তাঁর নাম স্টিভ জবস। ‘অ্যাপল’ কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রযুক্তির দুনিয়ায় স্বনামধন্য। সম্প্রতি দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প-কর্তা মনোনীত। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর জীবন ভাবনায়। কেমন সেই ভাবনা?
---লিখেছেন বাসব চৌধুরী (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার)
২০০৫সালের ১২জুন আমেরিকার প্রসিদ্ধ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণ দিয়েছিলেন এক বক্তা। অভিভাষণে গম্ভীর কথাবার্তা বিশেষ ছিল না। নিজের জীবনের গল্প, গভীর উপলব্ধির কিছু কথা বক্তা স্নাতকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। মূলত তিনটি গল্প বলেছিলেন তিনি।
১নম্বর গল্পঃ এক অবিবাহিতা ছাত্রীর গর্ভে আমার জন্ম। জন্মের পরে সেই নারী, জীবন বিজ্ঞান-নির্ধারিত আমার সেই অপরিণত বয়স্কা মা, ঠিক করেছিলেন কোনও নিঃসন্তান দম্পতির হাতে আমার সব দায়িত্ব সঁপে দেবেন। দত্তক দেওয়া বা নেওয়ার ব্যাপারে একটিই শর্ত ছিলঃ যাঁরা আমাকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন, তারা যেন স্নাতক হন। যিনি দত্তক দেবেন এবং যাঁরা দত্তক গ্রহণ করবেন, এই শর্ত তাঁদের যারপরনাই বিড়ম্বনায় ফেলেছিল। শেষকালে এক মুচলেকা দিয়ে আমাকে গ্রহণ করেছিলেন আমার বাবা-মা। তাঁরা কথা দিয়েছিলেন, উপযুক্ত সময়ে আমাকে তাঁরা কলেজে পাঠাবেন।
১৭বছর বয়সে আমি কলেজ়ে গিয়েছিলাম। তবে, মাস ছয়েকের মধ্যেই আমার মোহভঙ্গ হয়। তখন মনে হয়েছিল, আমার বাবা-মা কত কষ্ট করে, কত পরিশ্রম করে পয়সা সঞ্চয় করেছেন। আমি কলেজে পড়ছি, তার জন্য কত খরচ হচ্ছে! এটা কি ঠিক হচ্ছে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি পড়া ছেড়ে দিলাম। তখন হাতে অফুরন্ত সময়। কিন্তু, থাকার জায়গা নেই। বন্ধুদের ঘরে কোনও রকমে রাত কাটাতাম, খাওয়াদাওয়া জুটত অনেক কষ্টে। আর, সপ্তাহে একদিন সাত মাইল হেঁটে পৌঁছতাম হরেকৃষ্ণ মন্দিরে। সেখানে বিনা পয়সায় ভূরিভোজ আমাকে পরের ক’দিন বেঁচে থাকতে সাহায্য করত।
তখন আমি ক্যালিগ্রাফি শিখেছিলাম। কী সুন্দর শিল্প! সেই শিল্প-সুষমা আয়ত্ত করার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম। বিষয়টি তখন কাজ়ে আসেনি বটে, কিন্তু প্রায় দশ বছর পরে ক্যালিগ্রাফি-জ্ঞানের কল্যাণে আমরা শিল্পে যুগান্তর আনতে পেরেছিলাম। সারা পৃথিবী সেই জ্ঞানের, সেই শিল্প-সুষমার আশীর্বাদধন্য। আজ মনে হয়, আঠারো বছরের সেই দুঃসহ স্পর্ধা, কলেজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বোধহয় ভুল ছিল না। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথের বিন্দুগুলো তো সামনে থেকে জুড়ে দেওয়া যায় না! জুড়তে হয় ক্রমশ পিছনের দিকে। আজকের সিদ্ধান্ত ঠিক বা বেঠিক, বুঝতে গেলে ভবিষ্যতের কোনও একটা সময় থেকে ক্রমশ পিছিয়ে এসে দেখতে হয় আজকের সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় কি না। এ এক গভীর অনিশ্চয়তা, যার অপর নাম বোধহয় জীবন।
২নম্বর গল্পঃ তখন আমার কোম্পানির অবস্থা খুব ভাল। ৪,০০০কর্মী। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য আমি একজন খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আমার সহকারী হিসেবে কোম্পানিতে নিয়ে এলাম। উদ্দেশ্য ছিলঃ আমরা দু’জনে মিলে কোম্পানি পরিচালনা করব, ব্যবসাক্ষেত্র বাড়বে, ইত্যাদি। প্রথম বছরটি ভালই চলল। কিন্তু তারপর, ওই যা হয়, খানিকটা মতান্তর। কোম্পানি সম্পর্কে আমাদের দুজনের ‘ভিশন’ খানিকটা আলাদা। পরিচালনমন্ডলীর সভা বসল। আলাপ-আলোচনার পরে দেখা গেল, পরিচালকরা বা অধিকর্তারা আমার সহকারীর পক্ষে। আমাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। সে এক অদ্ভুত অবস্থা-তিল তিল করে গ্যারেজ থেকে যে-কোম্পানি যুবক হয়েছে, সেই কোম্পানির স্রষ্টাকে, প্রতিষ্ঠাতাকে সরে যেতে হল! তখন আমার বয়স ত্রিশ। সমাজ়ে গণ্যমান্য আমি, সকলে আমাকে চেনেন-সেই অবস্থায় আমি আবার রাজপথে পথিক হয়ে গেলাম! যে বিন্দু থেকে বৃত্তাঙ্কন শুরু হয়েছিল, আমি আবার সেই বিন্দুতে! প্রথম কয়েক মাস ভেবেছি, কোথায় যাব, কী করব! ভাবতে ভাবতে মনে হল, কে যেন আমার মাথা থেকে সাফল্যের ঊষ্ণীষখানি সরিয়ে দিয়ে অসাফল্যের মুক্ত আকাশে আমার একান্ত পরমপ্রিয় ডানা দুখানি মেলতে দিয়েছে।
আবার চলতে শুরু করলাম। নতুন কোম্পানি, নতুন ভাবনা নিয়ে। আরও প্রাপ্তি ছিল। একজন অসামান্যা নারীর সঙ্গে পরিচয় হল, পরিণয় হল। সেই নারী আজ আমার স্ত্রী। আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী, আমার আশ্রয়স্থল।
৩নম্বর গল্পঃ বন্ধুরা, অনেক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনছেন। আর একটু শুনুন। তবে, তার আগে একটি কথা বলে নিই। জীবনে চলার পথে থিতু হবেন না। খুঁজ়ে চলুন, খুঁজুন সেটি, যেটিতে আপনার পরম প্রেম, পরম মমতা। পরম প্রেমের কাজটি খুঁজ়ে পেলে, পরম প্রয়াস উৎসারিত হবে হৃদয় থকে। তখন কর্ম আর প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। সৃষ্টি হবে শ্রেষ্ঠ কর্ম ফল, যেখানে মস্তিস্ক, হৃদয়, হাত-সকলের অপূর্ব সহাবস্থান। বন্ধুরা, তেমন কর্ম খুঁজে চলুন। যতক্ষণ খুঁজে না পান, ততক্ষণ আপনাদের পথ চলা যেন না থামে।
আমার যখন সতেরো বছর বয়স, তখন কোথাও পড়েছিলামঃ “প্রত্যেকদিন যদি এমন ভাবে বাচোঁ, এমন মনে করে বাঁচো যে, সেই দিনটি তোমার জীবনের অন্তিম দিন, তবে একদিন, জেনো একদিন তুমি ঠিকঠাক বাঁচবে।” কথাটা খুব ভাল লেগেছিল। সেই থেকে প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই, আর নিজেকে প্রশ্ন করিঃ এ সকাল যদি শেষ সকাল হয়, তবে যে কাজ করে চলেছি, সেই কাজটি আজও করব কি না। যদি পর পর কিছুদিন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উত্তর আসে, না, এ কাজ আর নয়, তা হলে নিরাপত্তার গহ্বর থেকে নিজেকে ছিন্ন করে আমি আবার ডানা মেলি অসাফল্যের আকাশে।
এই ভাবে আমার পথ চলা। আর, এই ভাবে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ জানতে পারি, আমি ক্যান্সার-আক্রান্ত। তখনও জানি না, প্যাংক্রিয়াস ঠিক কোথায়, ক্যান্সার ঠিক কী। আমার চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা করেন, তারপর বলেন, গুছিয়ে নিন। কাজ ফেলে রাখবেন না। অদ্ভুত অনুভূতি তখন আমার মনে। কতকিছু বলার আছে ছেলেদের! দশ বছরেও সব বলা হবে না। কিন্তু হাতে সময় বড় কম! কয়েকদিন পরে বায়োপসি হয়। জানা যায় যে, দুরূহ ক্যান্সার হয়েছে আমার। তবে, কালো আকাশে একটুখানি আলো এই -অস্ত্রোপচার করে শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে। আমি ভাগ্যবান, আজও বেঁচে আছি, আজও পথ হেঁটে এসেছি আপনাদের আমার জীবনের গল্প বলার জন্য।
বন্ধুরা, কেউ মরতে চায় না। যাঁরা বার বার স্বর্গে যেতে চান, তাঁরাও না। তবু বলব, মৃত্যু হল ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, যার চিন্তা ও চেতনায় জীবন নব নব দিশা পায়। আজ আপনারা যুবক, কিছুদিন পরে বার্ধক্য আপনাদের গ্রাস করবে, যেমন আজ আমাকে করেছে।
হাতে সময় বড় অল্প, তাই don't waste it living someone else's life. Don't be trapped by dogma — which is living with the results of other people's thinking. Don't let the noise of others' opinions drown out your own inner voice. And most important, have the courage to follow your heart and intuition. They somehow already know what you truly want to become. Everything else is secondary.
বন্ধুরা, জীবনের একটি পর্যায়ে জেনেছিলাম Stay Hungry. Stay Foolish. আজ আপনাদের বলি, অন্বেষণের প্রয়াসে ক্ষুধার্ত থাকুন আজীবন। অসীম কৌতূহলের পৃথিবীতে বোকা হয়ে থাকুন। আমার নিজের জীবনে আমি তেমনই hungry ও foolish থাকতে চেয়েছি। আপনাদের জীবনে সেই সত্য হোক।
গল্পকারের গল্প শেষ। তাঁর সঙ্গে পাঠককুলের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়টুকু নিশ্চয়ই প্রবন্ধ রচয়িতার। শত কোটি নমস্কার জানিয়ে নামটি লিখব- স্টিভ জবস্।
Apple কোম্পানির চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার স্টিভ জবস্কে ‘ফরচুন’ ম্যাগাজিন গত বৃহস্পতিবার, ৬নভেম্বর CEO of the decade নির্বাচিত করেছেন। ঘোষণাটি হয়েছে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে। বলা হয়েছে, চারটি চাকার উপর নির্ভর করে হেনরি ফোর্ড যেমন মানব সভ্যতাকে গতিময় করেছিলেন, তেমনই কম্পিউটার, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র এবং সেল ফোনকে সংযুক্ত করে জবস্ এক অসাধারণ শিল্প–সুষমা সৃষ্টি করেছেন, যার তুলনা ইতিহাসে বিরল। সত্যিই বিরল।
আজকের প্রতিযোগিতার যুগে ছোট ছোট শিশুরাও যখন বলে, ফ্রাসট্রেশনে ভুগছে, তখন তাদের স্টিভ জবস্-এর জীবন থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে বলব। ‘Showman’ বলে নয়, ‘born salesman’ বলে নয়, “magician who creates a famed reality-distortion field ” বলে নয়, “tyrannical perfectionist” বলে নয়, একজন অসামান্য উদ্ভাবনপ্রিয় মানুষ বলে।।
[আনন্দবাজার, ২৪/১১/০৯]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৫৩