আসুন, আজ আবার কিছু হিসাবপাতি করি- মানে কিছু যোগ বিয়োগ গুন ভাগ আর কি।
কুপের হিসাব
আমাদের দেশে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী কোম্পানি মিলে মোট ৭৫টি অনুসন্ধান কুপ খনন করা হয়েছে- তার মধ্য দিয়ে ২৫ টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে(১)। অর্থাৎ সাফল্যের হার ৭৫:২৫ বা ৩:১ (এই হিসাব ১৯১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত অনুসন্ধানী কূপ খনন করা হয়েছে তার, পূর্বের চেয়ে এখন সাফল্যের হার অনেক ভালো)। যদিও এই হার বাপেক্স/পেট্রোবাংলার ক্ষেত্রে আরো ভালো, কেননা পেট্রোবাংলা/বাপেক্স ১৮ টি অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে(২)। সেক্ষেত্রে সাফল্যের হার ২.২৫:১। ১৯৮৯ সালে বাপেক্স গঠনের পর থেকে যদি হিসাবটি দেখি - তবে দেখবো বাপেক্স ৪ টি অনুসন্ধানী কুপ খনন করে ৩ টি গ্যাসক্ষেত্র পেয়েছে (সাফল্যের হার ১.৩৩:১)। অবশ্য বাপেক্সের ওয়েবসাইটে এই হারকে ২:১ বলে উল্লেখ করা হয়েছে(৩)।
তারপরেও ধরে নিচ্ছি- গড়ে বাংলাদেশে ৩টি কুপ খনন করলে ১ টিতে গ্যাস পাওয়া যাবে। ---------------------------------- (ক)
ব্যয়ের হিসাব
বাপেক্স বা এর পূর্বতন পেট্রোবাংলা ও ওজিডিসি এ পর্যন্ত যে ১৮ টি অনুসন্ধান কুপ খনন করেছে সেগুলোর ব্যয়ের দিকে দেখলে যাবে সর্বনিম্ন ব্যয় ৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা (জালদী, ১৯৬৪-৭০ সাল) এবং সর্বোচ্চ ব্যয় ১০৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা (গভীরতম কুপ ফেঞ্চুগঞ্জ১, ১৯৮৫-৮৮ সাল)। গভীরতম কুপ ৪৯৭৭ মিটার গভীর হলেও বাংলাদেশে খননকৃত কুপগুলোর গড় গভীরতা ৩০০০ থেকে ৪০০০ মিটার, এবং সর্বশেষ ২০০৪ সালে কুপটির জন্য ব্যয় হয়েছে ৫২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা (৪)। সময়ের সাথে টাকার মূল্যমান পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণে আমরা বর্তমানের ৩টি প্রজেক্টের ব্যয়ের দিকে একটু দৃষ্টি দেই। মোবারকপুর (৫), কাপাসিয়া(৬) ও সুন্দলপুরের(৭) অনুসন্ধান কুপের জন্য প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে (একনেক কর্তৃক অনুমোদিত) যথাক্রমে ৫৬.০৪, ৫৮.৯৫ এবং ৭৩.৬৫ কোটি টাকা।
গড়ে ধরি প্রতিটি অনুসন্ধান কুপের জন্য খরচ ১০০ কোটি টাকা। ------------------ (খ)
একইসাথে শাহবাজপুরের ২য় কুপ খনন (মূল্যায়ন ও উন্নয়ন কুপ) এবং উৎপাদনের জন্য প্ল্যান্ট বসানো সহ অন্যান্য খরচের জন্য প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৩.৫৯ কোটি টাকা (৮)।
গড়ে ধরি, উৎপাদনের খরচসহ উন্নয়ন কুপ খনন বা ওয়ার্ক ওভারের খরচ সহকারে অনুসন্ধান কুপ খননের জন্য ব্যয় ২০০ কোটি টাকা --------------------------------------------(গ)
ক এ আমরা ধরেছি প্রতি তিনটা কুপ খনন করা হলে একটি কুপ থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে। ফলে দুটি কুপ শুষ্ক ও একটি গ্যাস কুপ ধরে হিসাব করি।
সুতরাং, বাপেক্সের একটি সফল কুপ থেকে উৎপাদনের জন্য মোট ব্যয়ঘবে = খ *২ + গ = ১০০*২ + ২০০ = ৪০০ কোটি টাকা ------------------- (ঘ)
কুপ প্রতি গ্যাসের হিসাব
বাংলাদেশ গড়ে প্রতি গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ ৬৮৪ বিসিএফ। কিন্তু আমরা হিসাবটি প্রতি কুপ অনুযায়ি করবো।
এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের মজুদ কত এবং রিকভারেবল মজুদ কত সেটা দেখি (৯)। ঊৎপাদনে আছে এমন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মোট মজুদ হলো ২৬,৮৬৭ বিসিএফ, রিকভারেবল মজুদ ১৯,৪১৩ বিসিএফ। এখনও উৎপাদন শুরু হয়নি এমন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মোট মজুদ হলো ১০০৮ বিসিএফ, রিকভারেবল মজুদ ৬৯৪ বিসিএফ। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মোট মজুদ হলো ৭৪৮ বিসিএফ, রিকভারেবল মজুদ ৫২৪ বিসিএফ। সর্বমোট হিসাব করলে দাঁড়ায়, থ্রি পি মজুদ হলো ২৮৬১৯ বিসিএফ, টু পি রিকভারেবল মজুদ ২০৬৩২ বিসিএফ।
উৎপাদনে আছে এমন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুদটিকেই (১৯৪১৩ বিসিএফ) আমরা নিচ্ছি। বর্তমানে দেশী-বিদেশী মিলে সর্বমোট ৭৯টি কুপ থেকে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে (১০)।
সুতরাং গড়ে প্রতি কুপ থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে = ১৯৪১৩ / ৭৯ = ২৪৫ বিসিএফ --------------------- (ঙ)
গ্যাসের দাম
মডেল পিএসসি-২০০৮ এ বর্ণিত সূত্র অনুসারে ১ মেট্রিকটন HSFO এর (তাপানুপাতিক হিসাবে) দাম সর্বোচ্চ ১৮০ ডলার, এবং আগের পিএসসি তে এটা ছিল ১৪০ ডলার।
এখন ১ মেট্রিক টন HSFO এর দাম= ৪১.৩৭ MSCF গ্যাসের দাম
সুতরাং আগের পিএসসি অনুসারে ১ MSCF গ্যাসের দাম = ১৪০/৪১.৩৭ ডলার = ৩.৩৮ ডলার = ২৩৬ টাকা
১ বিসিএফ গ্যাসের দাম হবে = ২৩৬* ১০০০*১০০০ টাকা
সুতরাং, ২৪৫ বিসিএফ গ্যাসের দাম = ২৩৬*২৪৫*১০০০০০০ টাকা = ৫৭৮২ কোটি টাকা --------------------------------------- (চ)
আর মডেল পিএসসি-২০০৮ অনুসারে, ১ MSCF গ্যাসের দাম = ১৮০/৪১.৩৭ ডলার = ৪.৩৫ ডলার = ২৩৬ টাকা = ৩০৪ টাকা
১বিসিএফ গ্যাসের দাম = ৩০৪ * ১০০০* ১০০০ টাকা
সুতরাং, ২৪৫ বিসিএফ গ্যাসের দাম = ৩০৪*২৪৫*১০০০০০০ = ৭৪৪৮ কোটি টাকা --------------------------------------- (ছ)
বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে মোট ১৮৩৪১.৫১ এমএমসিএম বা ৬৪৭.৭২ বিসিএফ গ্যাস ৭৬৯৪ কোটি টাকায় বিক্রয় করা হয়েছে (১১)। সে হিসাবে, ১ MSCF গ্যাসের দাম = ১১৯ টাকা
১ বিসিএফ গ্যাসের দাম = ১৯*১০০০*১০০০ টাকা
সুতরাং, ২৪৫ বিসিএফ গ্যাসের দাম = ২৪৫*১১৯*১০০০০০০ = ২৯১৫.৫ কোটি টাকা ----------------------------------------- (জ)
সিংগাপুর মার্কেটে প্রতি ব্যারেল HSFO এর দাম ছিল গত ১ এপ্রিল ২০০৯ এ ৪০ ডলার, ১ মে ২০০৯ এ ৪৭ ডলার, ১ জুন ২০০৯ এ ৬২ ডলার এবং ১ জুন ২০০৯ এ ৬৬ ডলার (২০০৮ সালে এটা সর্বোচ্চ ১৪০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল)। ১ জুন ২০০৯ এর দাম ধরলে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে, ১ MSCF গ্যাসের দাম = ১১.৬৯ ডলার = ৮১৮ টাকা
১বিসিএফ গ্যাসের দাম = ৮১৮ * ১০০০* ১০০০ টাকা
সুতরাং, ২৪৫ বিসিএফ গ্যাসের দাম = ৮১৮*২৪৫*১০০০০০০ = ২০,০৪১ কোটি টাকা-------------------------------------------- (ঝ)
অনুসিদ্ধান্তসমূহ
উপরের হিসাবকিতাব থেকে নীচের সিদ্ধান্তগুলো আমরা খুব সহজেই টানতে পারি:
১। তিনটি কুপ খননের বিপরীতে একটিতে সফলতা ধরলে- ২০০৪১ কোটি টাকার গ্যাস আমরা পেতে পারি, অর্থাৎ মাত্র ৪০০ কোটি টাকা খরচে ২০০৪১ কোটি টাকার গ্যাস পাওয়া সম্ভব। (২০০৪১ কোটি টাকার গ্যাস বলছি - কারণ এটাই গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজারদর- অর্থাৎ ঐ পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি করলে বা একই পরিমাণ আমরা আমদানি করতে গেলে ২০০৪১ কোটি পাওয়া যাবে বা দিতে হবে।)
২। এই গ্যাস স্থানীয় বাজারদরে বিক্রি করলেও পাওয়া যাবে ২৯১৫.৫ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রেও লাভ থাকে প্রায় (১৫৯২.৫ - ৪০০ ) ২৫১৫.৫ কোটি টাকা।
৩। ৮০%-২০% পিএসসির আওতায় বিদেশীদের হাতে তুলে দিলে এবং ৮০% গ্যাস ওদের কাছ থেকে সিলিং কৃত মূল্যে ক্রয় করলে দাঁড়ায়:
পুরাতন পিএসসি অনুসারে:
বিদেশীদের দিতে হবে (৫৭৮২*৮০%) ৪৬২৫.৬ কোটি টাকা। এই টাকায় অবশ্য আমরা পুরো ২৪৫ বিসিএফ গ্যাস পাবো। অর্থাৎ বাপেক্স নিজে উৎপাদন করলে যেখানে খরচ ৪০০ কোটি টাকা, সেখানে বিদেশীদের হাতে তুলে দিলে খরচ ৪৬২৫.৬ কোটি টাকা।
এই ২৪৫ বিসিএফ গ্যাস বর্তমান স্থানীয় বাজারদরেই যদি জনগণকে দেয়া হয়, তবে সরকারের লস বা ঘাটতি (৪৬২৫.৬ - ২৯১৫.৫) ১৭১০.১ কোটি টাকা।
যদিও ৪৬২৫.৬ কোটি টাকা খরচ করে আমরা শেষ পর্যন্ত ২০০৪১ কোটি টাকার গ্যাস পাচ্ছি।
৪। বিদেশী কোম্পানী যদি আন্তর্জাতিক বাজারদরের লোভে আমাদেরকে গ্যাস না দিয়ে তাদের ৮০% রপ্তানী করে দেয়, তবে হিসাবটা দাঁড়ায়:
৪৬২৫.৬ কোটি টাকার জায়গায় তারা পাবে (২০০৪১*৮০%) ১৬০৩২ কোটি টাকা।
আমরা অবশ্য পাবো ৪০০০ কোটি টাকার গ্যাস, কিন্তু আমাদের হারাতে হচ্ছে ১৬০৩২ কোটি টাকার গ্যাস। এই ২০% গ্যাস স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে পাওয়া যাবে ৫৮৩.১ কোটি টাকা।
৫। কোন কারণে যদি আমাদের ভাগের ২০% ও আমরা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হই এবং বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হই, তাহলে হিসাবটা দাঁড়ায়:
ওরা গ্যাস রপ্তানী করে পুরোটাই পাবে, মানে হাতিয়ে নিবে ২০০৪১ কোটি টাকা- বিনিময়ে আমাদের দিতে হবে (৫৭৮২*২০%) ১১৫৬.৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ যা দাঁড়ায়- আমাদের ২০০৪১ কোটি টাকার গ্যাসক্ষেত্রটি আমরা মাত্র ১১৫৬.৪ কোটি টাকায় বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছি।
আরো কিছু হিসাবপাতি
যারা কোনভাবেই উপরের হিসাবকিতাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছেন না, তাদের জন্য আরো কয়েকটি তথ্য হাজির করছি:
২০০২ সাল পর্যন্তও আমাদের গ্যাসের ৯০-৯৫% গ্যাস আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতাম। সেটা এখন নেমে দাঁড়িয়েছে ৪৭%। এই ৪৭% গ্যাস সরকার রাষ্ট্রীয় গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তিনটির কাছ থেকে কেনে প্রতি হাজার কিউবিক ফুট ২৫ টাকায়। যেখানে উপরের হিসাব মোতাবেক বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে খরচ হয় ২৩৬ টাকা (আবু আহমেদের হিসাব মোতাবেক ২৫০ টাকা)। মজার ব্যাপার হচ্ছে- প্রতি হাজার কিউবিক ফিট এই ২৫ টাকায় বিক্রি করেও এবং তার বাইরেও সরকারকে রাজস্ব যুগিয়েও বিজিএফসিএল ও সিজিএফএল প্রতিবছর মুনাফা করে (১২)।
চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত
আমাদের দ্রুত এবং খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। আমাদের গ্যাস সম্পদ কারা তুলবে? আমরা, না বিদেশী বেনিয়ারা? ওদের সাথে নতুন করে পিএসসি করবো, না করবো না? আগের পিএসসি গুলো বাতিল করবো, না করোবো না?
এটাই কিন্তু সময়। এখনই অনেক দেরী করে ফেলেছি- পরে কিন্তু অনেক বেশী দেরী হয়ে যাবে, তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না।
কৈফিয়ৎ
১। হিসাবপাতির একটা বড় অংশই এজাম্পশন থেকে নেয়া হয়েছে, যদি এজাম্পশনগুলো বাস্তব তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করেই নেয়া হয়েছে।
২। ৪০০ কোটি খরচের হিসাবটি অবশ্যই অনশোরের জন্য করা। অফশোরের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশ বড়ই হবে।
৩। এই হিসাবপাতিতে আমাদের গ্যাসের প্রয়োজনের হিসাবটা আসেনি। আমরা কি আমাদের সামান্য গ্যাসও হারাতে পারি?
তথ্যসূত্র:
১। Click This Link
২। Click This Link
৩। http://www.bapex.com.bd/achievement.html
৪। মাসিক অগ্রগতির প্রতিবেদন জুন ২০০৯, বাপেক্স ; পৃষ্ঠা: ৩৪
৫। ঐ; পৃষ্ঠা: ০৪
৬। ঐ; পৃষ্ঠা: ০৬
৭। ঐ; পৃষ্ঠা: ০৭
৮। ঐ; পৃষ্ঠা: ০২
৯। পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন ২০০৭ (Click This Link)
১০। Click This Link
১১। Click This Link
১২। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৫