এইচএসসি তে পড়ার সময় ঢাকা কলেজে প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। অনুবাদ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “A translation is like a woman, when she is faithful, she is less likely to be beautiful and when she is beautiful, she may not be that faithful!” (কেউ আবার একে সবক্ষেত্রে সত্য বলে ধরে নিয়ে হৈচৈ শুরু করে দিয়েন না! আমি এক্সাক্টলি উনার কথাটাই শুধু লিখেছি।, এ আমার কথাও নয়, কাউকে undermine করাও আমার উদ্দেশ্য নয়)। উনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো এক ভাষার মূল লেখা অন্য্ ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে হুবুহু শব্দগত অনুবাদের মান খুব স্বভাবতই একটা ভালো হয় না। অনেক সময় একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হতে পারে তার ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। একজনের মাতৃভাষা তিনি যেমন ভালো জানেন বা বুঝেন আরেকজন বিদেশির পক্ষে ঠিক সেরকম দখল অর্জন করা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের বাংলাই ধরুন, হাত তোলা বলতে সাধারণত “আমি উপস্থিত, বা আমি কিছু বলতে চাই" বোঝায়। কিন্তু যখন বলা হয়, ম্যাডাম কাজের মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন তখন এর অর্থ অন্য। আর যদি বলা হয় বাড়ির কর্তা কাজের মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছেন, তো সে ভয়ানক ব্যাপার ! এ পার্থক্য বোঝার মতো বুৎপত্যি অর্জন করা একজন ভিনদেশির জন্য দুরূহ। এমনি মিস্টার এক্সকে দেখা গেছে কক্সবাজারে ছেলে মেয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন আর মিস্টার এক্সকে মেয়ে ছেলে নিয়ে কক্সবাজারে দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে যা শুধুমাত্র বাংলা শিখে একজন বিদেশির পক্ষে বোঝা সহজসাধ্য মোটেও না।
এছাড়াও আছে ভিন্নতর সমস্যা। ধরুন সেই হেমন্তের পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার গান, " তারে বলে দিও সে যেন আসে না আমার দ্বারে !" একে কিভাবে ইংরেজি অনুবাদ করবেন ? ” Tell her so that she doesn’t come to my door!” or “Ask her not to come to my door!” এই কি তার আসল অর্থ ?? এখানে তারে কি আসলেই আসতে মানা করা হচ্ছে ? একজন পরিচিত কেউ এসে আপনাকে প্রায়ই ধার চেয়ে বিরক্ত করে, তাকে আসতে মানা করা, আর এ মানা করার তফাৎ কি ইংরেজি অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছে ? আমাদের বাংলায় "অভিমান" এর সমার্থক একটা শব্দ ইংরেজিতে আমার চোখে পড়েনি ! আপনাদের কারো কি জানা আছে ? কেউ হয়তো বলবেন Upset, সে কাছাকাছি হতে পারে, কিন্তু অভিমান সেই করে যে ভালোও বাসে, আপসেট দিয়ে কি তা বোঝানো সম্ভব?
আরো একটি বিষয় এখানে না বললেই নয়। অনুবাদকের ভাষাজ্ঞান, উভয় ভাষায় সমান পারদর্শী হওয়া আবশ্যক। কুয়ালালামপুরে একবার এক বাংলাদেশির কাছে কোনো এক বাঙালির লেখা বাংলা থেকে মালয়ী ডিকশেনারী দেখলাম। এতে হাতের নখ এর যে মালয়ী অনুবাদ লিখেছে তার প্রকৃত অর্থ তারকাটা ! স্পষ্টতই যা প্রমান করে লেখক ইংরেজি থেকে মালয়ী ডিকশেনারী দেখে Nail এর বাংলা করেছেন, বুঝতে পারেননি এ নেইল সে নেইল নয়!
ম্যারেজ সার্টিফিকেট বা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বইয়ের অনুবাদ নিয়ে এ কথাগুলো আসছে না। এখানে অনূদিত হচ্ছে ফ্যাক্টস, এখানে লেখক বা অনুবাদকের আবেগ প্রকাশের সুযোগ নেই। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদে মূল ভাব ঠিক থাকলেও আবেগ, সৌন্দর্য্য, মাধুর্য্য সম্পূর্ণ ফুটিয়ে তোলা কঠিন।
আমার এ লেখার উদ্দেশ্য মোটেও একথা বলা নয় যে অনুবাদ মাত্রই ভুলে ভরা বা পাঠের উপযুক্ত নয় ! সারা দুনিয়ায় বিখ্যাত লেখকদের অসংখ্য সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে লক্ষ লক্ষ পাঠক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। অনেক ভাষার বই বর্তমানে বাংলায় অনূদিত হচ্ছে , মানও ভালো; তবে মনে রাখতে হবে একটা বইয়ের অনুবাদ মূল বইয়ের সমান হওয়া খুবই দুরূহ। বিশেষত, এতে যদি অনুবাদক ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর মতো কিছুটা স্বাধীনতাও কাজে না লাগান।
কোরানের অনুবাদ নিয়ে এক ভাই এখানেই একটা পোস্ট দিচ্ছেন, যাতে তিনি দেখিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদকের একই বাক্যের অনুবাদে কিছুটা এদিক ওদিক হয়েছে। একজন অনুবাদক উভয় ভাষায় সমান দখল থাকলেও তার নিজস্ব চিন্তাধারা, ইমোশন, আন্ডারস্টেন্ডিং, প্রকাশ করার ক্ষমতা এবং ভঙ্গির প্রভাবমুক্ত হতে পারেন না। ফলে তিনজন অনুবাদকের অনুবাদে মূল কথা এক থাকা সত্বেও তা ভিন্নতর ব্যাক্তিত্বের কারণেও অনুবাদ কিছুটা ভিন্ন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এজন্যই উপমহাদেশের জনৈক বিখ্যাত রাজনীতিবিদকৃত কোরানের তাফসীর তার দলের লোকজনের কাছে প্রিয় হলেও অন্যদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি! পাঠকের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্যাপাসিটির তারতম্যের কারণেও অনুবাদ কিছুটা ভিন্ন মনে হতে পারে। আর অনুবাদকের সঠিক শব্দ চয়নে ভুল হলে তো কথাই নেই।
আমি আগেই বলেছি, সব ভাষায়ই একই শব্দের ব্যবহার অনুসারে অর্থ ভিন্ন হওয়ার উদাহরণ আছে ! আরবিতেও অনেক শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ রয়েছে, ব্যাবহারে পার্থক্য অনুসারে, যা অনেক সময় একজন অনারাবির জন্য সঙ্গত কারণেই সমস্যা হতে পারে। আলেমগণের মতে সমগ্র কোরান সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান থাকা জরুরি, কেননা কোনো কোনো বক্তব্যের ব্যাখ্যা পরবর্তী অন্য কোন আয়াতে স্পষ্টতর করা হয়েছে, যা জানা না থাকলে শুধু একটি আয়াত জেনে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছার আশঙ্কা থেকে যাবে। এ ছাড়াও কোরানের অর্থ কোরান যার উপর নাজেল হয়েছে সেই নবী করিম (স) যেমন বুঝেছেন এবং সাহাবাদের যেমন বুঝিয়েছেন সেই পারফেক্ট। কারণ আল্লাহ স্বয়ং তার রাসূলকে ভুল থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো বক্তব্যকে আল্লাহর রাসূল (স) যেভাবে বুঝিয়েছেন তা থেকে ভিন্ন মনে হলে নিজের আন্ডারস্টেন্ডিংকে বাদ দিয়ে রাসূলের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করতে হবে। নির্ভরযোগ্য তফসীরকারাকগণ এই নীতি অনুসরণ করেই কোরানের তাফসীর করেছেন।
বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য নিচের উদাহরণগুলি দেখা যেতে পারে। সূরা কাফিরুনের শেষ আয়াত "লাকুম দীনুকুম ওআল ইয়া দীন " এর প্রচলিত অনুবাদ , "তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার" আলেমগণের মতে ঠিক নয় ! এখানে "দীন" এর অর্থ ধর্ম ভুল, সঠিক অর্থ বিচার বা হিসাব, যেমন সূরা ফাতিহার ৩ নম্বর আয়াতে মালিক ইয়াওমিদ্দীন বলতে বিচার দিবস বা হিসাব নেয়ার দিবসের মালিক বোঝানো হয়েছে। আরেকটা পরিচিত আরবি শব্দ, ওয়ালী কোরানে কোথাও বন্ধু কোথাও অভিভাবক হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। একেও অনুবাদে ভুল করার সুযোগ রয়েছে। তেমনি ইয়াকিন শব্দও কোথাও দৃঢ় বিশ্বাস, কোথাও মৃত্যু বোঝানো হয়েছে।
এমতাবস্থায় একাধিক অনুবাদ নিয়ে তুলনা করতে গিয়ে confused হয়ে পড়লে ভালো আলেম, যারা আরবি ভাষায় ভালো দখলের সাথে কোরান, হাদিস সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান রাখেন তাদের শরণাপন্ন হওয়া ভালো।