যেখানে মাত্রাতিরিক্ত মেদ যুক্তরাষ্ট্রের বড় রকমের স্বাস্থ্য-সমস্যা হিসাবে গণ্য, অন্যান্য উন্নত দেশসমূহেও এই সমস্যা বাড়ছে; সেখানে সারা বিশ্বের ৮৫৪ মিলিয়ন লোক ক্ষুধার্ত- জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা(FAO)এর মতে। FAO 'ক্ষুধার্ত'কে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে, একজন যে প্রতিদিন বেঁচে/ টিকে থাকার মত খাবারটুকুও পায় না।
অন্যতম প্রধান চিকিত্সা জর্নাল LANCENT এর একটি আর্টিকেল অনুসারে, প্রতিবছর ৫ বছরের কম বয়সী ১০ মিলিয়ন শিশু ক্ষুধায়-অপুষ্টিতে মারা যায়। FAO এর হিসাব অনুযায়ি, বিশ্বের ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৩০০ কোটির মানুষই অপুষ্টির দরুন ও পানযোগ্য জলের অভাবে প্রিম্যাচুর মৃত্যুর সম্মুখীন; ২৪০ কোটি লোক রান্নার জন্য কাঠ বা অন্যান্য জৈবিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল; ১৬০ কোটি লোক বিদ্যুতের ব্যবহার থেকে বঞ্চিত।
বিগত বছরগুলোতে ক্ষুধার্তের সমস্যা বেড়েছে, বিশেষত সাব সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার মত অনুন্নত দেশগুলোতে; কারণ এখানে খাদ্য-শস্যের দাম বেড়েছে, কোথাও কোথাও তা বিগত ১২ মাসে দ্বিগুনের বেশী হয়েছে, গমের দাম গত দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। বিশ্বের শস্যের মজুদ এখন ৬০ দিনেরও কম- যা দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন মজুদ এবং গমের মজুদ এখন গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এর কারণ হচ্ছে, শস্য থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইথানল প্রস্তুত করার ব্যাপারে বুশ প্রশাসনের গৃহীত সিদ্ধান্ত। ইথানল হচ্ছে, পেট্রোলিয়াম জাত জ্বালানীর একটি বিকল্প।
উন্নত দেশসমূহে খুব বেশী শস্য সরাসরি ভোগ্য নয়। তারচেয়ে বরং, এই শস্য- দুগ্ধ ও ডেইরী উত্পাদনে, ডিম, মুরগী, মাংস, চীনাবাদামের মাখন, কোমল পানীয়, এবং স্ন্যাকস প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেখানে যদিও উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়- অবশ্যই সেই উন্নতি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের মত নয়,- শস্যই প্রধান খাদ্য। খাদ্য-শস্যের উপর এখানকার জনগণ নির্ভরশীল।
এ বছরের শুরুতে মেক্সিকো খাদ্য-অভ্যুত্থানের কাছকাছি পৌঁছেছিল, যখন এখানে খাদ্য-শস্যের দাম প্রায় ৪ গুন হয়েছিল। সারাদেশের রাস্তাগুলোতে হাজার হাজার শ্রমিক হাতে ভুট্টার মোচা দুলাতে দুলাতে নেমে এসেছিল। এই শ্রমিকেরা তাদের বেতনের এক তৃতীয়াংশই তাদের খাদ্যবাবদ ব্যয় করতো, এমনকি খাদ্য-শস্যের দামের উঠানামাতেও অভ্যস্ত ছিল; কিন্তু ৪ গুন দাম বাড়াটা ছিল তাদের জন্য আকস্মিক বিপত্তি।
দক্ষিণ আফ্রিকার দেশসমূহে বিগত ২ বছরে খাদ্য-শস্যের দাম প্রায় দ্বিগুন বেড়েছে, কারণ বেশিরভাগ দেশে কম ফলন ও চাহিদা-নির্ভর মূল্যনির্ধারণের বিশ্বব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রস্তুতকৃত শস্য থেকে ইথানলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এই খাদ্য-শস্যের দাম বাড়াতে বাধ্য করেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে জিম্বাবুয়ে, স্বোয়াজল্যান্ড, লেসোথো ও দক্ষিণ মোজাম্বিকে 'ফুড ইনসিকিউর' লোকের সংখ্যা ২০০৬ সালের ৩.১ মিলিয়ন থেকে এ বছর ৬.১ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদীরা শস্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছেঃ
খাদ্য-শস্যকে জ্বালানীতে পরিণত করার অশুভ পরিকল্পনা হলো নিশ্চিত্ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির অর্থনৈতিক কৌশল। মোটরগাড়ি কোম্পানীর এক্সিকিউটিভদের সাথে এক বৈঠকে জর্জ বুশ মোটরগাড়ি শিল্পে আমদানীকৃত তেলের উপর নির্ভরতা কমাতে ইথানল ব্যবহারে উপযোগী ইঞ্জিন তৈরির আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা দিয়েছেন যে ২০১৭ সালের মধ্যে ৩৫ বিলিয়ন গ্যারেল ইথানল উত্পাদনের জন্য তিনি কংগ্রেসে বিল আনতে যাচ্ছেন। এটা সফল করার জন্য বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যখন সবচেয়ে শক্তিশালী কোম্পানী গুলো এগিয়ে আসবে, আর এই বড় বড় কোম্পানী গুলো বিদ্যুত ও জ্বালানীর উপর নির্ভরশীল।
বুশ দাবী করেছেন যে, জ্বালানীর জন্য পেট্রোলিয়াম থেকে ইথানলে প্রবেশ পরিবেশকে দূষণমুক্ত করবে। কিন্তু, পরিবেশবিদদের গবেষণায় পাওয়া যায় যে, এই বিপুল পরিমাণে ইথানল প্রস্তুতিতে যে পরিমাণ কার্বন বের হবে এবং ইথানলের কাঁচামাল শস্য উত্পাদনে যে বিপুল পরিমাণে কৃত্রিম সার প্রয়োগ করা হবে, তা তেল ব্যবহারে যে কার্বন বের হয় তার চেয়ে অনেক বেশী। ফলে পরিবেশের ক্ষতিও কমবে না বরং বাড়বে।
তেলকে ইথানল দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে বিশাল অংকের খরচ প্রয়োজন, কিন্তু এতে মুনাফার অংকটিও তদোধিক- আর এটাই পুঁজিপতিদের ইথানল উত্পাদনের দিকে ধাবিত করছে। রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শাসক শ্রণী স্বভাবতই ভেনিজুয়েলা ও ইরানের মত দেশের উপর থেকে তেলের জন্য নির্ভরশীলতা কমাতে চায়।
ব্রাজিল দুনিয়ার অন্যতম প্রধান ইথানল উত্পাদনকারী দেশ। সে ইথানল উত্পাদনে চিনি শিল্পের একধরণের বর্জ্য ব্যবহার করে। ব্রাজিলের মোট জ্বালানীর ৩০% ইথানল। ব্রাজিলের ইথানল উত্পাদকরা কিছুদিন আগে ঘোষণা করেছে যে, উত্পাদন বাড়াতে আরও ৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ব্রাজিলের পরিবেশবাদী কর্মীরা এই ঘোষণায় ভীতি প্রকাশ করেছে যে, এতে ব্রাজিলের আমাজান বনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ উজাড় হবে।
বেনিন, মালে, নাইজেরিয়া ও সেনেগাল সহ বেশ কিছু আফ্রিকান দেশ ঘানাকে অনুসরণ করে-পরীক্ষামূলকভাবে 'জাত্রোফা' থেকে অ্যাগ্রো-ফুয়েল উত্পাদন শুরু করেছে। এই 'জাত্রোফা' হচ্ছে একধরণের আগাছা যা মাঠকে গবাদি পশুর হাত থেকে রক্ষা করে, কেননা এরা এই আগাছা খেতে পছন্দ করে না।
এই জাত্রোফার বীজ থেকে এক ধরণের তেল পাওয়া যায়, যা অনেকদিন ধরেই সাবান প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখন দেখা গেছে যে, অন্য শস্য বা সয়াবিনের চাইতে জাত্রোফা থেকে তুলনামূলক কম খরচে অ্যাগ্রো-ডিজেল তৈরি করা যায়। এবং পেট্রোলিয়াম জাত ডিজেল পুড়ালে যে কার্বন বের হয় তার এক পঞ্চমাংশ বের হয় জাত্রোফা জাত অ্যাগ্রো-ডিজেল পুড়ালে। এই অ্যাগ্রো-ডিজেল উত্পাদনে প্রাপ্ত উপজাত সার হিসাবে ব্যবহার করা যায় ও এই উপজাত থেকে সাবান প্রস্তুত করা যায়।
যেহেতু এটি বারোমেসে আগাছা, তাই জাত্রোফা শুষ্ক ও অনুর্বর ভূমিতেও সেচ ও সার ছাড়াই জন্মায়। এর মূল/ শিকড় মাটির উপরিভাগের কাছাকাছি অবস্থান করে ও মাটিকে দৃড় ভাবে আটকে ধরে রাখে। তাই, মাটির বাঁধসমূহে জাত্রোফা চাষ করা হয়। সাথে সাথে এও বলা হচ্ছে যে, জাত্রোফা চাষ করে একজন দরিদ্র কৃষক একইসাথে নিজের ডিজেলের চাহিদা মেটাতে পারবে ও আর্থিকভাবেও স্বচ্ছল হতে পারবে।
এসব অনেক উত্সাহ ব্যঞ্জক চিত্র নিসন্দেহে, কিন্তু দূর্ভাগ্য যে- প্রকৃত চিত্র দরিদ্র কৃষকদের জন্য এত আশাদায়ক নয়। আফ্রিকা ও এশিয়ায় জাত্রোফার পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মারাত্মক। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় জাত্রোফা মানুষ ও গবাদী পশুর জন্য বিষাক্ত বিধায় এর উত্পাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে প্রচারণা চালানো হয় - কৃষক সেচ ছাড়াই অনুর্বর জমিতে জাত্রোফা চাষ করতে পারবে, তাতেও ফাঁকি আছে। ভারতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেচ ছাড়া ৫ বছরে হেক্টর প্রতি জমিতে জাত্রোফা উত্পাদন ১.১ থেকে ২.৭৫ টন; যেখানে সেচ সহ উত্পাদন ৫.২৫ থেকে ১২.৫ টন। এবং, এ থেকে বুঝা যায়- জাত্রোফা উত্পাদন শুধু পতিত অনুর্বর ভূমিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সেচের আওতাধীন উর্বর জমিতে সাধরণ শস্য উত্পাদনকেও জাত্রোফার সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হতে হবে। এবং আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার উদাহরণে আমরা তাই দেখি।
আর যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের লাভোবান হবার কথা বলা হচ্ছে, আসলে কিন্তু এর মূলে আছে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থ তথা তাদের মুনাফা। ভারত সরকার ২০১২ সালের মধ্যে ১৩.৫ মিলিয়ন হেক্টর পতিত জমিতে জাত্রোফা চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে; এবং ভারতের কর্পোরেট কোম্পানী গুলো এরই মধ্যে চাষীদের জমি হস্তগত করার জন্য চাষীদের চাপ প্রয়োগ করছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। বালাঙ্গি, উড়িষ্যার কৃষকেরা তাদের ১৩৮ হেক্টর জমি 'তাজ গ্যাস লিমিটেডে'র প্রতারণায় হারিয়ে নিঃস্ব।
আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া সহ প্রযুক্তিগতভাবে অনুন্নত দেশসমূহের মূল সমস্যা তাদের দারিদ্র। তাদের উন্নত হবার মত অর্থ নেই, খাবার-পরার মত অর্থ নেই। সেইসাথে নেই জনগণের প্রকৃত সরকার; ফলে নেই সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা। আর অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের সর্বগ্রাসী এনার্জী পলিসি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের নামে, এসব দেশসমূহকে বাধ্য করছে আরো দারিদ্রের শেষসীমায় পৌঁছতে।
(সূত্রঃ G. Dunkel রচিত 'Workers World' এ প্রকাশিত "Bio fuels & world hunger" আর্টিকেল ও 'Seedling' এর জুলাই, ০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত "Jatrofa- the agrofuel of the poor?" আর্টিকেল)