আমি একটা ছোট্ট ঘাস ফুল।
আমায় দেখতে কেমন? তা আমি কি ভাবে বলি! তবে আমি ছোট্ট-এই ট্টুকুনি। আমার বন্ধুরা –-তোমরা চেননা তাদের! তারা হল – সূর্যশিশির, দুর্ব্বা, শেয়ালকাঁটা- এরা বলে, আমায় দেখতে খুব মিষ্টি। হবেও বা! আমি কি জানি!
আমার মা আমায় খুব ভালবাসে। সব সময় আগলে রাখে ঐ দুষ্টু মানুষের ছেলে, গরু, ছাগলের হাত থেকে। ওদের দেখলে আমার ভীষণ ভয় করে। এই বুঝি মারিয়ে দেয় বা চিবিয়ে খায়।
তবে আমি খুব সুখী। এই বসন্তে আমার জন্ম। প্রথমেতো ক’দিন কুড়ি ছিলাম, সে সময় কি উত্তেজনা! পৃথিবীটা কেমন? ঘাস কি? মানুষ, গরু, ছাগল-এরা কারা? কত মনে প্রশ্ন! হাওয়া জিনিষটাই বা কেমন? কি সুন্দর বাতাস গায়ে লাগে, তাই কি হাওয়া! তাকে দেখতে কেমন? মনে তখন কত প্রশ্ন সব সময় জাগছে!
এখন আমি অ-নে-ক জানি। জানি যে হাওয়াই আমাদের বন্ধু। মাটির তলায় জল থাকে। শিকড় দিয়ে মা তা টেনে আনে পাতায়, তারপর সেখানে হাওয়া থেকে প্রাণ বায়ু নিয়ে রান্না হয়। সেই খাওয়ার খেয়ে আমরা সকলে বাচিঁ। সূর্য আমাদের দেবতা। তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকান যায় না। তিনি যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ শান্তি ও স্বস্তি। তখন আমরা সব বন্ধুরা গল্প করতে করতে, হাসতে হাসতে, একে অপরের গায়ে ঢলে ঢলে পরি। কত যে আমাদের কথা থাকে, সে তোমাদের বলে শেষ করতে পারব না।
ওই দেখনা একটা মানুষের ছানা কেমন হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে -দেখে তো আমাদের পেটে খিল ধরে যাবার জোগার! ওরা না ভারি দুষ্টু! শুধু শুধু আমাদের নখ দিয়ে ছেড়ে। আমি তো তখন খুব ভয়ে থাকি।
সেদিন তো একজন কলমিকে টেনে ছিড়ল! কলমি কত কাঁদল, ওর মার কি চিৎকার! আমাদের মারাও কাঁদল। আমি, সূর্যশিশির তো ভয়ে নীল হয়ে গেছি। উফঃ কি কষ্ট করেই না কলমিকে ওরা মারল! মানুষ এমনিই নিষ্ঠুর।
তবে আমাদের মধ্যে শিয়ালকাঁটা খুব ওস্তাদ। ওকে সবাই সমঝে চলে। সকলে বলতে আবার তোমরা আমাকে বুঝ না! এই যে শিয়ালকাঁটাটিকে দেখছ! ওতো আমায় খুব তোয়াজ করে। কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে! আমায় একটুও বকে না। যদিও আমি ওর থেকে একটু দূরে দুরেই থাকি। মা বলেছে তো, তাই। ওর গায়ে যে বড় বড় কাঁটা!
এমনিতে ও খুব ভাল। কিন্তু কি করি? ওর কাঁটা যে সাংঘাতিক, ছুলেই এক্কেবারে অক্কা!
যান তো, এজন্য ওর মনে খুব দুঃখ। আমরা বন্ধুরা যখন হাসাহাসি করি, তখন ও-ও আমাদের সঙ্গে থাকে, কিন্তু ও নিজেই একটু দূরে দূরে থাকে। ও জানে ওর সংস্পর্ষে আমাদের আঘাত লাগবে। আমি তো ওকে বোঝাই! এর জন্য দুঃখ কর কেন? এটা তো তোমার আত্মরক্ষার উপায়! আমাদের দেখ সকলে দুঃখ দেয়, তবু তুমি আমাদের সর্দার। তোমাকে দুষ্টুরা ভয় পায়।
সূর্যশিশির আছে না! ওর সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব। কিন্তু কি হয়! ও বড় নোংরা। কি করে যান! লুকিয়ে লুকিয়ে মাংস খায়। আমি যদিও ঠিক জানিনা কি ভাবে তা ও জোগার করে। তবে একদিন দেখি কি, ভোরের দিকে খুব মুখ নারছে। ওই মানুষদের পান চেবানোর মত।
আমি জিজ্ঞেস করি-‘কি খাস, ভাই!’ ওতো প্রথমে খুব হকচকিয়ে গেছে। কিছুতেই বলে না! খালি কথা ঘোরায়! খুব ঢঙি কিনা! ঢঙ খুব জানে!
সে যাক্ গে, তারপর কি হল শোন। মাকে গিয়েতো কথাটা বললাম।
মা বললে –‘চুপ চুপ, ও সব ঘেন্নার কথা বলিস নে, আমরা উদ্ভিদ জাত! আমাদের কি মাংস সরাসরি খেতে আছে! কিন্তু পাশে দেখ, সূর্যশিশিরদের! কেমন মশা, মাছি গপ্ গপ্ করে ধরে আর গেলে! মাগো ঘেন্নায় মরে যাই! দিলিতো মেজাজটা সকালেই খারাপ করে!’
আমি তো মার রাগ দেখে দূরে সরে আসি। সে দিন তো আমি সূর্যশিশিরের সাথে কথাই বলিনি! শেষে বিকেলে শিশিরের সে কি কান্না! তখন কি আর ভাব না করে পারি! আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
ওদিকে দেখনা, দুব্বাদের অবস্থা। ওনা খুব নিরিহ। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। যা আমরা বলি তাই শোনে। আমাদের মধ্যে ওদের দুঃখ-কষ্টই সবচেয়ে বেশি। ওই বড় বড় গরু-ছাগলরা নাকি দুব্বা খেতে খুব ভালবাসে। দুব্বাদের নাকি ওরা আচারের মত খায়। ভেবে দেখ, কি রুচি!
মানুষরাও কম নাকি! ওরা হচ্ছে সবচেয়ে পাজি। ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে দুব্বাদের ছিঁড়বে আর ডলে ডলে কাটা-ছেড়ায় লাগাবে, এতে নাকি ওদের রোগ সারবে।
আমার আরেক নতুন বন্ধু হয়েছে। নাম শুনবে? খুব মজার নাম –পাথরকুঁচি। হিঃ হিঃ, ভাবছ পাথর কুঁচো কুঁচো হয়ে আমাদের সঙ্গে ভাব করছে! তা নয়, তা নয়। পাথরকুঁচি এক রকম মাথা-মোটা গাছ। মানে, মাথা-মোটা তোমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে বললাম। আসলে ওদের পাতাগুলো ভিষণ মোটা মোটা। ঐ হেংলু গরুগুলোও খাবে না। তবে ছাগলদের কথা বলা যায় না। ওরা কেমন যেন! পেট মোটা, কালো কালো, আবার সব কেমন চ্যাটাস্-চ্যাটাস্ করে খায়।
তা, পাথরকুঁচিদের কথা বলছিলাম। মা বলে অনেক দিন আগে একটা লোক নাকি এখানে ওদের ফেলে যায়। সে ছিল আজকের পাথরকুঁচির বাবার বাবা। সে তখন খুব অসুস্থ। মায়েরা সব আত্মীয়েরা মিলে তাকে বাঁচায়। তা, পাথরকুঁচিরা খুব কৃতজ্ঞ। ওরা সব সময় সে দিনের কথা স্মরণ করে। ওরা আগে নিজেদের একা, বিদেশি মনে করত।
এখনতো আমি পাথরকুঁচি ফুলদের খুব ভালবাসি। ওরানা, একটা ডালে অনেকে এক সাথে ফোটে। ঐ লম্বা-সরু একটা ডাল, তাতে কত ফুল! একটা, দুটো, তিনটে......কুড়িটা পর্যন্ত ফোটে! কি সুন্দর ঘন্টার মত দেখতে! রঙটাও খুব সুন্দর। কেমন কমলা-লাল। সূর্য ডুব্বার সময় আকাশের রঙ যেমন হয়।
দেখ! একজনের কথা বলতে তো ভুলেই যাচ্ছি -লজ্জাবতী- চেহারাটা ভারী মিষ্টি! আমার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। ও কিন্তু ভীষণ লজ্জা পায়! একেবারে কনে বৌ-এর মত। একটু ছুঁলেই লজ্জা-সরমে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। আবার দেখ কান্ড, তার কাছে সহজে কাউকে ঘেঁসতেও দেয় না। শরীরে ইয়া বড় বড় কাঁটা লাগিয়ে রাখে।
এরা ছাড়াও এই বসন্তে আমার অনেক বড় বড় ফুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। দোপাটি, বেলি, নয়নতারা-আরো কত! বেলির গায়ে কি সুন্দর গন্ধ! আমি আরো অনেক-কে চিনি। গোলাপ, পদ্ম, চন্দ্রমল্লিকা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, গ্যাদা- আরো অনেক। এরা যদিও আমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক সুন্দরী।
গোলাপের নাকি খুব অহংকার! সুন্দরী বলে, তার গায়েও নাকি আত্মরক্ষার জন্য অনেক কাঁটা আছে।
তবে যাই বল, মার মুখে শুনেছি, পদ্ম হল ফুলের রাণী! যেমন রূপ, তেমনি মিষ্টি গুণ! খুব খারাপ পরিবেশে, প্রচন্ড কষ্টে সে বড় হয়েছে। তার ব্যবহারও নাকি খুব মোলায়েম। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী তার উপর অধিষ্ঠান করেন। পদ্মের কি সৌভাগ্য!
গন্ধরাজ তার গন্ধের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু দেখতে নাকি তেমন কিছু নয়! আমি রজনীগন্ধাকে দেখেছি। কেমন সুন্দর ছিম্ছাম চেহারা। গন্ধটাও বেশ হালকা আর স্নিগ্ধ।
চন্দ্রমল্লিকারো নাকি ভারি বাহার।
এরা ছাড়াও কত সুন্দর সুন্দর ফুল আছে এই পৃথিবীতে। এত ফুল একসঙ্গে, এক জায়গায়, সবাই মিলে যদি ফুটি-কি ভালই না লাগবে! তাই না? আমার তেমনি খুব ইচ্ছে হয়।
আমি মার কাছে আরো শুনেছি, অন্য অনেক জায়গায় নাকি কাঁটা গাছেও সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে। তাদের ভারি কষ্ট। সেখানে নাকি জলের ভারি অভাব। চারদিকে খালি বালি আর বালি। বালি কি তা’তাড়ি গরম হয়!
আহাঃ ওদের না জানি কত কষ্ট করতে হয়! বালি যদিও রাতে আবার ঠান্ডা হয়ে যায়।
তবু মাটি সব চেয়ে সুখের। মাটিতে আমার মত ফুল ছাড়াও আরো অনেকে থাকে। আমি দেখি লম্বা লম্বা সব প্রাণী কি সুন্দর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। ওদের নাকি কেঁচো বলে।
ইস্, আমিও যদি ওদের মত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারতাম, তবে কি মজাই না হত!
প্রথমেই যেতাম ঐ দুরের দীঘিটায়। সেখানে নাকি জলটা টল্টল্ করে। ঐ ভোরে আমার গায়ে যেমন হিমের ফোঁটাটা হিরের মত জ্বল-জ্বল করে, তেমনি। ভাবা যায়! সেখানে নাকি এ রকম লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি হিমের ফোঁটারা থাকে। হিমের ফোঁটা এত ঠান্ডা! ভোরে ওর স্পর্ষে আমার মন এত পবিত্র, এত কোমল হয়ে যায়, কি বলব! ওই দিঘীতে তেমন হিমের ফোঁটারা বাস করে!
দিঘী দেখে তারপর যেতাম বনে। সেখানে অনেক উঁচু উঁচু গাছ আছে।
উঁচু গাছ বলতে এখানে ঐ আম গাছটাই আছে। ও কেমন যেন, দাদু-দাদু, খুব গম্ভীর!
বনের গাছ নাকি ওর চেয়েও উঁচু! শুনেছি তারা এ-ত-ও বড় যে আকাশকেই ঢেকে দেয়! ব্যাপারটা তোমরা ভাব! এই সুন্দর নীল আকাশ! তাকে নাকি মাথা তুলে দেখাই যাবে না! আহাঃ তারা বোধ হয় আকাশকেও ছুঁতে পারে। তার সাথে কি কথাও বলে?
আমিও বলি, তবে মনে মনে। আকাশ কত উঁচুতে, সে কি আমার কথা কিছু শোনে, বোঝে!
তবে আমার একজন বন্ধু হয়েছে। সে ঐ উঁচু আকাশে উড়ে যায়। দেখতে আমার ভীষণ ভাললাগে। কে বলতো? তার নাম –প্রজাপতি। আমি ওর মাধ্যমে কত খবর আকাশের কাছে পাঠাই! ঐ হাল্কা মেঘগূলোও নাকি প্রজাপতিকে ছুঁয়ে যায়।
ভাব একবার! যদিও এজন্য ওকে অনেক উঁচুতে উঠতে হয়। একবার আমার অনুরোধে ও ঐ উপরে উঠে গেল। শেষ পর্যন্ত তো আমি দেখতেই পেলাম না! ছোট হতে হতে একদম হাপিস্!
তারপর? তারপর কি হল – সে কি দেখি! প্রজাপতি ডিগবাজি খেতে খেতে নিচে নামছে। নেমেই মার পায়ের কাছে থুপ্ করে পড়ল। কি হাপাচ্ছে! দেখে তো আমি ভয়ই পেয়ে গেছিলাম! সব শুনে মা আমাকে কি বক্লে! তারপর পাতা থেকে টুপ্ করে একফোঁটা জল প্রজাপতির মুখে দিল। তখন সে শান্ত হল। আমার জন্য দেখত কি কষ্টটাই না তাকে পেতে হল! আমার খুব লজ্জাও হচ্ছিল, দুঃখও হচ্ছিল। তারপর শোন না, সুস্থ হয়ে প্রজাপতি কি বলল!
বলল যে আকাশ মেঘকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে সে আমায় ভালবাসে, আমাদের সকলকে সে ভালবাসে। তাই না তার বুকে সূর্য ওঠে! মেঘ ভাসে! বৃষ্টি হয়! ঐ বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে দিয়েই আমরা আকাশের ভালবাসা উপলব্ধি করি।
আমাকে মা, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, প্রজাপতি, শিয়ালকাঁটা, সব ফুলেরা – সকলে খুব ভালবাসে। আমিও সক্কলকে খুব ভালবাসি।
ভিষণ ভালবাসি এই পৃথিবীকে। এখান থেকে যেতে চাই না। তবু যানি একদিন চলে যাব। সকলে এরা কাঁদবে। মা কাঁদবে।
কিন্তু এও জানি আবার আমি ফিরে আসব। এই মায়ের কোলে, এই ভাবেই। আবার তোমাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে।
তখন হয়তো ঐ গরু, ছাগলছানা- সকলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে। তারাও আমায় ভালবাসবে!
মানুষের সাথেও ভাব হবে। তারাও আমায় আদর করবে! তাই না! তোমরা কি বল!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ১২:৫২