই চলে গেছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায়। করেছেন নানা বিষয়ে আলোচনা। যেটি বাংলার মাটিতে বিরল। সেজন্য এটিকে দৃষ্টান্ত বললে ভুল হবার নয়।
পশ্চিমা বিশ্বের সবকিছুই যে ভালো তা নয়, কিন্তু তাদের ভোট সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয়ই বলা যায়। কারণ, জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিকতা তারা দেখিয়েছেন বছর কে বছর। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও বিশ্ব দেখেছে, যে হিলারীকে বিশ্ববাসী যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে একরকম ধরেই নিয়েছিলেন, সেই জরিপ স্রোতের বিপরীতে হিলারীকে যখন ছড়িয়ে গেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন হিলারী। এটা তাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি।
কিন্তু আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরেই দুটি পরিভাষা ব্যবহার হয় নির্বাচন মওসুমে। তা হলো নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংসতা ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা। আমাদের একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, নির্বাচন মানেই সহিংসতা, খুন, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোট কারচুপি ইত্যাদি। যা রীতিমতো আতঙ্কিত করে ভোটারসহ সব বয়সী মানুষকে। এইতো সবশেষ অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনেও লাশ পড়েছে একাধিক। আর জাতীয় নির্বাচনে তো কথাই নেই, বুক খালি হয় কতো মায়ের।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন? এ নির্বাচনের প্রশ্নে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সফল। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতেও সহিংসতা হয়েছে, উঠেছে নানা অভিযোগ। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। যদিও ঢাকার দুই সিটি বাদে সবগুলোতেই বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তারপরও গ্রেপ্তার আর নানা জটিলতায় তারা মেয়র হিসেবে কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারছেন, সেটি অন্য আলোচনা বিষয়।
২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নাসিক নির্বাচনের দৃশ্যটা অন্য আর দশটা নির্বাচনের মতো মনে হয়নি কারোরই। কারণ, নেই নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংসতা। তাই সকাল থেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে দেখা গেছে ভোটারদের। দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল ভোটের ময়দানে। দীর্ঘ দিন পর শান্তিতে ভোট দিতে পেরে সেই খুশি ভোটাররা।
যদিও এ নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল একটু অন্যরকম। বাংলাদেশের এটিই একমাত্র সিটি করপোরেশন যে নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা সমান কাজ করে। এর কারণ, বিএনপি-আওয়ামী লীগের জন্য নয়, বরং আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগের জন্য।
বিগত দিনে অধিকাংশ নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরই বড় ধরনের সহিংসতা-ভাংচুরের নজির রয়েছে। হয়েছে প্রাণহানিও। কিন্তু নাসিক নির্বাচনে হয়েছে এর ব্যতিক্রম। নারায়ণগঞ্জ ছিল শান্তির শহর। একইসঙ্গে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর মধ্যরাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের লাইভ আলোচনা অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র ডা. সেলিনা হায়ৎ আইভী বলেছেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায় তিনি যাবেন। কথা বলবেন। গিয়েছেনও। সেই সাক্ষাৎ আইভ সম্প্রচারও হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে একটি নতুন সংস্কৃতির সংযোজন হলো। যা মূলত বন্ধনের এক শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি।
অন্যদিকে, নির্বাচনে সুষ্ঠু হয়নি, প্রশাসন হস্তক্ষেপ করেছে, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি, ভোট জালিয়াতি হয়েছে ইত্যাদি ইত্যদি অভিযোগ কিন্তু আসেনি শক্তভাবে। যদিও ফলাফল ঘোষণার পর বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান দাবি করেছেন, আপাদ দৃষ্টিতে ভোট সুষ্ঠু হলেও ভোট গণনায় সূক্ষ্ম কারচুপির মতো কিছু একটা হয়েছে। তবে তার এ দাবি তেমন জোরালো নয় বলেই মনে হয়েছে।
নির্বাচনের এ পরাজয়ের পেছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি একটি কথা বারবারই বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি নাসিক নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মধ্যরাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের লাইভে বলেছেন, প্রার্থী হিসেবে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াতের জনসম্পৃক্ততা ছিলনা তথা ব্যক্তিগত ভোট ছিলনা, যতটা আইভীর ছিল। এজন্যই এ পরাজয়। একইসঙ্গে তিনি এ পরাজয়ের নেপথ্যেও কারণ বা কারো গাফলতি ছিল কি না তা তদন্তেরও আহ্বান জানিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি।
নির্বাচন কমিশন বলছে, সবার সহযোগিতায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ আচরণকেই সর্বাগ্রে বিবেচনা করছে ইসি। এ নির্বাচনকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের নজির বলছেন বিশ্লেষকরা
তাই বলা যায়, নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংসতা আর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা নামের যে দুটি পরিভাষা দীর্ঘকাল বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে জাড়িয়ে আছে তার মৃত্যু হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। এবং এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে আর দেখা যাবে না সেই প্রত্যাশা থাকলো। একইসঙ্গে জয় পরাজয় যাই হোক, মেনে নেয়ার যে মানসিকতা অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে তা বজায় থাকুক রাজনীতির অঙ্গনে, শান্তির সর্বোচ্চ শিখড়ে পৌঁছাক বাংলাদেশ।
২৩.১২.১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:২৯