শহীদ পরিবার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ স্বাধীনতার পর সরকারিভাবে একটি বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র তিন দিন পরই সে বাড়ি থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল রক্ষীবাহিনী। এছাড়া নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালের ৫ মে শহীদ হওয়ার পর পিরোজপুরে তাদের সরকারি বাসা লুট হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ পিরোজপুর থানায় লুটের মামলা করেন। সে মামলার আসামির তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। বাসা লুটের মামলায় আয়েশা ফয়েজ পাকিস্তানি দু’জন সেনাকর্মকর্তাকে আসামি করেন। তারা হলেন ক্যাপ্টেন এজাজ ও লে. শহিদ।
হুমায়ূন আহমেদের পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরের পুলিশ প্রধান (সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার, এসডিপিও) ছিলেন। তার স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ ১৯৭১ সালে পিরোজপুরের স্মৃতিচারণ করে জীবন যে রকম নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তার স্বামী ফয়জুর রহমান শহীদ হওয়ার পর বাসা লুটের কথা বর্ণিত আছে। বাসা লুটের মামলায় যেমন মাওলানা সাঈদীর নাম নেই তেমনি জীবন যে রকম বইয়ে বাসা লুটের যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সেখানেও মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব অভিযোগে বিচার চলছে তাতে একটি অভিযোগ হলো সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা শহীদ ফয়জুর রহমানসহ পিরোজপুরে তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যায় সহায়তা করা। কিন্তু আয়েশা ফয়েজ তার জীবন যে রকম বইয়ে স্বামীর হত্যা বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তো দূরের কথা বইয়ে তিনি মাওলানা সাঈদীর নামও উল্লেখ করেননি কোনো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করে। বাড়ি লুট ছাড়াও স্বামী হত্যা বিষয়ে স্বাধীনতার পর পিরোজপুরে তিনি একটি হত্যা মামলা করেন। সেখানেও তিনি দু’জন প্রধান আসামির নাম উল্লেখ করেছেন যথা ব্রিগেডিয়ার আতিক রশিদ ও মেজর এজাজ।
বাসা লুট : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এসডিপিও ফয়জুর রহমান তার স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ ও ছেলেমেয়েদের পিরোজপুরের সরকারি বাসা ছেড়ে নাজিরপুর থানার নিভৃত পল্লী বাবলা গ্রামে গোপন আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। সেখানে একদিন গোপনে পরিবারের সাথে দেখা করতে আসেন ফয়জুর রহমান। এ অবস্থায় পিরোজপুর থানার ওসি তফাজ্জাল হোসেন তাকে অভয় দিয়ে পিরোজপুর আসার জন্য চিঠি লেখেন।। চিঠিমোতাবেক পিরোজপুর হাজির হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৫ মে ফয়জুর রহমানকে বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়।
স্বামী হত্যার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আয়েশা ফয়েজ সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে একা ছুটে যান পিরোজপুর। ওসি তফাজ্জালসহ স্বামীর অফিসের অধস্তন কর্মকর্তা, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজাল, সবার সাথে দেখা করে স্বামীর বিষয়ে সঠিক খবর জানতে চান। কিন্তু সবাই তার কাছে স্বামী ফয়জুর রহমান হত্যার কথা গোপন রাখে। স্বামীর ব্যাপারে কোনো সন্ধান না পেয়ে আয়েশা ফয়েজ ফিরে আসেন পিরোজপুর তাদের সরকারি বাসায়। সে বাসা লুট হওয়া বিষয়ে তিনি তার বইয়ে যা লিখেছেন তা এখানে তুলে ধরা হলো।
‘আমি একা বাসায় বসে আছি। রাতে ঘরদোর গুছিয়ে বাসায় বসে থাকলাম। ...কিন্তু সে (স্বামী ফয়জুর রহমান) আর আসে না। ভোর হতেই সবাই আমাকে চাপ দেয় চলে যাবার জন্য। .... আমি তখন বাসা ছেড়ে বাচ্চাদের কাছে যাবো বলে ঠিক করলাম। আমি আবার ঘর পরিষ্কার করে দিলাম। কাজলের (হুমায়ূন আহমেদ) বাবা যদি ফিরে আসে তার জন্য পরিষ্কার কাপড় আলনায় ঝুলিয়ে দিলাম। বিছানায় নতুন চাদর দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম। রিকশা নৌকাঘাটে পৌঁছানোর আগেই মিলিটারিরা সদলবলে এসে আমার বাসা লুট করে নিল। আমার এত দিনের সংসার, কাজলের আব্বার শত শত বই, তার লেখা অপ্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি, বাচ্চাদের ছেলেবেলার স্মৃতি সব কিছু তছনছ হয়ে গেল। রাস্তার মানুষ ডেকে মিলিটারি আদেশ দিলো সব কিছু লুট করে নিয়ে যেতে।’
রক্ষীবাহিনী তাড়িয়ে দেয় হুমায়ূন আহমেদদের : শহীদ পরিবার হিসেবে আয়েশা ফয়েজ স্বাধীনতার পর একটি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন সরকারিভাবে। সে বাসায় ওঠার তিন দিনের মাথায় তাদেরকে রক্ষীবাহিনী বাসা থেকে পথে নামিয়ে দেয়। সে কথা লিখেছেন তিনি তার জীবন যে রকম বইয়ে।
‘বাবর রোডের বাসায় ওঠার তিন দিন পর হঠাৎ একদিন রক্ষীবাহিনী এসে হাজির হলো। একজন সুবেদার মেজর জিজ্ঞাসা করল, এ বাড়ি আপনি কোথা থেকে পেলেন?
আমি বললাম সরকার আমাকে দিয়েছে। আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাই।
সুবেদার মেজর কিছু না বলে চলে গেল। আমার মনের ভেতর হঠাৎ করে একটা খটকা লেগে গেল। হঠাৎ করে রক্ষীবাহিনী আসছে কেন? ক্ষাণিকক্ষণ পর আরেকজন সুবেদার মেজর এসে হাজির। সে একা নয়। তার সাথে বোঝাই এক ট্রাক রক্ষীবাহিনী। সবার হাতে অস্ত্র। সুবেদার মেজরের নাম হাফিজ। ভেতরে ঢুকে বলল, এই বাড়ি আমার। শেখ সাহেব আমাকে দিয়েছেন।
আমি বললাম, সে কি করে হয়? আমার সাথে বাসার অ্যালটমেন্ট রয়েছে।
সে কোনো কথা না বলে টান দিয়ে ঘরের একটা পর্দা ছিঁড়ে ফেলল। সাথে আসা রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বলল ছেলেমেয়েদের ঘাড় ধরে বের কর।
আমি এত দিনে পোড় খাওয়া পাথর হয়ে গেছি। রুখে দাঁড়িয়ে বলেছি, দেখি তোমার কত সাহস।
সুবেদার মেজর একটু থমকে গিয়ে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে পুরো এলাকা রক্ষীবাহিনী দিয়ে বোঝাই হয়ে গেল। বাসা চার দিকে ঘেরাও হয়ে আছে। কাউকে বাসায় ঢুকতেও দেয় না, বের হতেও দেয় না। কাজল (সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ) মহসিন হলে ছিল। খবর পেয়ে এসেছে। তাকেও ঢুকতে দিলো না। সারা রাত এভাবে কেটেছে।
ভোর হতেই আমি বের হলাম। পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। পুলিশ বললÑ আমরা গোলামির পোশাক পরে বসে আছি। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কি করব?
বঙ্গভবন, গণভবন এমন কোনো জায়গা আমি বাকি রাখলাম না সাহায্যের জন্য। কিন্তু লাভ হলো না। আমি তুচ্ছ মানুষ। আমার জন্য কার মাথাব্যথা?
রাতে ফিরে এসেছি। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। অনেক বলে ভেতরে ঢুকেছি। রাত আটটার দিকে রক্ষীবাহিনীর দল লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। ইকবাল (ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল) আমাকে আড়াল করে দাঁড়াল। একজন বেয়োনেট উঁচিয়ে লাফিয়ে এলো। রাইফেল তুলে ট্রিগারে হাত দিয়েছে। চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। গুলি করে মেরে ফেলবে আমাদের?
আমি ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বের হয়ে এলাম।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাকে প্রথমবার গৃহহারা করেছিল।
বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী আমাকে দ্বিতীয়বার গৃহহারা করল।’
শহীদ পরিবারের কাজ হলো ঘোরাঘুরি : আয়েশা ফয়েজ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পেনশনের টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম। কাজলের আব্বার পরিচিত একজন এআইজি তার অধস্তন অফিসারকে ডেকে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। অফিসার বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। সব ঠিক করে দেবো।
তার সাথে অফিসে গিয়েছি। সে রাগে ফেটে পড়ল। মুখ খিচিয়ে বলল, আপনার বেশি ক্ষমতা হয়েছে না? ভাবেন ওপরওয়ালা বললেই সব হয়ে যাবে? মনে রাখবেন টাকা অত সহজে পাওয়া যায় না। টাকা যদি চান এখানে এসে খরচপাতি করবেন।
ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে তার এক সহকর্মীকে বললেন, এই একটা নতুন দল বের হয়েছে। শহীদ পরিবার। যেখানেই যাই সেখানেই শহীদ পরিবার। জ্বালিয়ে খাচ্ছে এরা।
এইভাবে শহীদ পরিবার হিসেবে আমার এক নতুন জীবন শুরু হলো। শহীদ পরিবারের প্রথম কাজ হচ্ছে ঘোরাঘুরি করা। আমার ঘোরা ঘুরি শুরু হলো। এক অফিস থেকে আরেক অফিস। এক অফিসার থেকে আরেক অফিসার। এভাবে আস্তে আস্তে ঘোরাঘুরিতে অভিজ্ঞ হয়ে গেলাম।
ঢাকায় থাকার জায়গার খুব সমস্যা। শহীদ পরিবারকে বাড়ি দেয়া হয়েছে শুনে তার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু করেছি। একদিন খোঁজ খবর নিয়ে বাড়িসংক্রান্ত একজন মন্ত্রী, নাম মতিউর রহমান, তার সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার মতো আরো অনেকে আছেন। দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা হলো। আমাদের দেখে একেবারে ক্ষেপে গেলেন মহোদয়। পেয়েছেন কি আপনারা? প্রত্যেক দিন সকালে এসে বসে থাকেন? সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর কত বিধবার মুখ দেখব?
আমি লজ্জায় মরে গেলাম।’
অবশেষে এভাবে ঘেরাঘুরি করতে করতে অশেষ লজ্জা অপমান হজম করে আয়েশা ফয়েজ শহীদ পরিবার হিসেবে একটি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তার স্বামীর বন্ধু কাজী জাহেদুল ইসলাম বাড়িটি তাকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এক অবাঙালির পরিত্যক্ত বাসা। ১৯/৭ বাবর রোড।
এই বাড়ি থেকেই তিন দিনের মাথায় তাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার মনোয়ার হোসেন নামে এক প্রতিবেশী তাদের আশ্রয় দেন।
মনীষী আহমদ ছফা গণকণ্ঠ পত্রিকায় পরের দিন শহীদ পরিবারের ওপর এ নির্যাতনের একটি খবর ছাপার ব্যবস্থা করেন। পরে রক্ষীবাহিনী প্রধান নুরুজ্জামান ওপরের তলা দিলেন আয়েশা ফয়েজকে এবং নিচের তলা দিলেন রক্ষীবাহিনীর মেজর সুবেদার হাফিজকে।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ রাত ১:৫৩