রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে লালন পালন করতে সরকারের অব্যাহত লোকসানের কথা শুনে আমরা হায়হায় করে উঠি, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানীকে যখন সরকার কোলে পিঠে নিয়ে আদর-সোহাগ করে তখন সেটা নিয়ে কই কারো তো কোন রা নেই! এবারে তাহলে এ ধরণের কিছু আদর-সোহাগের নমুনা দেখি। এই আদর সোহাগের কেতাবি নাম হলো "ইনসেনটিভ"। বাংলাদেশ সরকারের দেয়া প্রধান "ইনসেনটিভ"সমূহ নিম্নরূপঃ
১। ট্যাক্স মওকুফঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে বিনিয়োগের জন্য ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজকে ৫ বছর এবং খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহীতে বিনিয়োগের জন্য ৭ বছরের ট্যাক্স মওকুফ করা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগকারী এন্টারপ্রাইজের জন্য এই মওকুফ ১৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। ট্যাক্স মওকুফের বিষয়টি একটি এন্টারপ্রাইজের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু হবে।
এক্সিলারেটেড ডেপ্রিসিয়েশন এলাউয়েন্সঃ যেসমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স মওকুফ সুবিধার আওতায় আসেনি- তাদের জন্য রয়েছে এক্সিলারেটেড ডেপ্রিসিয়েশন। যদি শিল্প প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো বা প্ল্যান্ট ঢাকা, খুলনা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম শহরে বা এসব শহর থেকে ১০ কিমি দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত হয়- তবে সেই প্রতিষ্ঠান তার মেশিনারি বা প্ল্যান্টের ১০০% পর্যন্ত, এবং দেশের অন্য যেকোন স্থানে অবস্থিত হলে ৮০% পর্যন্ত এক্সিলারেটেড ডেপ্রিসিয়েশন এলাউয়েন্স পাবে।
২। শুল্কঃ ক্যাপিটাল মেশিনারী এবং স্পেয়ার পার্টস আমদানীর ক্ষেত্রে ১০০% রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আমদানী শুল্ক দিতে হবে না।
৩। কর আইনঃ ক) দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ডাবল ট্যাক্সাশন থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে,
খ) আয়কর অধ্যাদেশের উপযুক্ত শিডিউল অনুযায়ী বিশেষ শিল্প প্রতিষ্ঠানের দক্ষ বিশেষজ্ঞ ৩ বছর পর্যন্ত আয়কর মওকুফ পাবে।
৪। রেমিট্যান্সঃ বিনিয়োগকৃত মূলধন, মুনাফা এবং লভ্যাংশের সম্পূর্ণটাই নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের সুবিধা থাকবে।
৫। মালিকানাঃ বিদেশী বিনিয়োগকারী এদেশে সম্পূর্ণ নিজ মালিকানায় অথবা যৌথ মালিকানায় শিল্প গড়ে তুলতে পারবে।
৬। রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ইনসেনটিভসমূহঃ
ক) ক্যাপিটাল মেশিনারি ও স্পেয়ার পার্টস (ক্যাপিটাল মেশিনারির ১০%) আমদানীর ক্ষেত্রে শুল্ক মুক্ত সুবিধা।
খ) সেলস এগ্রিমেন্টের চুড়ান্ত এবং নিশ্চিত পত্রের বিপরীতে ৯০% পর্যন্ত ঋণ সুবিধা।
গ) দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান আলাদা বিশেষ হারে সুযোগ ও সুবিধা লাভ করবে।
ঘ) নিষিদ্ধ ও রেসট্রিক্টেড কাঁচামাল, যা রপ্তানী পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজন, বিনা বাঁধায় আমদানী সুবিধা।
ঙ)সরকারের "থ্রাস্ট সেক্টর" হিসাবে চিহ্নিত রপ্তানী শিল্প প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে।
চ) হস্ত ও কুটীর শিল্প থেকে রপ্তানী আয়ের পুরোটাই আয়কর মওকুফ পাবে। অন্যান্য শিল্প ৫০% আয়কর মওকুফ সুবিধা পাবে।
ছ) রপ্তানী ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সুবিধা আরো বাড়ানো হবে এবং জোরদার করা হবে।....... প্রভৃতি।
৭। অন্যান্য ইনসেনটিভঃ
ক) বিদেশী ঋণের সুদে কর মওকুফ (শর্ত সাপেক্ষে)।
খ) নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য ৬ মাস মেয়াদী মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা।
গ) নিজ দেশে প্রত্যাবাসনযোগ্য অংশের পুনর্বিনিয়োগ নতুন বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচ্য হবে।
ঘ) ৫০০০০০ ডলার বিনিয়োগ করলে বা কোন প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ১০,০০,০০০ ডলার ট্রান্সফার করলে (অপ্রত্যাবাসনযোগ্য) নাগরিকত্ব প্রদান।
ঙ) ৭৫,০০০ ডলার বিনয়োগ করলে দেশে স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে গণ্য হবে।
প্রাইভেট কোম্পানীসমূহের প্রাপ্ত ইনসেনটিভের এই তালিকার বাইরেও নানাবিধ সুবিধা- দেশীয় ও বিদেশী প্রাইভেট কোম্পানী পেয়ে এসেছে, এবং সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গনেছে। এই লোকসানের পরিমাণ বিদেশী কোম্পানীর ক্ষেত্রে আরো অধিক। সরকারের সাথে বিদেশী কোম্পানীর প্রতিটি চুক্তিই হয়েছে দেশের স্বার্থ পরিপন্থী। আমাদের সম্পদ আমরা তাদের তুলে দিয়েছি নাম মাত্র মূল্যে। আমাদের সেবা খাতে বিনিয়োগের নামে উচ্চ মূল্যে তাদের কাছ থেকে আমরা সেবা কিনেছি- সে লোকসানের চরম মূল্য সরাসরি জনগণকে দিতে হয়েছে- হচ্ছে। আর, এ লোকসানের কথা আমরা কেউ বলিনা!!!
....চলবে