আমি ব্যক্তিগতভাবে করিনা। কারণ? সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া পুরোনো কথা,১৯৭১...৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ, কয়েকলাখ মা-বোনের নির্মম ধর্ষণ। কিন্তু আমার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষকেই তো দেখি পাকিস্তান সমর্থন করতে। ঐ যে একটা মোক্ষম যুক্তি পেয়েছেন তারা,খেলার সাথে রাজনীতি মেশানর কি দরকার বাবা? কথা হচ্ছে,কেন নয়? ইরাক বা আফগানিস্তান কি কোনো খেলায় আমেরিকাকে সমর্থন দিবে? বলতে পারেন, এসব তো সাম্প্রতিক অধ্যায়,আর আমাদেরটা তো পুরোনো ব্যাপার। তাহলে শুনে রাখুন,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা ডাচ দের ওপর যা করেছিল,এখনো ভোলেনি তারা।তাই,এই ৭০ বছর পরেও জার্মান-নেদারল্যান্ড ফুটবল ম্যাচ হলে রীতিমত যুদ্ধের দামামা বাজে খেলার বাতাবরণে। আর আমরা!মাত্র ৪০ বছর পরেই ভুলে গেছি রক্তক্ষয় আর ধর্ষণের ভয়ংকর ইতিহাস।
পাকিস্তানী কোন খেলোয়াড় এর ওপর আমার ব্যক্তিগত ঘৃণা নেই।ওয়াসিম আকরাম,অথবা শহীদ আফ্রিদীকে তো ভালই লাগে। কি্ন্তু সমস্যাটা হয় তখনই,যখন তারা পাকিস্তান দেশটার পক্ষ হয়ে খেলতে নামে।অনেকেই আমাকে যুক্তি দেয় আরে বাবা,তুমি পাকিস্তানের ওপর এত ক্ষ্যাপা কেন?এইসব খেলোয়াড় তো আর তখন পাকিস্তানী আর্মি,বা প্রশাসনে ছিলনা। ঠিক কথা।আমিও তো বলি,তাদেরকে আমি ঘৃণা করিনা,কিন্তু যখন তারা পাকিস্তান দলের পক্ষ হয়ে খেলতে নামে,তখন আমি তাদের তীব্র বিরোধী না হয়ে পারিনা।
এখানে আসলে বলতে চাইছি, পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা যখন ক্রিকেট খেলতে নামে, তখন তারা তো পাকিস্তানেরই প্রতিনিধিত্ব করে,তাইনা? পাকিস্তান দেশটার, সেই দেশ, ৭১ এর কড়াল ঘাতক। খেলোয়াড়েরা খেলে, সেই সাথে খেলে পাকিস্তান। ক্রিকেট ভালো খেলে বলে এখন আপনি পাকিস্তান পাকিস্তান বলে চিৎকার করবেন? আফ্রিদি ছক্কা মারলে হাততালি দিন, সমস্যা নেই, শোয়েব আখতারের ইয়র্কার দেখে অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। স্পোর্টিং স্পিরিট তো এতটুকু দেখাতেই পারেন। কিন্তু পাকিস্তানের জয়ে যখন উদ্বাহু নৃত্য করেন, তখন মনে পড়েনা ২৫শে মার্চের কালোরাত্রির কথা? ১৪ই ডিসেম্বারের বুদ্ধিজীবী নিধনের কথা? আরো অজস্র মৃত্যু আর ধর্ষণের কথা? লক্ষ শরণার্থীর কথা, যারা শেষ সম্বলটুকু নিয়ে চোখের জল সম্বল করে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। ভুলে গেছেন সব? সাঈদ আনোয়ার খুব ভালো মানুষ, মানলাম। ওয়াসিম আকরাম অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। আমি তাদের ঘৃনা করিনা। কিন্তু যখন তারা একসাথে,একদলে, পাকিস্তান হয়ে যায়, তখন আমার মনে পড়ে পুরোনো প্রবন্চনার কথা। তখন আমি দেখি, খেলছে পাকিস্তান, সেই বর্বর দেশটা। তখন আমার স্পোর্টিং স্পিরিট উবে যায় ঘৃনার ঝড়ো হাওয়ায়।
সব ক্ষত কি সময়ের সথে সাথে মুছে যায়? মুক্তিযুদ্ধে যদি আপনার মা ধর্ষিত হত,আপনার বাবা বেয়নেটের নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত হত,তখন কোথায় থাকত আপনার এত পাকিস্তান প্রীতি??আমি অনেককেই বলতে শুনেছি "আমি পাকিস্তানকে ঘৃণা করি,কারণ ১৯৭১ এ তারা আমার পরিবারের প্রতি এই....এই করেছিল। "অন্যদের কি অবস্থা?আক্রমনটা সরাসরি নিজের ওপর না আসলে গায়ে লাগবেনা,না?কেন এভাবে ভাবতে পারেননা যে, যেসব নির্মম ঘটনা ঘটেছিল,সেসব আপনার,আমার মা-বাবা,ভাই-বোনের ওপরই ঘটেছিল, বা ঘটতে পারতো?যদি তাই হত, তাহলে কি পারতেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করতে? একটু ভেবে বলুন প্লিজ!
ওহ! আরো একটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি, ইসলামি রাস্ট্রের দোহাই! হাহাহা। আমার মনে হয়, এবং এটা মনে হয় সঠিক অনুমান,পাকিস্তান যদি কোন ইহুদি, খ্রিস্টান, বা হিন্দু রাস্ট্র হত, তাহলে আজ মনে হয় আমার আর এই পোস্ট লিখতে হতনা।
পাকিস্তান এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। পাকিস্তানের স্কুলের পাঠ্যবইতে৭১ সংক্রান্ত ব্যাপার সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়।ফেসবুকে আমাদের একটা গ্রুপ আছে।ওখানে মাঝেমাঝে পাকিস্তানের এই প্রজন্মের ছেলে-পেলেরাও আসে। কি তাদের ভাষা! আর কি তাদের কনসেপ্ট আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে! তবে আমার মূল সমস্যা তাদের নিয়ে না। তারা পরাজিত পক্ষ, পরাজিত প্রজন্ম। চুলোয় যাক। আমাদের গৌরবগাঁথা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। কিন্তু পরাজয়ের ছাইভস্ম থেকে তাদেরকে উঠিয়ে এনে মহিমান্বিত করছে আমারই দেশের মানুষেরা। আমার কাছের মানুষেরা। স্বজনেরা, বন্ধুরা! ক্রিকেটের দোহাই দিয়ে, ধর্মের দোহাই দিয়ে! হায়রে বিস্মৃতিপরায়ণতা, নির্লজ্জতা! ছিঃ!
না! এরকম আমরা চলতে দেবোনা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এমন হবেনা। আমি আমার অনুজদের শিখিয়েছি কেন পাকিস্তান সাপোর্ট করা যাবেনা। কেন তারা ঘৃণার পাত্র। তাদেরকে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছি। হ্যাঁ ঘৃণা। নির্ভেজাল ঘৃণা। এই ঘৃণার আগুন আপনিও ছড়িয়ে দিন সবখানে, সবার মাঝে।