বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে কলঙ্কজনক ও লজ্জাজনক দৃশ্য দেখা গেলো। ক্যাম্পাসের জনশ্রুতি রয়েছে, প্রশাসনের সেই ‘ম্যানেজ’ থিওরির কাছে হার মেনে গেলেন এসব প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ। একটি ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতাকে বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হলো। ম্যানেজ করা হলো অন্য সংগঠনটিকেও। এদের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনেদেনের বিষয়টি ক্যাম্পাসে এখন অপেন সিক্রেট। সমন্বয় সাধনে সফলতার জন্য উপাচার্য নিজে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে সেই কতিপয় সাংবাদিকের দিয়ে একটি বিকল্প সাংবাদিক সংগঠন খুলে দিলেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ভাওয়াল অঞ্চলের প্রভাবে লাল মাটি আর শালবনের সমাহার, লাল শাপলার লেক, অতিথি পাখির কলকাকলী আর জীব বৈচিত্র্য এ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। শিক্ষার্থীদের স্বতস্ফূর্ত সাংস্কৃতিকচর্চা আর প্রগতিশীল রাজনীতির অবাধ অভিব্যক্তি প্রকাশের অনন্য সুযোগ ক্যাম্পাসটিকে ভিন্নধর্মী স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত করেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের কিছু সিদ্ধান্ত ক্যাম্পাসের শিক্ষা ও গবেষণার মান নষ্টের পাশাপাশি ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা কিছু বুঝে না উঠার আগেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। পাশাপাশি সৃষ্টি হয় অনাকাঙ্খিত অনেক সমস্যার। যেগুলো সহ্য করা কঠিন। অন্যায় সত্বেও প্রতিবাদ করা আরো কঠিন। কারণ, বর্তমান প্রশাসন শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ভয় প্রদর্শন করে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন, প্রতিবাদ করলেই বহিষ্কার। ১০জুলাই ২০১০এর ছাত্রলীগের দু‘গ্রুপের সংঘর্ষের সময় প্রতিবাদ করায় বহিষ্কার হতে হয়েছিল তৎকালীন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মাহি মাহফুজকে। এরপর লোডশেডিংয়ের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সংযুক্ত, পরীক্ষা পদ্ধতিতে এক্সটার্নাল ও ইন্টারনাল নিজ বিভাগ থেকেই মননোয়ন, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম আয়োজনে অতিথি ঠিক করা, মুক্তমঞ্চসহ প্রোগ্রাম স্পট নির্ধারণে কঠিন শর্ত আরোপ, রাত ১১টার আগেই বটতলার দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া, দেদারচে বৃক্ষ নিধনসহ ব্যাপক অনিয়ম পরিলক্ষিত হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মানসিকতা গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি।
সবসময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী মনোভাবের স্বতস্ফূর্ত প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারীতে শিক্ষার্থী জুবায়ের ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর পাল্টে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। উত্তাল হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টি বারবার উঠে আসে আন্দোলনের স্লোগানে। পরিস্থিতি প্রশাসনের প্রতিকূলে যেতে থাকে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি আলোচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক আরজু মিয়া লাঞ্ছিত করেন শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক এ এ মামুনকে। আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে উঠে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হয় জুবায়ের হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে লাঞ্ছণার বিচার, অযোগ্য ও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল, আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণসহ বিভিন্ন ইস্যু। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে নড়ে ওঠে স্বৈরাচারী প্রশাসনের ভীত।
যেকোন উপায়ে আন্দোলনরতদের ‘ম্যানেজ’ করার দুর্বিপ্রায় এক অভিলাষ জেগে ওঠে উপাচার্যের মনে। ম্যানেজ করা হয় কতিপয় সাংবাদিককে। এই কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদের পত্রিকা পড়লে মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন প্রদেশ। বাস্তবতার সঙ্গে পত্রিকার সংবাদের সত্যতার মিল খুঁজতে যাওয়াটাই হয় বোকামী। সচেতন পাঠকদের মনে জিজ্ঞাসা, পত্রিকার নির্বাহী পরিষদ কি অন্ধ! প্রতিনিধি যা লিখে পাঠায়, তাই ছাপায়। অথচ চোখ কান একটু খোলা রাখলেই দেখা যায়, কি পরিমানে অসত্য তথ্য পরিবেশন করা হয় এসব পত্রিকাগুলোতে! যা হোক, যেকোন উপায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানেজ’ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এদের।
এই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে গতিশীল সংগঠনগুলো হলো প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনসমূহ। অতীতে ক্যাম্পাসে শিবির নিধন আন্দোলন, খুনি ও ধর্ষক প্রতিরোধ আন্দোলন, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ শিক্ষার্থী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যেকোন আন্দোলনে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে এসব প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন সমূহ। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে কলঙ্কজনক ও লজ্জাজনক দৃশ্য দেখা গেলো। ক্যাম্পাসের জনশ্রুতি রয়েছে, প্রশাসনের সেই ‘ম্যানেজ’ থিওরির কাছে হার মেনে গেলেন এসব প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ। একটি ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতাকে বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হলো। ম্যানেজ করা হলো অন্য সংগঠনটিকেও। এদের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনেদেনের বিষয়টি ক্যাম্পাসে এখন অপেন সিক্রেট। সমন্বয় সাধনে সফলতার জন্য উপাচার্য নিজে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে সেই কতিপয় সাংবাদিকের দিয়ে একটি বিকল্প সাংবাদিক সংগঠন খুলে দিলেন। বন্ধ হয়ে গেলো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।
শিক্ষকদেরও ভয়ভীতি, বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা এখন সচেতন। অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা একাট্টা। অনেক সহ্য করা হয়েছে নীরবে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি- যেকোন উপায়েই প্রতিরোধ করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র শিক্ষাঙ্গনকে। আর কোন অবৈধ কর্মকান্ড মানা হবে না। পদত্যাগ করতেই হবে উপাচার্যকে।
ড. শামসুল আলম সেলিম
অধ্যাপক:সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১২ সকাল ৭:৫৩