২০০৪ সালে মানব খাদ্য হিসাবে জিএম ভুট্টা বিটি-১১ এর যখন অনুমোদন দেয়া হয় তখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ৬টি দেশ এর পক্ষে ছিল, ৫টি দেশ ছিল বিপক্ষে এবং একটি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। সারা বিশ্বের বেশ কিছু বিজ্ঞানী তখন এ অনুমোদনের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মাঝে ড. মে-ওয়ান হো এবং প্রফেসর জো কমিনস এর নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁরা বেসিলাস থুরিনজিনসিস ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইন থেকে যে ক্রাই প্রোটিন তৈরি হয়, যাকে উত্স ব্যাকটেরিয়ার নামানুসারে বিটি-স্ট্রেইন বলা হয়, তা কৃষি শ্রমিকদের শরীরে এলার্জিক রিয়াকশন সৃষ্টিকারী এবং প্রাণীর শরীরে ইমিউনিজেনিক ও অপাচ্য (ক্রাই-১এবি শুকরের শরীরে ৯২% অপাচ্য) বলে বিভিন্ন বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রকাশনায় গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পরও সেগুলোকে আমলে না নেয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, "বিটি-স্ট্রেইন বিষয়ক খবরগুলোকে যে 'নিয়ন্ত্রণ প্রকৃয়ায়' আমলে না নিয়ে অনুমোদন দিয়ে দেয়া হলো তাকে স্রেফ ভন্ডামি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না"। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, শস্যে যে বিটি জিন থাকে তা হলো সিনথেটিক বা হাইব্রিড কাঠামোর অথচ যে টক্সিনের টেস্ট করা হয় তা হলো প্রাকৃতিক যার সাথে শস্যের ভেতরে থাকা টক্সিনের অমিল থাকাটাই স্বাভাবিক।
জিএম পদ্ধতিতে কোন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জিনকে কোন এক প্রজাতির কোষে প্রবেশ করানোর জন্য ঐ জিনটি ছাড়াও আরো কয়েকটি উপাদানের প্রয়োজন হয়। একটি প্রমোটার বা প্রবর্ধক থাকে, যে মূলত জিন-সুইচ, যার কাজ হলো কোষকে বলা যে- ম্যাসেজ বহনকারী জিনটিতে যে ধরণের কোডিং সিকোয়েন্স আছে তা যেন কোষটি তৈরি করে। আরেকটি থাকে টার্মিনেটর, যার কাজ হলো জেনেটিক ম্যাসেজের শেষবিন্দু নির্দেশ করা। ম্যাসেজধারী জিনটি আবার বিভিন্ন ডি.এন.এ এর একটি যৌগিক রূপ হতে পারে যাকিনা কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়।
তো, ন্যূনতম এই তিনটি জিন নিয়ে যে জেনেটিক বস্তু তৈরি হয় তাকে আবার একটি জিন বাহকের সাথে গাটছাড়া বেঁধে দিয়ে আক্রমনাত্মক পদ্ধতিতে কোষটির মাঝে ঢোকানো হয়। এইভাবে বহিরাগত জিন ঢোকানোর ফল হলো জিনোমের সাথে এর এলোপাথারি অঙ্গীভবন যা পরবর্তিতে অ-অনুমানযোগ্য এলোমেলো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে যার ফল হলো ঐ জিন বহনকারী শস্য, পশু ও মানুষের শরীরে বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা।
এভাবে জেনেটিক্যালি মডিফাই করা কোন কোষের মাঝে যে ট্রান্সজেনিক লাইন (Transgenic line) থাকে তার স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা যতক্ষণ কোষটির মাঝে এই Transgenic lineটি অবিকৃত থাকবে, ততক্ষণ কোষটি উদ্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রোটিন তৈরি করবে (হতে পারে এটি কোন নির্দিষ্ট জীবাণু বা কীটপতঙ্গের প্রতিষেধক)। ঐ জিএম কোষটি থেকে পরবর্তিতে যে নতুন কোষগুলো প্রজননের মাধ্যমে তৈরি হয় তার Transgenic line যে মাতৃকোষের মতো হবে তার কোন নিশ্চয়তা এখন পর্যন্ত জিএম প্রযুক্তি দিতে পারেনি, কেননা বিভিন্ন উত্স হতে আসা বিভিন্ন ডি.এন.এ এর জয়েন্ট বা জোড়াগুলো থাকে খুবই দূর্বল, বিশেষ করে যখন কলি ফ্লাওয়ার মোজাইক ভাইরাস থেকে তৈরি CaMV 35S promoter ব্যবহার করা হয় (বর্তমানে এটাই সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত)। কেননা এটা সবারই জানা যে এই promoterটির বিভাজ্যকরণ ও পুনর্গঠনের প্রবণতা রয়েছে।
এতদিন এই ওপেন সিক্রেট কে সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে শুধু মেনডেলিন রেশিওর মাধ্যমে জেনেটিক স্থায়িত্বের প্রমাণ দেওয়া হতো যা মোটেই স্থায়িত্বের প্রমাণ দেয়না। যে কারণে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদী- যারা এখনও কর্পোরেট কোম্পানীর কাছে নিজেদের মস্তিস্ক বিক্রি করেননি, তাদের চাপে অবশেষে ২০০১ ইউরোপিয়ান ডিরেকটরিতে (২০০১/১৮/ইসি) Transgenic line এর স্থায়িত্বের প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যদিও ২০০৩ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে এর কোন গবেষণা হয়নি। ২০০৩ সালে ফ্রেঞ্চ সরকারের কয়েকজন বিজ্ঞানী মনসান্টোর Mon810 ভূট্টা, Round Up Ready সয়াবিন, GA21 ভূট্টা, বেয়ারের (আগেরAventis) T25 ভূট্টা এবং সিনজেনটার Bt 176 ভূট্টা এর বিষয়ে এক গবেষণায় দেখতে পান প্রত্যেক ক্ষেত্রেই গুলো পুনর্বিন্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বেলজিয়ামের গবেষকগণ উল্লেখিত শস্যগুলো ছাড়াও Bt 11 ভূট্টার ক্ষেত্রেও পুনর্সজ্জিত দেখতে পান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, উভয় দেশের বিজ্ঞানীদের দেখতে পাওয়া পুনর্বিন্যাসের মাঝে আবার কমবেশি অমিল রয়েছে, যা এর অস্থিতিশীলতা ছাড়াও এর বিষমরূপতারও প্রমাণ।
উত্পাদনকারী কোম্পানি বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করে দেয়ার পর, যে জিএম প্রকরণের চরিত্র পাল্টিয়ে ফেলছে তার ক্ষেত্রে পাল্টানোর আগে সম্পন্ন করা কোন নিরাপত্তা পরীক্ষাই কার্যকর থাকছে না। ফলে জিএম শস্য আসলে একটা টাইমবোমার মত তবে পার্থক্য হলো একটায় টাইম সেট করা থাকে কখন সেটা ফাটবে এবং ব্যবহৃত বিস্ফোরকের পরিমাণ থেকে এর ধ্বংস ক্ষমতাও আন্দাজ করা যায়, কিন্তু জিএম শস্য তার নড়বড়ে Transgenic line নিয়ে কখন যে ভয়ংকর হয়ে উঠবে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে ঢুকে মানুষ, পশু, গাছপালা সহ গোটা পরিবেশের উপর কি কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে তার কোন মাপজোখ বা সীমা-পরিসীমা নেই। তাই আমদানী করা জিএম সয়াবিন আজকে আমাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি না করলেই যে ভবিষ্যতে করবে না কিংবা ইতোমধ্যেই যে ধীরগতির প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়ে যায়নি তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
বাস্তবতা যখন এই, তখন বীজ ব্যবসায়ী বহুজাতিক কোম্পানীগুলো জিএম শস্য নিয়ে এই ভয়ঙ্কর অনিরাপদ ব্যবসার বিষয়টি আড়াল করার উদ্দেশ্যে খাদ্য সমস্যা সমাধানের কাঁদুনি গাইছে। এইরকম ভয়ঙ্কর একটি প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে আলোর দিশারি, বলা হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক সকলেরই উচিত এর পক্ষ নেয়া। অথচ কোন একটি প্রযুক্তির স্বল্পমেয়াদি ফলাফল দেখে বিভ্রান্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদের কথা চিন্তা না করলে হিতে বিপরীতই ঘটে।
Transgenic line এর স্থিতিশীলতা, জিন প্রবাহের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২১ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বের প্রাকৃতিক প্রজাতি দূষিত হয়ে যাওয়া, কিংবা খাদ্য-শৃঙ্খলের উপর শস্যের সাম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া অর্থাত দীর্ঘমেয়াদে জিএম খাদ্য কি ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে আমাদের দেশে যেন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জিএম ব্যবসায় নামতে না পারে, সে বিষয়ে নজরদাড়ি করা এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সচেতন ভূমিকা রাখার দায়িত্ব আমাদের সরকারের, আমাদের একাডেমিশিয়ানদের, আমাদের।