অভিজাত শ্রেণীর অনেকে প্রায়ই নিজেদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সোন্দর্য্য, আকৃতি-প্রকৃতি নিয়ে এমন চিন্তিত হয়ে পড়ে যে সেগুলো “ঠিকঠাক” করার জন্য সার্জনের ছুড়ি কাঁচির নীচে শু'তেও তাদের আপত্তি থাকেনা। প্লাস্টিক সার্জারি কিংবা কসমেটিক সার্জারি মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদান হলেও বর্তমানে এর অধিকাংশ ব্যবহার হচ্ছে এই নিজেদের শরীর নিয়ে খুঁত খুঁতে অভিজাতদের সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজে। নিজেদের শরীর নিয়ে এই অতি খুঁতখুঁতে প্রবণতাকে অনেক ক্ষেত্রেই বডি ডিসমরফিক ডিসঅরর্ডার(বিডিডি) বলা হয়। ব্যাক্তি বুর্জোয়ার এই ধরণের ‘সৌন্দর্য্য বিলাসিতা’র সাথে তার অর্থনৈতিক ভিত্তি ও শ্রেণীগত বৈশিষ্টগুলো সম্পর্কিত। এই অর্থনৈতিক ও শ্রেণীগত বৈশিষ্টের কারণে একই ভাবে বিশেষত অনুন্নত/উন্নয়নশীল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মধ্যেও যখন এই বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার দেখা যায় তখন আমরা দেখি রাষ্ট্রীয় প্লাষ্টিক/কসমেটিক সার্জারি। এলিট নারী-পুরুষ যেমন তার শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গের সোন্দর্য্য বর্ধন করার ব্যাপারে অবসেসড থাকে, এসব বুর্জোয়া রাষ্ট্রও তেমনি বিভিন্ন উপলক্ষে রাজধানী বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশের কৃত্রিম বিউটিফিকেশান বা সৌন্দর্য্য বর্ধনের বিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ২০১১ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম এমনই রাষ্ট্রীয় প্লাষ্টিক সার্জারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বরাবরের মতোই যার নির্মম শিকার গরীব মানুষ- ভিক্ষুক, টোকাই, হকার ও ফুটপাতবাসী শ্রমজীবি মানুষ।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের কসমেটিক সার্জারি
গত ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ করে স্টেডিয়াম, সড়ক, হাইওয়ে, এয়ারপোর্ট ইত্যাদির পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে, নগরের সৌন্দর্য্য বর্ধনের নামে হকার-ভিক্ষুক-ছিন্নমুল-বস্তিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করে নগরের বাইরে একরকম অস্থায়ী কনসানট্রেশান ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে বাংলাদেশেও একই ধরণের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। গত ২৬ ডিসেম্বরে এয়ারপোর্ট থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও মিরপুর স্টেডিয়ামে যাতায়াতের জন্য ঢাকার ১৭ টি রাস্তা সহ মোট ৪.৬৬ লক্ষ বর্গমিটার রাস্তা,ফুটপাত, ডিভাইডারের সৌন্দর্য্য বর্ধন করার কাজ শুরু হয়ে প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশান এবং আরো ৪২ টি কনসোর্টিয়াম এই কাজগুলো করছে। এরজন্য খরচ হচ্ছে ৫৪ কোটি টাকা।(সূত্র: ডেইলিস্টার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১১ Click This Link)
একই ভাবে চট্টগ্রাম নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশান ও সিডিএ মিলিত ভাবে ৮৬ কোটি টাকার কাজ করছে যার মধ্যে রয়েছে তিনটি কৃত্রিম ঝর্ণা, তিনটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আইকন, বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ভাস্কর্য, অসংখ্য বিলবোর্ড বসানো ইত্যাদি।(সূত্র: ডেইলিষ্টার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১১, Click This Link
আর কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ানো সৌন্দর্য্যের মধ্যে ময়লাদাগের মতোই বেমানান নগরের ভাসমান মানুষ, ভিক্ষুক, টোকাই, হকার ও ফুটপাতবাসী শ্রমজীবি মানুষ। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের সৌন্দর্য্য বর্ধনের প্রয়োজনেই ময়লা আবর্জনা পরিস্কারের সাথে সাথে নগরদুটিকে ভবঘুরে-ভিক্ষুক “মুক্ত” করা হচ্ছে। আর বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে করা এইসব কাজকে মোটেই বেআইনি বলা যাবে না কারণ এর জন্য ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১০ চুড়ান্ত করা হয়েছে। এই আইন অনুসারে:
কোন ব্যক্তির বসবাসের জায়গা বা রাত যাপন করবার মতো সুনির্দিষ্ট কোন জায়গা না থাকলে, ঘোরাফিরা করে জনগণকে অহেতুক বিরক্ত বা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত হলে তিনি ভবঘুরে বলে গণ্য হবেন। তবে ধর্মীয় কাজে বা জনহিতকর কাজে লিপ্ত হলে তিনি ভবঘুরে হিসেবে গণ্য হবেন না।
ভবঘুরে আইন বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে একটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা হবে। এ বোর্ডের সদস্য থাকবেন ১৮ জন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। এ আইন অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ভবঘুরে ব্যক্তি আটক করতে পারবেন। ভবঘুরে ব্যক্তি আটকের পর ভবঘুরে অভ্যর্থনা কেন্দ্রে পাঠান হবে। সেখান থেকে বিভিন্ন ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রে আটক ব্যক্তিদের রাখা হবে। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দু'বছর ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রে আটক রাখা যাবে। কোন ব্যক্তি ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে পালিয়ে গেলে তার তিন মাস জেল হবে।
Click This Link
আবার জোর জবদস্তির অভিযোগ যেন না উঠে সেজন্য কি চমৎকার গণতান্ত্রিক উপায়ে চট্টগ্রামের মেয়র ভিক্ষুকদেরকে দিয়ে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছেন:
“ভিক্ষার হাত পেতে দেশকে কলংকিত করব না। দেশের ১৬ কোটি মানুষের সম্মান রক্ষার্থে চট্টগ্রামের রাস্তায় আর ভিক্ষা করব না।”
সূত্র: Click This Link
অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ তার “ফুটপাত ইজ নট হেডপাত” প্রবন্ধে বলেছিলেন:
“এদেশে শোষণের কবলে পড়ে জমি ভিটেবাড়ি হারানো বেআইনি নয়। এটা আইনসম্মত। এতে কোন আইনগত বাধা নেই। কিন্তু সর্বস্ব হারিয়ে কাজ ও আশ্রয়ের সন্ধানে শহরে এসে কোথাও মাথা গোজার ঠাই করতে না পেরে ফুটপাতে পিঠপাতা বেআইনি, যার শাস্তি হলো এলোপাথারি পিটুনি। কারণ ফুটপাত তো পা পাতার জন্য, মাথা বা পিঠ পাতার জন্য নয়। ফুটপাত ইজ নট হেডপাত। ”
কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন ১৯৮৮ সালে। বেচে থাকলে দেখতেন দেশের আরো “উন্নতি” হয়েছে, ফুটপাতবাসীর সংখ্যা বেড়েছে এবং তাদের জন্য এখন কেবল এলোপাথারি পিটুনি নয়, একেবারে আইন করে জেলও বরাদ্দ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় প্রদর্শন কামের অর্থনৈতিক ভিত্তি
শ্রম শোষণ করে মুনাফা অর্জনের সাথে ভোগ-বিলাস/বিত্তের প্রদর্শনের বাসনা ও সামর্থ্যের সম্পর্কটা সরাসরি। আবার শিল্প পুঁজির তুলনায় বণিক পুঁজি আর লুটেরা পুঁজির সাথে এই প্রদর্শন কামের ঘনিষ্ঠতা বেশি। ব্যাবসায়ী, ব্যাংক মালিক, ফাটকাবাজ কিংবা চোরাচালানি করা পুজিপতির জন্য মুনাফা পুর্নবিনিয়োগকরা ততটা বাধ্যতামূলক নয় যতটা শিল্পপুঁজির মালিক গোষ্ঠীর বেলায় হয়ে থাকে, ফলে ব্যাক্তিগত ভোগ বিলাসের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের কোন অভাব লুটেরা বা বণিক পুজির হয় না। তাছাড়া চকচকে থাকাটা তাদের ব্যাবসার ব্র্যান্ড ভ্যালুর সাথেও যুক্ত। একই ভাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রেও যখন শিল্প-কৃষির উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বদলে সেবাখাত, আমদানী-রপ্তানি ও বিদেশী বিনিয়োগ/ঋণ/খয়রাত নির্ভর অর্থনীতি অর্থাৎ 'দোকানদারী অর্থনীতি'র প্রাধান্য তৈরী হয় তখন তার ব্র্যান্ড ভ্যালুর জন্যও একই ভাবে এই সৌন্দর্য্য প্রদর্শন ভীষণ জরুরী। এই নির্ভরশীল বুর্জোয়াদের সম্পর্কে ফ্রান্জ ফানো বলেছিলেন:
“বুর্জোয়াদের এমন কোন অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকেনা যে এরা গোটা কতক পয়সা দেশবাসীর দিকে ছুড়ে দিয়ে বার্কি অর্থে নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করবে। তাছাড়া, এরা যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের পকেট ভরার ধান্দায় আচ্ছন্ন থাকে। ফলে দেশের অর্থনীতি ক্রমশ মন্দা আক্রান্ত হতে থাকে। আর এই মন্দা পরিস্থিতি লুকানোর জন্য, নিজেদেরকে আশ্বস্ত করবার জন্য এবং গর্ব করার জন্য কিছু একটা নিজেদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য এরা রাজধানীতে একের পর এক বড় বড় দালান বানায় আর বিভিন্ন ভাবে ইজ্জত বাড়ানোর জন্য কেনাকাটায় (প্রেসটিজ এক্সপেন্স) পয়সা ঢালতে থাকে।”
ফলে এদেশে আদমজী সহ অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ হয় আর অন্যদিকে একটার পর একটা শপিং মল তৈরী হয়, গ্রামগুলোকে অন্ধকারে রেখে, সেচের পানি-বিদ্যুত বন্ধ করে হলেও নগরের বিপনী বিতান আলোকিত থাকে, নতুন নতুন কারখানা গড়ে না উঠেনা, কৃষির উন্নয়ণ হয় না কিন্তু বড় বড় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, মোবাইল(এমনকি বিমানবন্দর) ইত্যাদি যোগাযোগ অবকাঠামোর উপর প্রাধান্য দেয়া হয় যেন আমদানী-রপ্তানি, চোরাচালান আর কমিশনের খেলা নির্বিঘ্নে চলে।
এক কথায়, রাষ্ট্রের কাছে এখন জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের চেয়ে যেকোন মূল্যে “প্রেস্টিজ” বাড়ানোর কাজে অর্থ ব্যয় বেশি জরুরী, ঢাকা চট্টগ্রামের সন্দৌর্য বর্ধনের জন্য সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় তৎপরতা তারই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:৪৮