নানা ধরনের ধর্ষন ও তার প্রতিকার প্রতিবাদ সম্পর্কিত স্ট্যাটাস দেখি ব্লগে ও ফেসবুকে। ব্যাপারটা গুরুতর, গতকাল যেখানে ঈভটিজিং ইস্যু ছিল, সেখানে আজকে মেয়েদেরকে রীতিমত ধর্ষন করা হচ্ছে। কারো কারো উষ্মা হতে মনে হয়, দেশে রীতিমত রেগুলারলি ধর্ষন হচ্ছে মেয়েরা। সমস্যা কোথায়? ধর্ষন যারা করছে, তারা তো একটা মেয়ের গর্ভেই জন্ম নিয়েছে, এরপরেও এদের এই মানসিক বিকৃতি আসে কোথা থেকে?
দেশে পুরুষের সংখ্যা মনে হয় মেয়েদের থেকে একটু কম। এরপরেও বাঙালী পরিবারে ছেলের মূল্য কমেনি। একটা ছেলে পাবার জন্য শত শত মেয়ে শিশুর ভ্রুন নষ্ট হয় পাশের দেশ ভারতে, আমাদের কালচার কি তাদের চেয়ে কম? হরহামেশাই মেয়েদের কাছ থেকে অভিযোগ আসে, তাদের পরিবার, সমাজ, বিয়ে, সবক্ষেত্রেই একটা মেয়ের মূল্য একটা ছেলের চেয়ে কম। সমাজের অর্ধেক যখন নারী, আর তাদেরকে যখন এরকম অবমূল্যায়ন করা হয় জন্মের আগে থেকেই, তখন বাংলাদেশে জন্ম নেয়া একটা মেয়ের কাছে নিজের মর্যাদাটা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? যে মেয়েটি নিজের পরিবারে তার আপন ভাইয়ের তুলনায় কম খায়, কম পায়, কম নেয়, সেই মেয়েটি কিভাবে পারবে সমাজে নিজের সঠিক মূল্যায়নের দাবী করতে?
নেক্সট আসি বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে। দেশে ইকনমিকাল সেন্স এর দিক থেকে মেয়েদের চাকরীর বাজার খুবই কম। গার্মেন্টস এর মত গুটি কয়েক সেক্টর ছাড়া বাকি সবগুলোতেই ছেলেদের অগ্রাধিকার। কিন্তু একটা ছেলে সাবলম্বী হয়ে বিয়ের উপযুক্ত হতে হতেই তার মূল্যবৃদ্ধি পায়। একটা মেয়ের সেটা হয় না। আমার আশেপাশেই প্রচুর উচ্চশিক্ষিত অবিবাহিতা মেয়েকে চিনি, এদের অনেকের বিয়ে হয়নি, হচ্ছেনা, নানা কারণে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ, তাদের জন্ম বাংলাদেশে। একটা মেয়ের বিয়ে না হলে সেই মেয়ের জীবন ধারন করার মত প্রয়োজনীয় সাহায্য দেবার মত ক্ষমতা আমাদের দেশের সমাজের নেই। এমএ বিএ পাশ করেও কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীর জন্য কোন রকম বিচার নেই, উচ্চশিক্ষিতা ডাক্তার হয়েও ধষন ও খুন এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন হাতিয়ার নেই বাংলাদেশের নারীর।
পুরুষদের ক্ষেত্রে পুরোই উল্টা, ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, দু সন্তানের জনক হয়েও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কণ্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাদের কাছে আমি একজন কাঙ্খিত পুরুষ। আশি নব্বই বছর বয়স হলেও আমার জন্য বাংলাদেশে কণ্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার অভাব হবে না, যতদিন পর্ষন্ত আমার কাছে ভরনপোষন দেবার ক্ষমতা আছে। এটা নির্মম বাস্তবতা। এটা থেকে পরিত্রান পাবার উপায় আমার জানা নেই।
যেখানে পশ্চিমা ও অন্যান্য ধনী দেশগুলোতে ১৬-১৮ বছরের মধ্যে একটা ছেলে বা মেয়ে সাবলম্বী হতে পারে, সে রকম কোন ব্যবস্থাই আমরা বাংলাদেশে রাখিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থাতো আরো খারাপ, একটা ছেলের জন্য হা পিত্যেশ করা মা-বাবারা সেই ছেলেকে দুধেভাতে বড় করার জন্য জীবনপন করেন, কিন্তু তাকে প্রাপ্তবয়স্ক করার জন্য যেসব শিক্ষা দিতে হবে সেগুলো দেন না। মধ্যবিত্ত বাঙালী পুরুষ তিরিশ পার হলেও মা এর হাতের রান্না খায়, জননী তার কাপড় ধুয়ে দেয়, এমনকি তার জন্য স্ত্রী খোজার দায়িত্বও পরে বাপমা এর উপরে। আমেরিকা কানাডায় যেখানে ত্রিশ বছর বয়সে বিল গেটস বা স্টিভ জবস তিনচারটা গার্লফ্রেন্ডের কাছে ছ্যাকা খেয়ে শেষমেষ থিতু হয়ে নিজের মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা খুলছে, সেখানে বাঙালাদেশের খোকাবাবু পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলনে শরিক হয়ে বিসিএস দিয়ে বড় যৌতুক নিয়ে বিয়ে করার দিবাস্বপ্ন দেখছে। চৌদ্দ বছর বয়সে যে ছেলের বয়সন্ধি হয়েছে, মায়ের আদর যত্ন আর বাপের টাকায় কেনা কম্পিউটারে পর্ণ দেখে দেখে সে যৌনতা সম্পর্কে একটা উদভট ধারণা নিয়ে বড় হয়েছে। সেই ছেলে ত্রিশ এর পরে সাবলম্বী হয়ে বিয়ে করবে, সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করা কি আসলেই মানসিক ভাবে সম্ভব? না সম্ভব না, এজন্যই দেশে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের হার বাড়ছে, মানসিকভাবে অপরিপক্ক এসব পুরুষদের মধ্যে ধর্ষকামীর সংখ্যাও বাড়ছে।
ধর্ষন বোরখা বা ওড়না দিয়ে কমে না। এটা প্রমানিত সত্য। ধর্ষন কমে শিক্ষা দিলে। ধর্ষন কমে সচেতনতা দিলে। এই শিক্ষা বা সচেতনতা দেশের ইস্কুল বা মাদ্রাসা দেয় না। পরিবারও দেয় না। একটা পু্ত্র জন্ম দেয়ার পরে মা বাবা নিশ্চয়ই চায় না সে বড় হয়ে ধর্ষকামী হয়ে উঠুক, তাই শিক্ষাটা পরিবার থেকেই দিতে হয়। যৌন সচেতনতা, যৌন বিষয়ে শিক্ষা বাংলাদেশের শিশু কিশোররা পাচ্ছে চটিবই আর পর্ণ ওয়েবসাইট থেকে, এই শিক্ষাটা যদি মা বাবা দিতে পারে, শিশ্নওয়ালা পুত্রসন্তানগুলো প্রকৃত পুরুষে রুপান্তরিত হত। প্রত্যেক পুত্রের কাছেই তার মা অত্যাধিক প্রিয়, তাই জননীরা দয়া করে আপনার পুত্র সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিন, শিশ্ন নিয়ে জন্মেছে বলেই সে নারী ও তার মনন সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকবে, এই কালচারটার সমাপ্তি টানুন। আপনার পুত্র আগামীতে পিতা হবে, দয়া করে তার যৌন বিষয়ে শিক্ষা চটিবই এর কাছে ছেড়ে দেবেন না। তার ভবিষ্যত জীবনের জন্য তাকে সচেতন করে গড়ে তুলুন। নেপোলিয়ন বলেছেন, শিক্ষিত মা দিলে সে শিক্ষিত জাতি উপহার দেবে। আপনি বাংলাদেশের জননী, শিক্ষিত বাংলাদেশী জাতি গড়ে তুলুন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:০১