বেঁচে গেলেন, ফাঁসির দণ্ড হয়নি। রায় ঘোষণার পর রফিক ভাই ভেতরের হতাশা প্রকাশ না করে হাসিমুখেই আমাকে বললেন, বেঁচে গেছেন যে ফাঁসির দণ্ড দেয়নি। আইনজীবী, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে শেষবারের মতো কোলাকুলি করে অসংখ্য পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে প্রধান বিচারপতির আদালত ত্যাগ করলাম। হাজতি মাহমুদুর রহমানের আজ কয়েদিতে প্রমোশন হলো।
(গতকালের পর)
প্রিজন ভ্যান জেলে পৌঁছানোর আগেই আমার আদালতে অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর রেডিও এবং গোয়েন্দা সংস্থা মারফত জেলে পৌঁছে গেছে। অন্যদিনের মতো সরাসরি সাত নম্বর সেলে যেতে দেয়া হলো না। দুই ডাক্তার তাদের জেলগেট সংলগ্ন কক্ষে রক্তচাপ মাপার যন্ত্রপাতি নিয়ে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। কোনো বাধায় কাজ হলো না। তারা পরীক্ষা করবেনই।
আল্লাহর রহমতে শরীরের অবস্থা ততক্ষণে ভালো হয়েছে। রক্তচাপ এখন ১০০ এবং ৭০। জেল ডাক্তার সহানুভূতির সঙ্গেই রোজা ভাঙার জন্য অনুরোধ করলে আগের মতোই অসম্মতি জানালাম। সেলে ফিরে দেখি, আমার আড়াই মাসের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে ফেরার অপেক্ষা করছে। বরাবরের মতো দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে ফিরতে দেখে সবাই আশ্বস্ত হলো। বড় সাহেবরা জেলে এসে সামান্য অসুস্থতাতেই হুইল চেয়ারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি জীবনের নানারকম চড়াই-উতরাই পার করলেও মানসিকভাবে কখনও মধ্যবিত্তের স্তর অতিক্রম করতে পারিনি। কাজেই পা দুটো সচলই থাকে।
রোজা না ভাঙলেও শরীর বিশ্রাম চাইছিল। ঘণ্টাখানেকের বিড়াল নিদ্রা (cat-nap) দিয়ে উঠে দ্বিতীয়বার গোসল করে কাজে বসে গেলাম। কাল অবধারিত সাজা আসছে জানলেও আমার কোনো দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। আজকের দুর্ব্যবহারের জবাব কাল সকালে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে কেমন করে ফিরিয়ে দেয়া যায়, একমাত্র সেই চিন্তাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। আইনের বইপত্র নেই, কম্পিউটার নেই, ফ্যাক্স মেশিন নেই, থাকার মধ্যে খাতা এবং কলম। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাজ করলাম। লিখছি আর কেটে-ছেঁটে ছোট করছি। কিছুতেই দশ মিনিট অতিক্রম করা যাবে না। সেলের মধ্যেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পায়চারি করছি আর বিড়বিড় করে রিহার্সেল দিচ্ছি।
রাতের প্রহরী মাঝে মাঝে এসে সেলের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে। বক্তব্য শেষ করতে ক্রমেই সময় কম লাগছে। প্রথমে কুড়ি মিনিট, তারপর পনেরো, শেষপর্যন্ত দশ মিনিটে পারলাম। ততক্ষণে অবশ্য সেহরির সময়ও প্রায় শেষ। ভোর পাঁচটায় গোসল করে ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুমিয়ে নিলাম। দাঁড়িয়ে থেকে নিজের বক্তব্য দেয়া এবং ক্রোধান্বিত মাননীয় বিচারপতিদের ভর্ত্সনা সইবার মতো শক্তি অর্জন করতে হবে। আমার কথাগুলো লিখিতভাবে দিতে না পারলেও কোর্টের রেকর্ড তো থাকবে। যে ক’টি সংবাদপত্রেই সেই বক্তব্য ছাপা হোক, তাদের ইন্টারনেট সংস্করণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে এদেশের একজন নাগরিকের ওপর প্রশাসনিক ও বিচারিক নির্যাতনের কাহিনী। তারপর আমার অদৃষ্ট।
সকাল ঠিক সাড়ে ন’টায় বিচারপতি এজলাসে উঠলেন। আমি নিষ্কম্প চিত্তে হাতের কাগজপত্র নিয়ে বক্তব্য প্রদানের নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আগামী দশ মিনিটের মধ্যে সাব্যস্ত হয়ে যাবে আমি এখান থেকে সসম্মানে জেলে ফিরতে পারব কি-না। মামলার রায় আমার কাছে তখন সম্পূর্ণ মূল্যহীন, দশ মিনিট অন্তে প্রমাণ হবে যে আদর্শের জন্যে আমার এই অসম এবং কারও কারও মতে নির্বোধ লড়াই, সেই আদর্শের মর্যাদা রাখতে পারলাম কি-না।
প্রথমেই সুশীল (?) ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের আগের দিনের একটি কপি আদালতে জমা দিয়ে বললাম, ওই পত্রিকাটিতে চলমান মামলারই সংবাদ ছাপা হয়েছে। সেই সংবাদে প্রধান বিচারপতির নামের উল্লেখ রয়েছে সম্মানসূচক ‘মাননীয়’ ছাড়াই। সংবাদপত্রে লেখার এটাই প্রচলিত রীতি। রাষ্ট্রপতির নামের আগেও কখনোই মহামান্য লেখা হয় না। কাজেই আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে চেম্বার জজের নাম উল্লেখকালে সেখানে মাননীয় না লেখায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি। এটাও বললাম, এই মাননীয় না লেখার কারণে আমার সঙ্গে আগেরদিন আদালতে যে চরম অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি প্রত্যাশিত ছিল না। আমার বক্তব্য দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতি বিষয়টি গতকালের তাই পুরনো, মন্তব্য করে আমাকে থামানোর চেষ্টা করলেন। আজ আমি কোনো আক্রমণেই পিছু হটতে প্রস্তুত নই। এরপর চেম্বার জজ আদালত প্রসঙ্গে আমার নিজের একটি মামলার উদাহরণ দিলাম। তেজগাঁও থানার দায়ের করা পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার মামলায় হাইকোর্ট থেকে প্রাপ্ত জামিন চেম্বার জজ আদালতে স্থগিত করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মামলার অভিযোগের ভিত্তিতে। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস কাগজপত্রে এই জালিয়াতি করেছে।
সম্পূর্ণ বিষয়টি বিবৃত করে আদালতকে জানালাম, আমি কেবল বন্দি অবস্থায় পুলিশের হাতেই নির্যাতিত হইনি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিচার বিভাগের নির্যাতনেরও শিকার হয়েছি। এই মামলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কী প্রমাণ করতে চাচ্ছি, প্রধান বিচারপতির এমন প্রশ্নের জবাবে আমি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের জালিয়াতির মাধ্যমে আদালতকে বিভ্রান্ত করার কথা বললাম। আমার দেশ পত্রিকার সংবাদে ভিন্ন মামলায় একই প্রকার জালিয়াতির উল্লেখ ছিল। আগেরদিন সাংবাদিকতায় আমার অনভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে আদালতে আমাকে chance editor নামে অভিহিত করে অবজ্ঞা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে অন্য পেশা থেকে সরাসরি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন এমন তেরো জন সম্পাদকের তালিকা আদালতের হাতে তুলে দিলাম। সেই তালিকার মধ্যে এদেশের সাংবাদিকতা জগতে কিংবদন্তিতুল্য ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা এবং পাকিস্তান অবজার্ভার, যেটা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অবজার্ভার হয়েছিল, তার সম্পাদক আবদুস সালামের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। মরহুম আবদুস সালামকে সরকারের সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় লেখার অপরাধে শেখ মুজিবের আমলে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছিল—উল্লেখ করতেই মাননীয় বিচারপতিদের গাম্ভীর্য বেড়ে যাওয়া লক্ষ্য করলাম। আমার অবশ্য তখন আর নতুন করে হারানোর কিছু নেই।
সরকারপক্ষের দীর্ঘ বক্তব্য প্রদানকালে বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি এম এ মতিনকে আমার এফিডেভিটের একটি লাইন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে শুনেছিলাম। বিচারপতি এম এ মতিন তো ওই বাক্যটি লেখার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে আরও একটি আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা যায়—এ জাতীয় মন্তব্যও করেছেন। বাংলাদেশে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে যে নানারকম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, সেটাই বলা হয়েছিল উদ্ধৃত বাক্যটিতে। “That the contemnor-respondent no. 1 appreciates that the courts of Bangladesh operate in a difficult environment in so far as the independence of judiciary is concerned.” বাংলাদেশের কোনো বিবেকবান নাগরিকেরই এই বাক্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ না থাকলেও আমার ওপর রুষ্ট মাননীয় বিচারপতিরা এখানেও দোষ খুঁজে পেয়েছেন। আমি আত্মপক্ষ সমর্থনে বললাম, ‘মাননীয় বিচারপতিরা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বাক্যটির অর্থ জানতে চেয়েছেন। অর্থ অত্যন্ত সহজ। এই দেশে মন্ত্রীর নেতৃত্বে হাইকোর্টে লাঠিমিছিল হয়েছে, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তিবাসীদের ডেকে এনে বসানো হয়েছে, প্রধান বিচারপতির এজলাসসহ আদালতে ভাংচুর চালানো হয়েছে, জেনারেল মইনের প্রচ্ছন্ন সামরিক জামানায় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আদালতে বসে প্রকাশ্যে বিচার প্রভাবান্বিত করেছেন, সেই সময় সাফাই সাক্ষীদের ভয় দেখানোর জন্যে বিশেষ আদালতের গোপন কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, কর্তব্যকাজে অবহেলার জন্য হাইকোর্ট সুয়ো-মোটো রায়ে যে ব্যক্তিকে একটি মামলায় পিপি’র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন, তিনিই আজ বাংলাদেশের আইন প্রতিমন্ত্রী। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সমস্যার কথা বলতে এই ঘটনাগুলোর দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।”
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি নেতিবাচক মন্তব্য করলেও কেবল আমাকেই সাজা দেয়ার উত্সাহ সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, সেটাও উল্লেখ করলাম। সেই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” আমার পরবর্তী যুক্তি ছিল, সরকারপক্ষ চারদিন ধরে বক্তব্য দিলেও আমার জবাবের জন্য আজ মাত্র দশ মিনিট সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এটা সংবিধানের ১০৪ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ওই অনুচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ওপর সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের (complete justice) মহান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
বাদীপক্ষ তাদের বক্তব্যে অভিযোগ করেছিল, আমার দেশ-এ প্রকাশিত সংবাদে চেম্বার জজ আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে আমরা আদালত অবমাননা করেছি। এই অভিযোগের জবাবে আমি রিপোর্টের উদ্ধৃত অংশটি আদালতে পড়ে শোনালাম, “উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের রুলস্ অনুযায়ী কোনো মামলা আপিল বিভাগে যাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়। হাইকোর্টের আদেশ বা নির্দেশনার বিরুদ্ধে প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করা হয়। চেম্বার জজ সেই আবেদনের ব্যাপারে যে কোনোরকম আদেশ দেয়ার এখতিয়ার রাখেন। এছাড়া আপিল বিভাগের কোনো মামলা শুনানির তালিকাভুক্ত করতে বা শুনানির জন্য দিন ধার্য করতে প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করতে হয়।” এতটা পরিষ্কারভাবে চেম্বার জজ আদালতের এখতিয়ারের বিষয়ে লেখার পর বাদীপক্ষের অভিযোগের যে আর কোনো ভিত্তি থাকে না, সেটাও উল্লেখ করলাম। মাননীয় বিচারপতিদের ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা, বিরক্তি, আক্রোশ সবই টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি একেবারেই বেপরোয়া।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বেঁধে দেয়া দশ মিনিটের মাত্র তিন মিনিট বাকি রয়েছে। ঝড়ের বেগে শেষ কথাগুলো বললাম। “Watch dog এবং Custodian of truth হিসেবে সংবাদপত্রের দায়িত্ব আদালতসহ রাষ্ট্রের সব অংশ সম্পর্কে জনস্বার্থে সত্য সংবাদ প্রকাশ করা। ‘চেম্বার মানে সরকারপক্ষে স্টে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করার মাধ্যমে আমার দেশ সেই দায়িত্ব বস্তুনিষ্ঠভাবে পালন করেছে। আমি সম্পাদকের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই এই সংবাদ প্রকাশের অনুমতি দিয়েছি। আমার বিবেচনায় আমি আদালত অবমাননা করি নাই। বরং মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে আদালতকে বিব্রত করে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসই আদালত অবমাননা করেছে।”
শেষ এক মিনিটের বক্তব্য ইংরেজিতে দিলাম। বললাম, “My academic background in BUET, IBA and Japan, my govt. position as BOI Chairman and Energy Advisor and my pioneering role in Bangladesh in manufacturing and export of Bone China were dismissed as ‘এই সেই’ in this court yesterday. During my 34 years of ‘এই সেই’ career, two years of role of Chance Editor was most gratifying and rewarding. Under my editorship, Amar Desh stood resolutely and valiantly in favor of human rights, liberty, national interest and rule of law. I am proud of my colleagues. I salute them. They are now in problem. But, this is the price one has to pay for persuing the path of truth. I know truth is no defence here. However, truth is becoming a defence in other places as has been seen in the case of most recent Delhi High Court judgment. Most importantly, truth is the only defence in the ultimate court.
With this I conclude my submission.”
আমাকে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেয়ার জন্য আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে মওদুদ ভাই এবং রাজ্জাক ভাইয়ের পাশে বসে পড়লাম। মওদুদ ভাই আমাকে অভিনন্দন জানালেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে তার সমাপনী বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। তার অফিসের যাবতীয় দুষ্কর্মের প্রসঙ্গ এড়িয়ে তিনি আমাকে ‘হিরোইজম’ রোগে আক্রান্ত বলে আবার দৃষ্টান্তমূলক ও কঠোর সাজার দাবি জানালেন। এগারোটার আগেই আদালত মুলতবি হয়ে গেল। এজলাস ত্যাগের আগে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করলেন, সাড়ে এগারোটায় রায় জানানো হবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রধান বিচারপতির এজলাসে তিলধারণের ঠাঁই নেই। আমি জানি না সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসে কোনো রায় শোনার জন্য এত মানুষের সমাগম হয়েছে কি-না। অপেক্ষা করে আছি, রায় আর আসে না। সাজা যে হবে, সে তো জানা কথাই। কিন্তু সেটা কতখানি নজিরবিহীন করা যায়, এই বিষয়েই সম্ভবত মাননীয় বিচারপতিরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। শেষপর্যন্ত দুপুর সাড়ে বারোটায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন। প্রধান বিচারপতি সংক্ষিপ্ত আদেশের মাধ্যমে রায় ঘোষণা করলেন। প্রথমেই উল্লেখ করলেন, রায় বিভক্ত হয়েছে। ছয়জন বিচারপতির মধ্যে একজন সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
এরপর প্রধান বিচারপতি সাজা শোনালেন। এক নম্বর আসামি অর্থাত্ আমার ছয় মাসের কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের জেল। প্রতিবেদক এবং সিনিয়র সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের এক মাসের কারাদণ্ড, দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক সপ্তাহের অতিরিক্ত কারাদণ্ড। প্রকাশক হাসমত আলীর দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক সপ্তাহের কারাবাস। চিফ রিপোর্টার সৈয়দ আবদাল আহমদ এবং নিউজ এডিটর মুজতাহিদ ফারুকীর অপরাধ মার্জনা করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ছাড়া উপস্থিত অন্যান্য আইনজীবী স্তম্ভিত হলেন। আদালত অবমাননা মামলায় এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান আমাদের দেশের আইনে নেই। সুপ্রিমকোর্ট তাদের inherent right প্রয়োগ করে আমাকে নজিরবিহীন এক লাখ টাকার সাজা দিয়েছেন। শুনানিকালে বিচারপতি এস কে সিনহা কেন বার বার সংবিধানের ১০৮ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ করছিলেন, সেটা খানিকটা স্পষ্ট হলো। আমি এবং অলিউল্লাহ নোমান সেখানেই জরিমানা না দিয়ে অতিরিক্ত জেলবাসের সিদ্ধান্ত নিলাম। অলিউল্লাহ নোমানের মতো পেশার প্রতি আদর্শবান তরুণরাই এদেশে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে। রফিক ভাই ভেতরের হতাশা প্রকাশ না করে হাসিমুখেই আমাকে বললেন, বেঁচে গেছেন যে ফাঁসির দণ্ড দেয়নি।
বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেছেন, তাই আবেগ প্রকাশে কোনো বাধা নেই। আইনজীবী, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে শেষবারের মতো কোলাকুলি করে অসংখ্য পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে প্রধান বিচারপতির আদালত ত্যাগ করলাম। হাজতি মাহমুদুর রহমানের আজ কয়েদিতে প্রমোশন হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসন জুন মাসের দুই তারিখে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার মামলায় আমাকে হাজতি হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছিল। উনিশে আগস্ট আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি আদালত অবমাননা মামলায় আমাকে দণ্ড দিয়ে কয়েদি হিসেবে সেই নাজিমউদ্দীন রোডেই ফেরত পাঠালেন। কেবল সাজা দেয়ার ক্ষেত্রেই নয়, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও সুপ্রিমকোর্ট সম্ভবত নতুন নজির সৃষ্টি করলেন। জুন মাসের ২ তারিখে অর্থাত্ আমার গ্রেফতারের পরদিন রুল ইস্যু করে আগস্টের ১৯ তারিখে পাঁচদিন টানা শুনানি শেষে রায়, মাত্র ২ মাস ১৭ দিনের মধ্যেই মামলার তাবত্ কার্যক্রম সমাপ্ত। এমন কর্মতত্পরতা প্রদর্শনের পর কোন দুর্মুখ আর বলবে বাংলাদেশে বিচারপ্রাপ্তিতে বিলম্ব হয়? দীর্ঘদিন জেলবাসের মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি সত্ত্বেও মিশ্র অনুভূতি নিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। (চলবে)