কৃত্রিম চাহিদা তৈরির অর্থনীতি
একটা সময় অর্থনীতির মূল সমস্যা ছিল সরবরাহ; জনগণকে খাদ্য ও বস্ত্রের মতো একেবারে মৌলিক কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু কম মূল্যে সরবরাহ করা। কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো চাহিদা। উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার তুলনায় কম হওয়ার জন্য মন্দা হয় না, মন্দা হয় উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা কম থাকার কারণে। চাহিদা কম মানে প্রয়োজন কম- এমন নয়। বাজার অর্থনীতিতে কোন পণ্য আমাদের অতি প্রয়োজনীয় হলেও সেটা আমাদের কেনার সামর্থ যদি আমাদের না থাকে তবে সেটা চাহিদা বলে গণ্য হয় না। তাই আমরা যখন চাহিদার কথা বলবো তখন ধরে নিতে হবে যে এটা সামর্থবান মানুষের চাহিদার কথাই বলা হচ্ছে! তো অর্থনীতির মূল সমস্যাঝয়ে দাঁড়ালো কোন পণ্যের জন্য সামর্থবানদের চাহিদা তৈরি করা, সে চাহিদা ধরে রাখা এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়িয়ে যাওয়া।
সুশৃঙ্খল বাধ্যগত শ্রম, উন্নত প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই- তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আগ্রহী ক্রেতা বা ভোক্তা। ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিরা এই ভোক্তা বা ক্রেতা তৈরি করে বিজ্ঞাপন এবং নানা কৌশলের মাধ্যমে। আপাতদৃষ্টিতে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য পণ্যের মূল্য ও গুনাগুন সম্পর্কে জনগণকে অভিহিত করা বলে মনে হলেও গোপনে তা ভোক্তার স্ট্যাটাস বা মর্যাদা বোধ নিয়ে খেলে। ব্যবহারিক বাস্তব প্রয়োজন মেটানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পণ্যটি ব্যবহারকারীর স্ট্যাটাসের সাথে কতখানি খাপ খায় কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে তা কতটুকু বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম সেটাকেও সেটাকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হলো পণ্যের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই মানুষ নতুন জামা কাপড় কেনে এই কারণে নয় যে, পুরনোগুলো আর লজ্জা বা শীত নিবারণের কাজটি করতে পারছে না, বরং এই কারণে যে সেগুলো আর 'চলছে না' বা সেগুলো পরে আর স্ট্যাটাস ধরে রাখা যাচ্ছে না! এই স্ট্যাটাসের ধারণা এবং তা যেকোন মূল্যে রক্ষা করার সামাজিক চাপ আর কারো পরিবারের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয় করা - দুটো একেবারেই ভিন্ন জিনিস। স্ট্যাটাস খাদ্যদ্রব্যের মতো কোন বাস্তব প্রয়োজনীয় জিনিস না হলেও এই সমাজ বাস্তবতায় তা হয়ে দাঁড়ায় বাস্তবের চেয়েও অধিক বাস্তব।
পরাতন পণ্যকে বাতিল করণের একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নতুন পণ্যের চাহিদা তৈরি করা হয়(১)। কখনো এই বাতিল করণের কাজটি করা হয় এমন একটা বিকল্প পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে যা সত্যিকার অর্থেই পুরনোটির চেয়ে উন্নততর ব্যবহারিক গুনসম্পন্ন। উদাহরণ হিসাবে কম্পিউটার সামগ্রীর কথা বলা যায়। ইন্টেলের প্যান্টিয়াম ৪ এর উন্নত প্রযুক্তিগত দক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই প্যান্টিয়াম ৩ এর ব্যবহারীকে প্রলুব্ধ করে প্যান্টিয়াম ৪ কিনতে। অবশ্য প্যান্টিয়াম ৩ এর খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েও ইন্টেল ব্যবহারীকে বাধ্য করছে, প্যান্টিয়াম ৪ কিনতে। বাতিল করা দ্বিতীয় কৌশলটি হলো পণ্যটির জীবনচক্র নির্দিষ্ট করে দেয়া যেন একটি নির্দিষ্ট সময় সেটার কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। আমেরিকার গাড়ি কোম্পানীগুলো ৫০ এর দশক থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত এই কৌশল অনুসরণ করে। তবে এ কৌশলের একটা মারাত্মক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে কেননা প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানীগুলো এর চেয়েও টেকশই কোন প্রযুক্তি/পণ্য বানিয়ে বাজার দখল করে ফেলতে পারে, যেমনটি করেছিল জাপানি গাড়ি কোম্পানিগুলো। আর তৃতীয় ও বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়াটি হলো পণ্যটিকে স্ট্যাটাস সিম্বল বা মর্যাদার প্রতীকে পরিণত করা। একটা চশমা ব্যবহার করে শুধু ভালো দেখাই যায় না, ভালো দেখানোও যায়- যে ব্রাণ্ডের চশমা ব্যবহার করছেন সেটাই দেখিয়ে দেবে আপনি কোন শ্রেণীর মানুষ! এভাবে ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারিত হয় তার ব্যবহার করা বা প্রদর্শন করা পণ্যের মাধ্যমে। পণ্যের তারতম্য হয় ব্যবহারিক এবং স্ট্যাটাস মূল্য দিয়ে। একটা হাতুড়ির মূল্য মূলত তার ব্যবহারিক মূল্য। কিন্তু ডিজাইনারের তৈরি পোশাকের মূল্য মূলত স্ট্যাটাস মূল্য। কোন পণ্যের মূল্য যত বেশী সেটি তত বেশী ফ্যাশান আক্রান্ত।
ফ্যাশান সয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যকে বাতিল করে:
যখনই কোন পণ্য অধিকাংশের হাতে চলে যায়, তখন সেটি তার বিশেষত্ব হারায়, ফলে তার স্ট্যাটাস কমে যায়। এই উত্তরাধুনিক ভোগী সমাজে বাতিল করণের এই তৃতীয় প্রক্রিয়াটিই ক্রেতার চাহিদা তৈরির পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু কারখানা যুগে যখন মেশিনে তৈরি সব পণ্য একই রকম ব্যবহারিক গুনসম্পন্ন, তখন সেই পণ্যের সাথে স্ট্যাটাস কে কিভাবে যুক্ত করা যায়? ঠিক এইখানটিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ব্রাণ্ড নাম। কারখানায় তৈরি পণ্যের ব্যবহারগত অভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতেই প্রয়োজন পড়লো তার ইমেজগত ভিন্নতা তৈরির(২)। বিজ্ঞাপনের ভূমিকাটা তাই পাল্টে গেল। কোন পণ্যের স্রেফ গুনাগুন বর্ণনা বাদ দিয়ে বিজ্ঞাপন এখন পণ্যটির ব্রাণ্ড নামকে ঘিরে একটি ইমেজ তৈরিতে লিপ্ত হলো। বড় বড় কোম্পানীগুলোর মূল কাজ এখন পণ্য উৎপাদন নয়, পণ্যের ব্রাণ্ড উৎপাদন।
সংস্কৃতিঃ বাজারজাত করণের হাতিয়ার
আগুনে পুড়িয়ে মানুষ, বস্তু বা পশুপাখির গায়ে মালিকানা-চিহ্ন বা ছাপ এঁকে দেয়ার রীতি বেশ পুরনো। আমেরিকায় ১৪ শতক থেকেই র্যাঞ্চ বা গবাদি পশুর খামার মালিকেরা তাদের পালিত পশুর গায়ে মালিকানার চিহ্ন স্বরূপ গরম লোহা পুড়িয়ে তাদের নামের দুটি বা তিনটি অক্ষর ব্রাণ্ড করে দিত- এ পদ্ধতির নাম ছিল Hot Iron Branding (৩)। এখন যেমন Calvin Klein এর C.K ছাপ মারা পোশাক পরে আধুনিক নাগরিকেরা তাদের আইডেনটিটি নিশ্চিত করে, তখন Calvin Klein থাকলে হয়তো C.K ছাপ নিয়ে চারণ ভূমিতে ঘুরে বেড়াতো হাজারো ব্রাণ্ডেড গবাদি পশু। তবে তখন গবাদি পশুকে জোড় করে বেঁধে পাছার চামড়া লোহা দিয়ে পুড়িয়ে ব্রাণ্ডেড করতে হতো আর এখন আমরা নিজেদের পয়সা খরচ করে সানন্দে ব্রাণ্ডেড হই- পার্থক্য এই টুকুই।
আগেই বলা হয়েছে, মার্কেটিং দুনিয়ায় ব্রাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয় শিল্পায়নের ফলশ্রুতিতে কারখানাজাত পণ্যের অভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে- একই ধরণের পণ্যকে বিভিন্ন সুদৃশ্য মোড়কে আবৃত করে বিভিন্ন নামে বাজারজাত করার মধ্য দিয়ে। বহুজাতিক কোম্পানী ইউনিলিভারের রেকর্ড অনুসারে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক ব্রাণ্ড হলো 'পিয়ার্স সোপ' (৪)। শিল্পায়ন সাবানের মতো গৃহস্থালীর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র শিল্প ভিত্তিক উৎপাদন থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় বড় বড় কারখানার হাতে। কারখানাগুলো জাহাজে করে তাদের পণ্য বাজার জাত করার সময় পণ্যের ব্যারেলের গায়ে তাদের লোগো বা চিহ্ন ছাপ মেরে দিত। কোন একটি অঞ্চলে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে এই কারখানাগুলোকে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হতো কেননা স্থানীয় অধিবাসীরা কেবল স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যটির সাথেই পরিচিত ছিল- আজকের ভাষায় যার 'ব্রাণ্ড অ্যাম্বাসাডার' ছিল স্থানীয় দোকানদার। সে সময়ের কয়েকটি ব্রাণ্ড যেমন 'আংকেল বেনস রাইস' বা 'কেলারস ব্র্যাকফাস্ট সিরিয়াল' ইত্যাদির করুন পরিণতি সেদিকেই ইঙ্গিত করে। তাই মোড়কজাত কারখানা পণ্যের উৎপাদকেরা বুঝতে পারলো যে তাদের এখন প্রয়োজন স্থানীয় ভোক্তাকে সেই অস্থানীয় অপরিচিত পণ্যের প্রতি আস্থাশীল করে তোলা। 'ক্যাম্বেল স্যুপ', 'কোকা কোলা', 'আন্ট জেমিমা', 'কোয়েকার-ওটস' ইত্যাদি ছিল সেই সময়কার প্রথম ব্রাণ্ডেড পণ্য- যেগুলো ভোক্তার সাথে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করে তাদের ব্রাণ্ড ইমেজের মাধ্যমে (৫)। বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক যখন বিজ্ঞাপন শিল্প কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামোর উপর দাঁড়ায়নি ব্রাণ্ডিং তখন কেবল আবর্তিত হয়েছে একটি নীতিকে কেন্দ্র করে: কোম্পানীকে ক্রেতার নিকট পরিচিত করে তোলা, পণ্যের গুনাগুন বর্ণনা করা ইত্যাদি। কিন্তু বিশের দশকের পর থেকে বিজ্ঞাপন শিল্পের কাঠামো বৃদ্ধি পাওয়া, বিজ্ঞাপনের নতুন নতুন তত্ত্ব এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের আবির্ভাবের সাথে সাথে বলা যায় ব্রাণ্ডিং তার আধুনিক যুগে প্রবেশ করে যার মূল পদ্ধতি হলো সাংস্কৃতিক প্রকৌশল (Cultural Engineering)(৬)। সেই সময়কার ব্রাণ্ডিং গুরু আরনেস্ট এলমো ক্যালকিন এই ধারণার বিকাশ ঘটান যে, উৎপাদনকারীর উচিত সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও মূল্যবোধের সাথে তার ব্রাণ্ডের একটি সম্পর্ক গড়ে তোলা। ক্যালকিনের পর ডেভিড ওগলিভি এবং লিও বার্ণেট একে নির্দেশক মূলনীতি হিসাবে আরো নিখুঁত করে তোলেন। ফলে বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যের গুনাগুন বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ধীরে ধীরে পণ্যটির সাথে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে দিতে থাকে যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে কিনা আধুনিক ব্যক্তির আধুনিক জীবনযাপনের পক্ষে অত্যাবশ্যকীয় বলে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দাতারা কোন ধরণের ভান ধরাধরির মধ্য দিয়ে যেত না। সরাসরি তারা মানুষকে উপদেশ দিতে থাকে কিভাবে আধুনিক জীবন যাপন করতে হবে এবং কিভাবে তাদের পণ্য ব্যক্তির সেই আধুনিক জীবনের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারে। সেই যুগের বিজ্ঞাপনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই পিতৃতান্ত্রিক সুর। বিজ্ঞাপনের এই পিতৃতান্ত্রিকতা শুধু সহ্যই করা হতো না, এটি বেশ আকাঙ্খিতও ছিল। এই পদ্ধতির প্রাথমিক সাফল্য এবং প্রতিযোগিতা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিজ্ঞাপন দাতারা পণ্যের ব্রাণ্ড ইমেজকে আরো শক্তিশালী করে তোলার প্রয়োজনে ব্যবহারবাদী ও ফ্রয়েডীয় মনোবিদ্যা ইত্যাদি যুক্ত করে রেডিও, টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রকৌশলের আগ্রাসি ব্যবহার শুরু করে যার ফলশ্রুতিতে সমালোচক ও ভোক্তা ক্রমশ সচেতন হতে থাকে এসব বিজ্ঞাপনের কৃত্রিম চাহিদা উৎপাদনকারী ভূমিকা সম্পর্কে। পুঁজিবাদ একদিকে বলছে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা অন্যদিকে জনগণের মনোজগতে ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে- এ দ্বন্দ্ব ক্রমশ ব্রাণ্ডিং এর সাংস্কৃতিক কলাকৌশলকে বাতিল করে দিতে লাগলো।
......... (চলবে)
পরবর্তী অনুচ্ছেদসমূহঃ
->ব্রাণ্ড এবং উত্তরাধুনিক ভোগ-সংস্কৃতি
->ব্রাণ্ডেড শ্রম
তথ্যসূত্রঃ
১। Murray Milner. Jr (2004) Freakes, Geeks & Cool Kids
২। Naoami Klein (2001)- No Logo,
৩। http://www.wikipedia.org/brands
৪। http://www.wikipedia.org/brands
৫। Naoami Klein (2001)- No Logo,
৬। Douglas B. Holt- Why do brand causes trouble? A dialectical theory of consumer culture & branding