বেশ কিছুদিন আগে রাত প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে গেলাম। জানতাম ওখানেই ওনাকে পাওয়া যাবে। পেয়েও গেলাম, অনেকের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন।
অভিনয় শিল্পী হিসেবে মোটামুটি সারাদেশে পরিচিত তিনি। আমাকে দেখে ডেকে নিলেন- ‘কিরে, কি খবর?’ বল্লাম- ‘আছি’। তারপর- কানে কানে শুভেচ্ছা জানাতেই, হাসলেন। বুঝতে পারছিলাম না, আশপাশের অন্যরা এ বিষয়ে কতটুকু জানেন। আমিও আড্ডাতে বসে গেলাম। অনেকেই পরিচিত ছিলো বলে, অসুবিধা হচ্ছিল না।
রাত বাড়তেই লোকজন কমতে থাকলো। এক সময় আমরা মাত্র তিন জন রইলাম। আমি, আপা আর বন্ধু রাহুল। হঠাৎ প্যান্টের পকেট থেকে কি যেন একটা বের করে আপা রাহুলের উদ্দেশ্যে বললেন- ‘এটা নিয়ে যা’। দেখলাম একটা কয়েন। রাহুল বলল-‘কেন? ফেরত দিচ্ছেন কেন! আপনাকে দিলাম। বার্থডে গিফট’। উনি নির্লিপ্ত ভাবেই বললেন- ‘না নিয়ে যা। দরকার নেই’।
রাহুল একটু হকচকিয়ে গেলো। হঠাৎ পরিবেশটা কেমন যেন অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ালো। আমিও কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রাহুল বিষয়টাকে আমলে না নিয়ে, আবার বললো- ‘দেখেন আপা, এটা আমি আমার ছোট বোনের জন্য রেখেছিলাম। শ্রীলঙ্কান কয়েন। কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম, নিয়ে এসেছি। কিন্তু ছোট বোনকে দেবার আগেই আপনার জন্মদিনে দেখা হয়ে গেলো। আপনাকে বড় বোন মনে করে দিলাম। এটা রাখা আপনার দায়িত্ব।’
আপা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন, তারপর বললেন- ‘ধুর! আমি বেশিদিন বাঁচবো নারে। শুধু শুধু এসব দিয়ে কি হবে?’ বলেই আবার চুপ।
রাহুল উঠে দাঁড়ালো এবং বললো- ‘বাজে কথা বলবেন না। বাঁচা মরার আপনি বোঝেন কি!’
আমরা দু’জন বসে থাকলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম- কিছু না নিয়ে এসে মনে হয় ভালোই হলো। তা’নাহলে আমকেও হয়তো...।
আপাই আবার মুখ খুললেন- ‘আম্মাকেও দেখতাম, শেষের দিকে কিছুই মনে রাখতে পারতেন না’। এখানে বলে রাখা ভালো আপার মা, অত্যন্ত গুণি এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। বছর কয়েক আগে হঠাৎ মারা যান।
আপা বলে চলেছেন, ‘আম্মা হাসতেন আর বলতেন, কোনো কিছু মনে রাখার প্রয়োজনই বা কি! আম্মার মতো আমারও মনে হয়- কোনো কিছু করার দরকারই বা কি আছে? সবকিছুর ওপর থেকে মন উঠে যাচ্ছে, উঠে গেছে। আম্মা বলতো- কোনো কিছুর ওপর আর মায়া বসাতে পারছি নারে। আমারও বুকের ভেতর কেমন জানি লাগে। কান্না পায়। আম্মাকে খুব মনে পড়ে। কিছুই ভালো লাগে না।’
আমি বললাম- ‘সেই জন্যই কি আপনি কয়েন ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন?’
উনি জোড় দিয়ে বললেন- ‘হ্যা..’।
আপা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মনে হয় সত্যি সত্যিই মারা যাবো। সব কিছুর ওপর থেকে আমারও মায়া উঠে গেছে। মরে যেতেই ইচ্ছা হয়।’
আমি আড্ডার স্বভাব সুলব ভাবটা বাদ দিয়ে, হঠাৎ সেখানেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলাম। তারপর বেশ কিছু সিরিয়াস প্রশ্ন করলাম। প্রথমে আগ্রহ না দেখালেও এক সময় মেনে নিলেন। আমি সেখানে বসেই সত্যিই একটি প্রেসক্রিপশন করে দিলাম।
হাসিখুশি সাধারণ জীবনের অন্তরালে এমন অনেক গল্প থাকে, থাকতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে যা দেখা যায় না, যা হয়ত আমাদের কল্পনাতেও আসে না কখনো।
গল্প, আড্ডা, নাটক, মহড়া সবই চলছে। অন্য কেউতো দূরের কথা, যিনি নিজেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছেন মায়া বলে। ‘হ্যা, মায়াই। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইন্টারেস্ট’। ‘সব কিছু থেকে মায়া উঠে গেছে। লস অব ইন্টারেস্ট, ল্যাক আব ড্রাইভ, হোপলেসনেস, হেল্পলেসনেস।’
নিজেকে একসময় মনে হয় অর্থহীন। জীবন হয়ে উঠে অর্থহীন। এসব পরিবর্তনগুলো নিজের ভেতরেই হয়। নিজের ওপর বিরক্তি চলে আসে। একটা অপ্রয়োজনীয় জীবন চলা শুরু হয়। দরকার কি? রাগ আরো বেড়ে যায়। তবে, কাউকে না কাউকে বুঝতে হবে এসব অন্য কিছু নয়। প্রতিরোধ যোগ্য অপমৃত্যুর অগ্রহনযোগ্য বায়না। এসবকে ফিরিয়ে দিতে হবে, আমাদের শক্তি দিয়ে। মনের শক্তি, জ্ঞানের শক্তি।
নিজের গল্প:
দুই হাজার আট সালের ৩ অগাষ্ট সকাল ১০টা। আমার স্ত্রী অপারেশন টেবিলে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ হাসপাতালে ভর্তি, পেটের শিশুটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি। হঠাৎ মাঝ পথে কেন জানি থেমে গেছে। তরপর থেকে হাসপাতালের বিছানায় একেবারেই শুয়ে আছে। সেদিন সকাল থেকেই বাচ্চাটির খুব বেশি সাড়া শব্দ বা নড়াচড়া নেই। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব অনেকেই চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে। কি হবে, জানিনা। কেউ বেশি কথা বলছে না। শুধু এদিক ওদিক দেখছে।
আমি একটু দূরে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে। বিভিন্ন কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম ওটির সামনে একটা জটলা। সবাই ঐদিকে ছুটে যাচ্ছে। আমার বেশ কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুও আছেন সেখানে। আমি দূর থেকে দেখলাম জটলাটা সেখানে স্থির হয়ে আছে। কেউ নড়ছে না। এমনকি শব্দ পর্যন্ত করছে না। আমি ধীরে ধীরে অন্যদিকে তাকালাম।
আমার এক বন্ধু এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই একটা ফোন এলো, ভাবলাম কেউ মনে হয় ‘বাবু’র কথা জানতে চায়। বললাম- হ্যালো। কান্নার শব্দ। আমি আবার বললাম- হ্যালো। কান্না। ভাবলাম কেউ হয়তো এর মধ্যেই খবর পেয়েছে। কিন্তু একটা নারী স্বর বলে উঠল- আপনার রোগী, মি. ‘ক’ এইমাত্র আত্মহত্যা করেছেন।
আমি কোন দিকে যাবো! ভেবে পেলাম না।
দুইদিন পর ফোন দিলাম। কি খবর? নারীটি বললেন- ‘আমরা কেন চিকিৎসা শেষ না করে বাড়ি নিয়ে এলাম? আপনি বলেছিলেন, আত্মহত্যা করতে পারে। আমরা শুনিনি’। ফোনটা কেটে দিলাম।
এখনো আমার ছেলের মৃত্যু বার্ষিকীতে ভদ্র লোকের কথা মনে হয়। মনে হয়, সব সম্ভাব্য সুযোগ থাকা সত্যেও শুধু, বুঝতে না পারা বা বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করতে না পারার জন্যই লোকটি মারা গেলেন।
প্রতিদিন এমন করেই অনেক প্রাণ ঝরে যায়। জীবনের প্রতি আস্থাহীনতা, পরিপার্শ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা জীবন থেকে জীবকে কেড়ে নেয়। অথচ আমাদের সহযোগীতা, আমাদের সচেতনতা সেই মানুষটাকেই স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে।
Stigma: A Major Barrier for Suicide Prevention.
মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) সারা পৃথিবী একাদশ বারের মত পালন করছে ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস-২০১৩।’ এবারের প্রতিপাদ্য- ‘Stigma: A Major Barrier for Suicide Prevention.’ অর্থাৎ ‘কুসংস্কার: আত্মহত্যা প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় অন্তরায়’।
আত্মহত্যাও এক ধরনের হত্যা। নিজেকে হত্যা। সম্ভবত, মানুষের নিজেকে নিজে হত্যা করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব সংস্থাগুলি এ দিবসটি পালন করার কথা ভাবা শুরু করে। নিজের রাগকে কমানোর জন্য কিংবা অন্য কাউকে একেবারে অকেজো করে ফেলার জন্যই হয়ত মানুষ আত্মহত্যা করে। নিজেকে হত্যা করার ব্যাখ্যাটা ঠিক একইরকম না হলেও, প্রায় কাছাকাছি। অর্থাৎ এখানে একজন মানুষ যখন নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করেন, ভাবেন আমার প্রয়োজন কি? আমি অকেজো হয়েই গেছি। কোনো কিছুতেই আমার আর সম্পৃক্ততা নেই। নিজের ভিতর নিজেকে যখন মানুষ পরিপূর্ণ ভাবে অকেজো ভাবা শুরু করেন। তখনই শুরু হয় এই হত্যার পরিকল্পনা। পাশাপাশি চলতে থাকে মনের ভিতর আর এক তীব্র যন্ত্রণা বোধ, প্রতিদিনের চলার যন্ত্রণা। বেঁচে থাকাকে মেনে না নেওয়ার যন্ত্রণা। বেঁচে থাকাটাইতো কষ্টের! অকেজো হয়ে কেন, কি দরকারে বেঁচে থাকা?
অনেক ক্ষেত্রে সহজ বিষয়টি হয়ে উঠে আরো কঠিন। তারা এটাও ভাবেন আমার ওপর ভর করে যারা বেঁচে আছে, তাদের কি হবে? তাদেরইবা বেঁচে থাকার দরকার কি? শুরু হয় আরেক পরিকল্পনা। তারপর নিজে নিজেকে, অথবা তাদের সবাইকে আগে অকেজো করে ফেলে, শেষে নিজেকে হত্যা করা। আত্মহত্যা অথবা হত্যা-আত্মহত্যা।
• পৃথিবীতে যত রকমের আত্মহত্যা হয় তার প্রায় নব্বই ভাগ, অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন আত্মহত্যা করেন কোনো না কোনো মানসিক রোগের কারণে।
• আত্মহত্যার কারণগুলোর বেশিরভাগই চিকিৎসা যোগ্য এবং এই আত্মহত্যাগুলো অবশ্যই ঠেকানো সম্ভব। জীবনের দরজাটাকে একটু ঘুরিয়ে দিয়ে সূর্যের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আলো আসবেই, এই বিশ্বাসটুকুকে পুনরায় মনের ভিতর শুধু জ্বালিয়ে দিতে হবে।
WHO এর হিসেব অনুযায়ী প্রতিদিন তিন হাজারের মতো মানুষ সারা পৃথিবীতে আত্মহত্যা করছে। তারও প্রায় ২০ গুণ বেশি লোক নিজেকে মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করছে। International Association for Suicide Prevention, WHO সহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলো সারা পৃথিবীজুড়ে চেষ্টা শুরু করছে আত্মহননকারী আচরণ গুলোকে সনাক্ত করা ও সেসবের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার। যারা এই চেষ্টা করে বেঁচে গেছেন তাদের বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাদের পরবর্তী চিকিৎসা পরিচালনার জন্য।
সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ আত্মহত্যা করেন। হিসেব করলে দেখা যাবে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করছে। ভয়াবহ কথা হলো, প্রতিবছর আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃতের পরিমান, যুদ্ধ এবং হত্যা করে নিহত মোটের লোকের চেয়ে সংখ্যায় বেশি।
প্রতিপাদ্য বিশ্লেষণ:
এবারের প্রতিপাদ্যকে বিশ্লেষণ করলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। প্রতিপাদ্যে বলা হয়েছে, ‘কুসংস্কার: আত্মহত্যা প্রতিরোধের বড় অন্তরায়।’ ‘কুসংস্কার’ বলতে কিসের কুসংস্কার, কার কুসংস্কার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া উচিত।
মানসিক অসুস্থতা ও আত্মহত্যা জনিত আচরণের বিষয়ে কুসংস্কারের কথা বলা হয়েছে। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে, দিবসটি উপলক্ষে আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য বিশ্বসংস্থার এবারের নিজস্ব লিফলেটের থেকে কিছু অংশ সরাসরি উদৃতি করা হলো, (…..knowledge is not enough to combat stigma. Negative attitudes about individuals with mental illnesses and/or suicidal ideation or impulses - prejudice - is common in many communities). অর্থাৎ ‘মানসিক রোগ’ ও ‘আত্মহত্যা জনিত আচরণ’ সম্পর্কে অসচেতনতা ও নেতিবাচক মানসিকতাই মূল কারণ।
এখানে, একটি কথা না বললেই নয়, আত্মহত্যা বিষয়ক প্রতিবেদন মিডিয়াতে প্রকাশের ক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণ থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। যেটি সত্যি সত্যিই বিবেচ্চ।
আত্মহত্যাকে বলা হয়েছে, প্রতিরোধ যোগ্য সবচেয়ে বড় অপমৃত্যুর কারণ। এমন কোনো রিপোর্ট বা নিউজ করা উচিত নয়, যা দেখে ঘটনাটিকে কেউ ভালো কিছু ভাবতে পারেন। এ বিষযে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের একটি উদাহরণ টানা যেতে পারে, সেটি হলো এইডস। এইডস সম্পর্কে সঠিক ধারনা না থাকার কারণে বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা ছিলো, মিডিয়ার কারণে বর্তমানে তা অনেক কমে এসেছে।
শুধু মিডিয়ার দায়িত্ব বলে শেষ করে দিলে হবে না, মানসিক রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রয়োজনীয় লোকবল ও সুযোগ সুবিধার অভাবকেও এধরনের কুসংস্কারের কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কুসংস্কার কমানেরা জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প কিছু নেই, সেই সঙ্গে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বড়াতে হবে। নিচের লিঙ্কটি দেওয়া হলো, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য ও উপায় সেখানে দেওয়া আছে।
সবশেষে বলতে চাই, সব সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। কোনো অপমৃত্যু নয়। জীবনে নতুন আলো চাই।