অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীরা যেহেতু নরপশু তাই তাদের বিনা বিচারে লটকে দিলেই সব ঝামেলা চুকে যায়। এর বিপরীতে অনেকেই আবার বলছেন যুদ্ধাপরাধ একটি মিমাংসিত বিষয় বিধায় এটিকে টেনে আনার কোন প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে অনেকেই বলছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা চান এবং সরকার যদি এটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে করে তাহলে সমস্যা নেই। ব্লগ-ফেসবুকে প্রথম দু'দলেরই সমর্থক কম, বেশিরভাগ লোকই তৃতীয় দলে আছে বলে মনে হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ লোকের কাছে প্রশ্ন হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দিকটি কী-করে নিশ্চিত হওয়া যাবে? এজন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা, বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধ্বে উঠে বিবেচনা করা। দেখা যাচ্ছে বর্তমান সরকার সব বিষয়কেই দারুণভাবে গুলিয়ে ফেলছে এবং এমনকি গোড়া সরকার সমর্থকও বাধ্য হচ্ছে সরকারের সমালোচনা করতে। যেমন ১২ই মার্চের জনসভা নিয়ে সরকার দারুণরকম জল ঘোলা করে ফেলল। আর তাতে অবিবেচক ও অন্ধ সমর্থক ছাড়া সবাই সরকারের সমালোচনা শুরু করল। বামপন্থী কলামিস্ট বদরুদ্দিন ওমর একে "কেলেঙ্কারী" বলেছেন। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটিকে সরকার যেভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তাতেও এটিও একটি কেলেঙ্কারীতে রূপ নিতে, এমনটি বললে সম্ভবত খুব বেশী ভুল হবেনা।
রাজনৈতিক হাতিয়ার বলতে কী বুঝানো হচ্ছে তা একটি পরিসংখ্যান দিলে পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে। শুধুমাত্র মার্চ মাসের প্রথম সতের দিনই প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার দলীয় অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা ১৩৬ বার যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন (প্রথম আলো এবং আমার দেশে ছাপা হওয়া বক্তব্য অনুযায়ী)। প্রতিবারই বক্তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বিচার বানচালের চক্রান্ত হচ্ছে এবং রিরোধী দলের সমস্ত কর্মকান্ড নাকি এ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবী করছেন। শুধু তা-ই নয় সরকারী দল তাদের কর্মসূচীগুলোও দিচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে। সরকার নিজেরাই ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এ দাবী তারা কাদের কাছে উপস্থাপন করছে? বিষয়টা কী গোলমেলে মনে হচ্ছেনা? এ ধরনের কর্মকান্ড বিচাকাজকে প্রভাবিত করতে পারে কী-না বা সরকার এটি করতে পারে কী-না তা আইনজ্ঞরা বলতে পারবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, বিচার ইস্যুটিকে সরকার ভুয়া রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং এ বিষয়ে তারা মোটেই আন্তরিক নয়। নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করলে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার দিকটি বোঝা সহজ হবে:
১. সরকার বিগত সতের দিনে ১৩৬ বার যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গটি উপস্থাপনের পাশাপাশি কতবার ছাত্রলীগের অপকর্মের বিচারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছে? অথচ ছাত্রলীগ গত তিন বছরে (চলতি বছর বাদে) ১৮ টি খুন করেছে এবং ছাত্রী লাঞ্ছনা ও ধর্ষনের শিকার হয়েছে শতাধিক (সূত্র: দৈনিক আমার দেশ, ১১/১/২০১২)।
২. ট্রাইবুনালকে আস্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য বিভিন্ন পরামর্শ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে সরকার সেগুলোতে বিশেষ কোন ভ্রুক্ষেপই করেনি। অথচ বিচারকে গ্রহনযোগ্য, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে হলে ঐসব পরামর্শের অনেকগুলোই মানা দরকার ছিল। এমনকি ট্রাইবুনালের বিচারকেরও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এসকল বিষয়গুলো আমলে নেয়া হয়নি। তাহলে কী করে বিচারকাজ স্বচ্ছ, গ্রহনযোগ্য ও নিরপেক্ষ হবে বলে ধারণা করা যেতে পারে?
৩. একদিকে আমরা প্রতিদিন যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে চেচামেচি, মিছিল, মিটিং মানববন্ধন করতে দেখছি। অন্যদিকে আমরা দেখছি আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করানো ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হাজির করানো যাচ্ছেনা। প্রসিকিউশন তাদের অসহায়ত্বের কথা ঘোষনা করলেন। এজন্য তারা দারুণ বকাঝকাও শুনছেন। কিন্তু এ অসহায়ত্ব কিসের? অনেকে বলছে এটা নাকি প্রসিকিউশনের দুর্বলতা। যেখানে সরকার ১৩৬ বার এই বিষয়ে তীব্র-সবলভাবে বক্তব্য দিয়েছে, সেখানে আদালতে সরকারপক্ষ দুর্বল? এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? তাহলে প্রসিকিউশনের অসহায়ত্বের কারণ কী তাহলে এটা যে তাদেরকে মিথ্যাকে সত্য বানানোর রাজনৈতিক এজেন্ডা দেয়া হয়েছে যা বাস্তবায়নে তারা হিমশিম খাচ্ছেন? এই সন্দেহটি আরও প্রবল হবে যখন আমরা দেখি যেসব আসামীদেরকে শত-শত অপরাধের অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে মিডিয়াতে, লেখালেখি করা হয়েছে প্রচুর সেসব "অপরাধী"দের সুনির্দিষ্ট দু'একটি অপরাধের নূন্যতম স্বাক্ষী-প্রমাণও ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছেননা। এমন ভয়াবহ দুর্বল প্রমাণ-এর ভিত্তিতে যদি কোন ন্যায়বিচার পরিপন্থী রায় দেয়া হয় তাহলে তাকে সরকারের ভয়াবহ নৈতিক দেউলিয়াপনা এবং ন্যায়বিচারের চরম অবমাননা বলতে হবে।
৪. পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম একজন লেখকের (যে লেখক ততটা ক্রেডিবল হিসেবে পরিচিত নন) লেখাকে অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে বলব, এর চেয়ে ভাল ভাল লেখকের অনেক লেখা উপস্থাপন করা যায় যাতে আওয়ামিলীগেরই অনেক নেতার নাম আছে। ইত্তেফাকের প্রবীণ সাংবাদিক মাসুদুল হক তার বই 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র' এবং সিআইএ' গ্রন্থে বলেছেন ১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনীর হত্যাকান্ড সম্পর্কে লিখেছেন, "...অতএব শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপের মুখ্য লড়াই হয়ে দাড়ায় বামপন্থী নির্মুল - পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয় এবং আগষ্ট মাসে বাংলাদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের বামপন্থী নির্মূল অভিযান শুরু হয়ে যায়। সম্মুখ যুদ্ধে না নেমে তারা বেছে নেয় গুপ্ত হত্যা প্রক্রিয়া। কোথাও কোথাও নেমে পড়ে সরাসরি লড়াইয়ে। শুধু বামপন্থী নির্মূলই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধেও অস্ত্র তুলে ধরে তারা। এমন কি মুজিব বাহিনীর সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনু গ্রুপের বামপস্থী চিন্তা চেতনার অনবর্তী সহযোদ্ধাদেরও হত্যা করে নির্দ্বিধায়। মুজিব বাহিনীর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্ত তুলে ধরার শুরুতে যেতে হয় প্রকাশিত একটি গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে। বইটি 'ইন্দিরা গান্ধীর বিচার চাই'; লেখক অধ্যাপক আহসাবউদ্দীন আহমদ। লেখক তার গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ষোলজন নিহতের নামে যাদের চৌদ্দজনই মারা গেছে মুজিব বাহিনীর হাতে, - যারা ছিলেন বামপন্থী চেতনায় সিক্ত। চট্টগ্রামের বাঁশখালি থানার নাপোড়া পাহাড়ে রাতের আধারে ঘুমন্ত অবস্থায় স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুজিব বাহিনী সদস্যরা। এভাবে গুপ্ত হত্যার স্বীকার হয় আজকের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার সৈয়দ কামেল বখত। নেহাত ভাগ্যের জোরে বেচে যান তার জোষ্ঠ সৈয়দ দীদার বখত।.... " এভাবে পুরো অধ্যায়টিতে আরও অনেক বর্ণনা আছে।
এই সমস্ত হত্যাকান্ডের হোতা ও হত্যাকান্ডে অংশগ্রহকারী বাহিনী সম্পর্কে সরকার কী বলবে? নিজের দলের ছত্রছায়ায় লালিত অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে সরকার কী নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে পারবে?
প্রথম আলোর কলাম্টি আবুল মকসুদ লিখেছিলেন: “সরকার পরিচালনার একটি দিক হলো সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন, আর একটি দিক হলো নৈতিক বাধ্যবাধকতা। সরকারের সবচেয়ে বড় শত্রুও যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।” (প্রথম আলো, ৬/৩/১২)নৈতিকতা বোধ না থাকার কারণে বর্তমান সরকারের আচরণ এর বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করছে।