[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ....যুধিষ্ঠির পরামর্শের জন্য কৃষ্ণকে আহ্বান জানালেন....কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ রওনা দেন ...].
ভীমার্জ্জুনকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণের গিরিব্রজে প্রবেশঃ
কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন স্নাতক[যে শিষ্য গুরুগৃহে বিদ্যা শিক্ষান্তে ব্রহ্মচর্য সমাপ্তিসূচক স্নান করে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করে] ব্রাহ্মণের বেশে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
পদ্মসর, কালকূট পর্বত লঙ্ঘন করে গণ্ডকী, শর্করাবর্ত, অযোধ্যার সরযূ নদীর বিষম সঙ্কট কাটিয়ে, মিথিলা নগর ছেড়ে ভাগীরথী, সরস্বতী, যমুনা নদী পার হয়ে আরো পূর্বদিকে তিনজনে এগোতে লাগলেন। এভাবে অনেকদিন পর তারা মগধ রাজ্যে প্রবেশ করলেন।
চৈত্যরথ প্রমুখ পাঁচটি গিরিবরের মধ্যস্থলে গিরিব্রজ রাজপুরী অবস্থিত। সেটি অতি মনোরম স্থান। ধন, ধান্য, গো, মহিষে শোভিত নগর।
ভীমার্জুনকে মহামতি কৃষ্ণ বলেন –এই পাঁচ গিরিবরের মাঝে জরাসন্ধের নগর। এই পাঁচ গিরিবরও সাংঘাতিক। শত্রু দেখলেই এরা নিজ দ্বার রুদ্ধ করে। আর এক আশ্চর্য আছে এই দুয়ারে। এদের মাঝে তিনটি ভেরী[ঢাক বা রণবাদ্য বিশেষ] হঠাৎ বেজে উঠে সেনাদের সজাগ করে দেয়।
এছাড়া শত্রুব্যাপী ও অর্বুদ নামে দুই ভয়ঙ্কর নাগের ভয়ে শত্রুরা এ নগরে প্রবেশের সাহস পায় না।
নগরের দ্বারগুলি সব সময় মহারথীরা পাহারা দিচ্ছে। এমন নগরে প্রবেশের কোন উপায় বার করতে হবে।
অর্জুন বলেন –ভেরীর দিকটা আমি সামলে নেব।
ভীম বলেন –আমি পর্বতের ভার নিলাম।
কৃষ্ণ বলেন –আমি দুই নাগকে দেখে নেব।
এভাবে তারা ঠিক করলেন নগরদ্বার দিয়ে তারা প্রবেশ করবেন না। তারা পর্বতারোহণ করবেন ঠিক করলেন।
কৃষ্ণ নাগদের পরাস্ত করার জন্য খগপতি গরুড়কে স্মরণ করলেন। ভুজঙ্গ-রিপু খগপতি এসে কৃষ্ণকে প্রণাম করে সব শুনে ত্রিভুবন কাঁপান গর্জন করলেন। সেই ডাক শুনে দুই ভুজঙ্গ ভয়ে পাতালে প্রবেশ করল।
কৃষ্ণের মেলানি[বিদায় সম্ভাষণ] নিয়ে গরুড় ফিরে গেলেন।
অর্জুন এক শব্দভেদী বাণ মেরে তিনটি ভেরী একসাথে নষ্ট করলেন।
চৈত্যগিরি চূড়ায় আরোহণ করা মাত্র শত্রু দেখে গিরিবর প্রচন্ড গর্জন শুরু করল। ভীম গিরিশৃঙ্গ উপড়ে বজ্রমুষ্টির আঘাতে তাকে অচল করে ফেললেন। এভাবে তারা পর্বত লঙ্ঘন করে নগরে প্রবেশ করলেন।
দেবপুরী সমান সুন্দর এই জরাসন্ধের দেশ। হাট, বাজার, নগর, চত্বর অতি মনোহর। নগরের ভিতর নানা পসরা বসেছে। সুগন্ধি, কুসুম, মাল্য দেখে বলপ্রয়োগ করে তিনজনে তা কেড়ে ভূষণসজ্জা করলেন।
পূর্বদিকের দ্বার লঙ্ঘন করে তারা অনায়াসে অন্তপুরে প্রবেশ করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণদের অবাধ দ্বার, তাদেরও দ্বারী ব্রাহ্মণ ভাবল। আরো তিনটি দ্বার পেরিয়ে যেখানে মহীপাল জরাসন্ধ বিরাজ করছে সেখানে তারা উপস্থিত হলেন।
জরাসন্ধ যজ্ঞ দীক্ষা নিয়ে যজ্ঞে তৎপর, আজ সে ব্রতধারী উপবাসী। কেবল ব্রাহ্মণদের সাথেই দেখা করছে। বিনা আহ্বানে অন্যদের সেথায় প্রবেশ নিষেধ। তিনজন ব্রাহ্মণকে দেখে রাজা উঠে এসে জোড়হাতে প্রণাম করে অভ্যর্থনা জানায়। বসার জন্য কনক আসন দেওয়া হয়। ‘স্বস্তি, স্বস্তি’-বলে তিনজন আসন গ্রহণ করেন।
জরাসন্ধ এবার তিনজনকে ভাল করে নিরীক্ষণ করে। শাল বৃক্ষ কোঁড়া অঙ্গের বরণ, আজানুলম্বিত ভুজঙ্গ(সাপ) আকার বাহু। প্রত্যেকের শরীরে অস্ত্রচিহ্ন বিদ্যমান।
নানান কুসুমের ছদ্মবেশে এরা এসেছেন বুঝে জরাসন্ধ নিন্দা করে বলে ওঠে –সুগন্ধি চন্দন মালা পরে দেখছি ব্রতধারী ব্রাহ্মণ সাজা হয়েছে! এতো সাংঘাতিক অনাচার! সবাই জানে ব্রাহ্মণরা এভাবে গলায় মালা দেয় না। পরিধানও বিচিত্র করা হয়েছে! ব্রাহ্মণই যদি হবে তাহলে দেহে এত অস্ত্রের ক্ষত চিহ্ন কেন! সত্যি করে বল তোমরা কে, কোন জাতের, কি কারণে এখানে আসা হয়েছে! ব্রাহ্মণ ছাড়া কারো প্রবেশানুমতি নেই, তাই চোরের মত আমার কাছে এলে! চৈত্যগিরিশৃঙ্গ ভেঙ্গে যে প্রবেশ করেছ, বুঝতেই পারছি। রাজদ্রোহের পাপ ভয় নেই! কি কারণে, কি ভিক্ষা করতে আসা হল শুনি!
এত কথা শুনে কৃষ্ণ বলেন –পুষ্পমাল্য সদা লক্ষ্মীর আশ্রয়, তার প্রিয় কর্ম সকলে করতে চায়। দ্বার পথে আসিনি বলে এত কথা শোনাচ্ছ। শত্রুগৃহে আমরা দ্বার পথে প্রবেশ করি না।
জরাসন্ধ বলে – তোমরা আমার শত্রু হলে কবে! হিংসা না পেয়েও যারা আগ বারিয়ে হিংসা করতে আসে তাদের সমান পাপী সংসারে নেই। তোমাদের শত্রু কিভাবে হলাম, শুনি!
গোবিন্দ বলেন –তুমি বিপরীত কথা বলছ। জগতে তোমার নিন্দার শেষ নেই। পৃথিবীর সকল রাজাকে তুমি বেঁধে এনে পশুর মত অত্যাচার করছ। শুনছি তাদের মহাদেবের সামনে বলি দেবে। এমন কাজ কোন সুহৃদ করে কক্ষনো! এমন কেউ শুনেছে যে জ্ঞাতির বলি দিতে চায়! তুমিই তো অধর্ম করতে চলেছ। আমি ধর্মের রক্ষক, আপদ ভঞ্জক। আমি কখনও জ্ঞাতি হিংসা দেখতে পারি না।
ত্রয়োবিংশ অক্ষৌহিণী নিয়ে অষ্টাদশবার হেরে পালিয়েছিলে আমার কাছ থেকে-আমি সেই বসুদেব নন্দন কৃষ্ণ। এঁরা দুজন পান্ডুপুত্র ভীমার্জুন।
নিজের ভাল চাইলে আমার কথা মত এখনি সব রাজাদের মুক্ত করে দাও। না হলে আমার সাথে যুদ্ধ কর।
শ্রীকৃষ্ণের বচন শুনে জরাসন্ধ জ্বলে ওঠে –হে কৃষ্ণ, তুমিই পূর্বের কথা ভুলেছ। তুমিই যুদ্ধস্থল থেকে শৃগালের মত পালিয়েছিলে। আমার ভয়ে নিজস্থান ত্যাগ করে সমুদ্রে আশ্রয় নিয়েছ। কক্ষনো তো আর নিজদেশ মথুরাতেও যেতে পারলে না। এখন কোন সাহসে আমার নগরে প্রবেশ করলে, তাই ভাবছি।
আবার দর্প করে হুকুম হচ্ছে, সব রাজাদের ছাড়তে হবে! আমি এদের নিজ বাহুবলে জয় করে বেঁধে এনেছি। আমার সঙ্কল্প দেব ত্রিলোচনের কাছে এদের বলি দেব। তাতে কার কি বলার আছে শুনি!
হে গোপসুত তোমার কি একটুও লজ্জা নেই! পূর্বের সব কথা ভুলে বসেছো! তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করবে! তোমার মত ক্ষুদ্র প্রাণীর সাথে আমি লড়তে চাই না। তার চেয়ে ভীমার্জুনকে আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু এদের অল্প বয়স, এদের সাথে যুদ্ধ করলে আমার অযশ হবে। এদের মারলেও পৌরুষ ঘোষিত হবে না, আর হারলে তো অযশ হবে। এখন সব বালকরা পালাও দেখি! আর সাহস দেখাতে হবে না।
ভীমার্জুনের উদ্দেশ্যে জরাসন্ধ বলে –এই গোপালের কথায় তোমরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্যত হলে! যেনে রাখ এই জরাসন্ধ কৃতান্তেরও(যমেরও) যম।
জরাসন্ধের এত কথা শুনে বীর বৃকোদর ভীমের অধরোষ্ঠ ক্রোধে কাঁপতে থাকে।
গোবিন্দ বলেন –হে জরাসন্ধ বৃথা বড়াই করো না। তোমার সমান কেউ নেই। তাই বুঝি তুমি হীনবল রাজাদের অকারণে মারতে চাও! এর ফল তুমি পাবে। এখন দর্প দুর কর। আমার সাথে লড়তে না চাও, এদের দুজনের থেকে একজনকে বেছে নিতে পার। এদের বালক ভেব না। লড়তে গেলেই বুঝবে এদের শক্তি।
জরাসন্ধ বলে –তোমাদের যদি এতই মরণের ইচ্ছা, তবে আমি আর কি করি! ঠিক আছে আমিও লড়তে রাজি আছি। এখন কি ভাবে যুদ্ধ করতে চাও শুনি!
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলেন –বিধির নিয়ম ও ক্ষত্রিয় ধর্মে আছে সৈন্যে-সৈন্যে, রথে-রথে কিংবা ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে লড়াই। সেই মত একক যুদ্ধ কর, যার সাথে মন চায়।
এই শুনে ভুজবলে মত্ত অহঙ্কারী বৃহদ্রথ কুমার জরাসন্ধ বলে –অর্জুনকে তো সহজ বালক বিশেষ মনে হচ্ছে। হীনবলের সাথে যুদ্ধ করে সুখ নেই। কোমল বালক প্রায় বৃকোদরকে আমার মনে ধরেছে। এই ভীমের সাথেই আমি লড়ব।
এই বলে মগধ রাজ জরাসন্ধ উঠে দাঁড়াল। দুটি গদা আনার আদেশ হল। জরাসন্ধ একটি নিজে নিয়ে অন্যটি ভীমকে দিল। নগরের বাইরে রঙ্গভূমিতে সকলে এসে উপস্থিত হল।
এই যুদ্ধের কথা শুনে সমগ্র নগর কৌতূহলে ছুটে এলো।
এভাবে কৃষ্ণ কৌতুক দেখতে চললেন। তিনি দুই বীরকে যুদ্ধে লাগিয়ে দিলেন।
ভীম ও জরাসন্ধের অপূর্ব সংগ্রাম শুরু হল।
সে সব বিস্তারিত ছন্দে যমকে বলা হবে।
সভাপর্বে সুধারস জরাসন্ধ বধে, কাশীদাস দেব কহেন গোবিন্দের পদে।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
.....................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৬ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৩১