প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে—সংবিধানের এ লেখাও কি সংশোধন করা হয়েছে? নইলে কাজীর কেতাবের সঙ্গে এর এত মিল কেন! যেখানে লেখা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে গোয়ালে গরু ছিল না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও সরকারি বাহিনীই যে মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সেটা আবারও প্রমাণ হলো ১৬ বছরের ছাত্র লিমনকে গুলি করার ঘটনায়। হাসপাতালে তালাবদ্ধ লিমনকে দেখতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও। তিনি এই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছেন। এমন দাবি নতুন না হলেও আমরা দেখতে চাই এই নির্মমতার শেষ কোথায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা আইনের কতটা ঊর্ধ্বে, সেটাও জানা দরকার।
নিরীহ, নিরপরাধ লিমন কীভাবে গুলিবিদ্ধ ও পঙ্গু হয়েছে, সেটা এখন সবার জানা। আরও জানা গেছে, মিডিয়ায় এ ঘটনা প্রচারের পর পুলিশ কী করেছে। উচ্চপর্যায়ের ফোন পেয়ে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন লিমনের ওয়ার্ডের দরজায় তালা লাগিয়েছে পুলিশ। সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশে বাধা দেয়ার যোগ্য কাজই বটে! লিমনের কথা শুনে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এমন বর্বরতা কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন। আমাদের সমাজ যে বর্তমানে অনেকাংশেই অসভ্য হয়ে উঠেছে, বলাটা বাহুল্যই। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কায় থাকে মানুষ, সে সমাজকে সভ্য বলতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসাই স্বাভাবিক।
কিন্তু গণ্ডারের চামড়া বলে কথা। লিমনের ঘটনার পর আগের মতোই ‘ক্রসফায়ার’র সেই গল্প শোনাতেই ব্যস্ত অভিযুক্ত র্যাব। চোখ বন্ধ করে তারা যেন দিনের আলোকেই অস্বীকার করতে চায়। গ্রামবাসীর কথা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কথা সবকিছুই তুড়ি মেরে উড়িয়ে তারা নিজেদের সাফাই গাওয়ার সাহস পায় কোথা থেকে, সেটাই প্রশ্ন। সরকারের বাইরে গিয়ে কিছু করার ক্ষমতা কি আছে তাদের?
সাম্প্রতিককালে বেশক’টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কথা জানা গেছে। এর অন্তত দু’টিতে সংশ্লিষ্ট আইনরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দোষ প্রমাণিত হয়েছে। এরপর কী হয়েছে, কেউ জানে না। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে আদালতে বিচারের জন্য যাওয়া হয়েছে কি? যদি না হয় তাহলে এ ধরনের লোক দেখানো তদন্তের গুরুত্বই বা কি! এ জন্যই পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এলিট ফোর্স হিসেবে গঠনের পর সন্ত্রাস দমনে বিশেষ করে ধর্মীয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাফল্যের ঘটনায় র্যাবের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, সেটা এখন কোথায় নেমেছে ভেবে দেখলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। পুলিশের মতো র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধেও খুন-খারাবিসহ নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দিন দিনই বাড়ছে। র্যাবে শুধু পুলিশ নয়, অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। অপরাধ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের এত ঘটনার পর মূল বাহিনীতে ফিরে যাওয়ার সময় তারা কী ধারণা ও মানসিকতা নিয়ে যান, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
লিমনের গুলিবিদ্ধ ও পঙ্গু হওয়া এবং পরবর্তী ঘটনায় শুধু র্যাবের নয়, দেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন বর্বরতার বিচার না হলে আইনের শাসন ও শৃঙ্খলা উভয়ই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। যেখানে অপরাধীরও বিচার লাভের অধিকার স্বীকৃত, সেখানে নিরপরাধ ছাত্রকে গুলি করে সাফাই গাওয়ার পরও যদি অপরাধীর শাস্তি না হয়, তবে এর সব দায় বহন করতে হবে সরকারকেই। জনগণই এর বিচার করবে।