সিজদায় দুই বাহু বিছিয়ে দেয়া
মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ
عَنْ أَنَسٍ رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اعْتَدِلُوا فِي السُّجُودِ، وَلَا يَبْسُطْ أَحَدُكُمْ ذِرَاعَيْهِ انْبِسَاطَ الْكَلْبِ .
আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস পাঠ করেছি। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিমসহ অনেক ইমাম তাদের হাদীসের কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে তা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম নামাযের অন্যতম রোকন সিজদার একটি নিয়ম এই হাদীসে উল্লেখ করেছেন।
اعْتَدِلُوا فِي السُّجُودِ، وَلَا يَبْسُطْ أَحَدُكُمْ ذِرَاعَيْهِ انْبِسَاطَ الْكَلْبِ.
“তোমরা ঠিকভাবে সিজদা কর। তোমাদের কেউ যেন সিজদায় তার হাতকে বিছিয়ে না দেয় যেভাবে কুকুর হাত বিছিয়ে দেয়।” -সহীহ বুখারী, হাদীষ ৮২২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯৩
প্রাণীটি যখন অর্ধশায়িত অবস্থায় থাকে তখন যেভাবে তার সামনের দুই হাত যমীনে বিছানো থাকে, সিজদায় ঐভাবে হাত বিছিয়ে দেওয়া নিষেধ। এ হাদীসে যে শিক্ষা আছে তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই বিখ্যাত হাদীসেরই একটি প্রায়োগিক রূপ যাতে তিনি বলেছেন-
صلوا كما رأيتموني أصلي
“তোমরা ঐভাবে নামায পড়ো যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখ”। ওখানে পুরো নামাযের কথা বলা হয়েছে আর সহীহ বুখারীর এই হাদীসে নামাযের একটি অংশ সিজদা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সহীহ মুসলিমেও এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ওখানে হযরত বারা ইবনে আযিব রা. থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন,
إِذَا سَجَدْتَ فَضَعْ كَفَّيْكَ وَارْفَعْ مِرْفَقَيْكَ
“যখন তুমি সিজদা করবে তখন দুই হাতের পাতা মাটিতে রাখবে। আর দুই কনুই উঁচু রাখবে”। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯৪
সহীহ মুসলিমের এই হাদীস আর সহীহ বুখারীর উপরোক্ত হাদীসের মূলকথা একই। এই দুই হাদীস এবং এ বিষয়ের আরো বিভিন্ন হাদীস থেকে পাওয়া যায় যে, সিজদায় দুই হাতের বাহু পাঁজর থেকে আলাদা থাকবে এবং পেট উরু থেকে আলাদা থাকবে আর দুই হাত (অর্থাৎ কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত অংশ) মাটি থেকে উপরে থাকবে। এভাবেই সিজদা করার নিয়ম বিভিন্ন হাদীসে এসেছে।
এখানে যে হাদীসটি পড়া হল সে সম্পর্কে দু একটি কথা আরয করি। প্রথম কথা এই যে, হাদীসের তরজমা করা হয়েছে “তোমরা ঠিকভাবে সিজদা কর। তোমাদের হাতকে বিছিয়ে দিয়ো না যেভাবে কুকুর তার হাতকে বিছিয়ে দেয়।” এই যে বাংলা তরজমাটা করা হল, এতে আরবীর সব বিষয় তুলে আনতে পারিনি। আরবী পাঠে যা কিছু আছে তার সবকিছু এই তরজমায় আসেনি। আর তা আসেনি আরবী ও বাংলার ভাষাগত পার্থক্যের কারণে। দেখুন বাংলা তরজমা হল, “তোমরা ঠিকভাবে সিজদা কর। এবং তোমাদের হাতকে বিছিয়ে দিয়ো না যেভাবে কুকুর তার হাত বিছিয়ে দেয়”। এখানে বহুবচনের শব্দ (তোমরা, তোমাদের) ব্যবহার করা হয়েছে। এখন যার সামনে শুধু বাংলা তরজমা আছে তিনি তা পাঠ করে বলে বসতে পারেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং সবার জন্যে এ বিধান। নারী-পুরুষ সকলে এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে সম্বোধন করে বলেছেন, “তোমরা তোমাদের হাত মাটিতে বিছিয়ে দিয়ো না।” সুতরাং পুরুষ যেভাবে সিজদা করে নারীও সেভাবে সিজদা করবে।
কিন্তু এখানে একথাটা ঠিক হবে না এবং এ বিধানটা এই তরজমা থেকে বের করা যাবে না। কারণ আগেই বলেছি, আরবীতে যা কিছু আছে বাংলা তরজমায় তার সবটা নেই। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলি। আরবীতে সম্বোধনবাচক যে আদেশ, সেখানে পুরুষের জন্যে শব্দ আলাদা, নারীর জন্যে শব্দ আলাদা। একবচনের ক্রিয়াপদ আলাদা, দ্বিবচনের আলাদা, বহুবচনের আলাদা। অর্থাৎ সেকেন্ড পারসনে আদেশবাচক ক্রিয়াপদ আরবীতে পাঁচটি। কিন্তু বাংলায় ও ইংরেজিতে মাত্র একটি। বাংলাতে ‘কর’ কথাটা একজন পুরুষকেও বলা হবে, একজন নারীকেও বলা হবে। একাধিক পুরুষকেও বলা হবে, ইংরেজি উড় শব্দটাও অনুরূপ একজন পুরুষকেও বলা হবে, একজন নারীকেও বলা হবে, একাধিক পুরুষকেও বলা হবে, একাধিক নারীকেও বলা হবে। কিন্তু আরবীতে একজন পুরুষকে সম্বোধন করলে افعل। একজন নারীকে সম্বোধন করা হলে বলা হবে افعلي। একাধিক পুরুষকে সম্বোধন করলে افعلوا। একাধিক নারীকে সম্বোধন করল افعلن। আর দুইজনকে সম্বোধন করা হলে বলা হবে افعلا। তাহলে এই উদাহরণগুলোতে আরবী ক্রিয়াপদে ‘জেন্ডার’ও আছে, ‘নাম্বার’ও আছে, যা বাংলা বা ইংরেজিতে নেই। সুতরাং افعل শব্দের তরজমাও ‘কর’, افعلي-এর তরজমাও ‘কর’, افعلوا-এর তরজমাও ‘কর’, افعلن-এর তরজমাও ‘কর’। আরবী ক্রিয়াপদে ‘নাম্বার’ ও ‘জেন্ডারের’ যে লক্ষণ সেটা কিন্তু বাংলায় থাকেনি। সুতরাং আরবীতে যখন বলা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে, তখন যে আরবী জানে সে ক্রিয়াপদটি দেখামাত্র বুঝবে যে, এখানে পুরুষকে সম্বোধন করা হয়েছে নাকি নারীকে। কিন্তু এরই তরজমা যখন করছি ‘তোমরা কর’, তো তরজমা করামাত্র জেন্ডার অদৃশ্য হয়ে গেছে। ‘কর’ শব্দে জেন্ডার নেই। পুরুষের ক্ষেত্রেও ‘কর’, নারীর ক্ষেত্রেও ‘কর’, একবচনে ‘কর;, বহুবচনেও ‘কর’ ইংরেজিতে একই অবস্থা। তো যখন আরবী পাঠ আমার সামনে নেই, আরবীর তরজমা আমি করছি বাংলাতে, তখন আরবী ও বাংলার ভাষাগত পার্থক্যের কারণেই কিছু বিষয় তরজমায় আসছে না।
তো اعْتَدِلُوا فِي السُّجُودِ এখানে اعْتَدِلُوا ক্রিয়াপদটি আরবী ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে বহুবচনে পুরুষকে সম্বোধন করার জন্যে। অর্থাৎ হে পুরুষেরা! তোমরা ঠিকঠাকভাবে সিজদা কর। اعْتَدِلُوا শব্দটাতেই জেন্ডার আছে। পুরুষকে সম্বোধন করা হচ্ছে। মহিলাদেরকে সম্বোধন করা হলে বলা হত اعْتَدِلْن । শব্দ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কাকে সম্বোধন করা হচ্ছে, পুরুষকে না মহিলাকে। কিন্তু যেইমাত্র আমি اعْتَدِلُوا এর তরজমা করলাম ‘তোমরা ঠিকভাবে সিজদা কর’ তখন কিন্তু আর জেন্ডার থাকছে না।
একইভাবে
وَلَا يَبْسُطْ أَحَدُكُمْ ذِرَاعَيْهِ انْبِسَاطَ الْكَلْبِ.
এখানে أَحَدُكُمْ -এর তরজমা ‘তোমাদের কেউ’ এখানে জেন্ডার নেই। অথচ আরবীতে أَحَدُكُمْ এর كُمْ শব্দটি পুরুষবাচক। নারীদের জন্যে হলে বলা হত إحداكن। তো আমি যখন أَحَدُكُمْ -এর তরজমা করছি ‘তোমাদের কেউ’ তখন জেন্ডার উহ্য হয়ে গেল। বাংলায় পুরুষের ক্ষেত্রেও ‘তোমাদের কেউ’, নারীর ক্ষেত্রেও ‘তোমাদের কেউ’। তো হাদীসের বাংলা তরজমায় বাংলাভাষার বৈশিষ্ট্যের কারণেই ক্রিয়াপদ থেকে জেন্ডারের লক্ষণ চলে যাচ্ছে। এখন অতিউৎসাহী যে কেউ এখান থেকে বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন এবং এই ব্যাখ্যা করে বসতে পারেন যে, এখানে তো নারী-পুরুষ সবাইকে বলা হচ্ছে! আল্লাহর রাসূল ব্যাপক শব্দে সবাইকে বলেছেন! আসলে সবাইকে বলেননি। আরবী পাঠে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু পুরুষকে সম্বোধন করে এ কথাটা বলেছেন। এই হল আরবী পাঠ এবং অন্য ভাষার তরজমায় পার্থক্যের একটি ছোট্ট উদাহরণ। এই জন্যে আলিমগণ বলে থাকেন, যারা আরবী বোঝেন না তারা নির্ভরযোগ্য তরজমার সাহায্যে কুরআন সুন্নাহ পড়তে পারেন। কিন্তু তরজমা থেকে বিধান আহরণ করতে যাওয়া অন্যায় হবে। কারণ শুধু তরজমা থেকে বিধান-প্রণয়ন করতে গেলে অনেক সময় ভুল হয়ে যাবে। আর এই ভুল সবক্ষেত্রে এই জন্যে হবে না যে, আপনি একজন অসৎ লোক। নাউযুবিল্লাহ। এই ভুলটা কখনো হবে ভাষাগত কারণে, কখনো হবে শাস্ত্রীয় জ্ঞান না থাকার কারণে। এটা হল প্রথম কথা।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরীয়তের নুসূসের মধ্যে সম্বোধন করা হয়েছে পুরুষকে তবে বিধানটি নারীদেরকেও শামিল করে। তবে এটা হল দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়। অন্য দলীলের আলোকে বিবেচনা করতে হবে যে, এই বিধানটা শুধুই পুরুষের জন্যে, না এই বিধানে নারীও শামিল। আমরা সহীহ বুখারীর যে হাদীসটি পাঠ করেছি, এখানে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদার যে নিয়ম শিখিয়েছেন আমরা প্রথমত দেখছি এখানে পুরুষকে সম্বোধন করা হয়েছে, এরপর যদি আরো বিস্তৃতভাবে হাদীস অধ্যয়ন করি তাহলে দেখতে পাই, স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর সিজদার আলাদা নিয়ম ইরশাদ করেছেন। এরপর উম্মাহর মনীষীগণ এই পার্থক্য বর্ণনা করে এসেছেন।
এই বিষয়টা এজন্য আলোচনা করছি যে, এগুলো তো আগে থেকেই আছে। আমাদের নারীগণ তো ঐভাবেই নামায পড়ে আসছেন যেভাবে আলিমগণ শিখিয়েছেন। তাদের নামাযের কিছু কিছু নিয়ম আলাদা। সিজদার ক্ষেত্রে, বসার ক্ষেত্রে কিছু কিছু ভিন্নতা আমাদের আলিমগণ শিখিয়েছেন। সেই নিয়মেই আমাদের নারীগণ নামায পড়ে আসছিলেন। ইদানিং শুনতে পাওয়া যাচ্ছে যে, এতদিন যে নিয়মে নামায পড়া হচ্ছিল সেটা ভুল। নারীর নামায পুরুষের মতই। নারীর নামাযের নিয়ম আলাদা হওয়ার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য দলীল/হাদীস নেই। এমন কিছু কথা আমাদের কিছু কিছু বন্ধু বলছেন। যার কারণে একটু বিশৃঙ্খলাও হচ্ছে, অস্থিরতাও হচ্ছে। এইজন্যে বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে দেওয়া প্রয়োজন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের আছার এবং মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত সকল বিষয়ে এ কথাটা আছে যে, নারীর নামাযের কিছু বিষয় পুরুষের নামাযের চেয়ে আলাদা। কিছু হাদীস উল্লেখ করছি।
ইমাম আবু দাউদ রাহ. তাঁর কিতাবুস সুনানের কিতাবুল মারাসীলে বিখ্যাত ইমাম ইয়াযিদ ইবনে আবী হাবীব রাহ.-এর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেন যে,
أن النبى مر على امرأتين تصليان فقال : اذا سجدتما فضما بعض اللحم الى الأرض، فان المرأة ليست فى ذلك كالرجل.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইজন মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারা নামায পড়ছিল। তিনি তাদের বললেন, “যখন তোমরা সিজদা করবে তোমাদের শরীরের কিছু অংশ, (মানে পিছনের অংশ) মাটির সাথে মিলিয়ে রাখবে। কারণ নারী এই বিষয়ে পুরুষের মত নয়। ” -মারাসীলে আবু দাউদ, হাদীস ৮৭; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৩২০১; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, বায়হাকী, হাদীস ৪০৫৪
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষকেও সিজদার নিয়ম শিখিয়েছেন, নারীকেও সিজদার নিয়ম শিখিয়েছেন। পুরুষকে সম্বোধন করে বলেছেন, সবগুলো অঙ্গ যেন ফাঁকা ফাঁকা থাকে। দুই বাহু যেন পাঁজরের সাথে মিলে না থাকে। কনুই যেন মাটিতে বিছানো না থাকে। পেট যেন উরুর সাথে মিশে না থাকে। এভাবে পুরুষকে সিজদা শিখিয়েছেন। আর নারীকে বলেছেন
فان المرأة ليست فى ذلك كالرجل ‘নারী এই বিষয়ে পুরুষের মত নয়’।
ইমাম আবু দাউদ রাহ. হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। হাদীস-বিচারের নীতি অনুসারে এটি দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। শুধু দুইটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। বিখ্যাত লা-মাযহাবী মুহাদ্দিস -দেখুন, হানাফী মুহাদ্দিস না!- নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান রাহ. সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থ ‘আওনুল বারী’তে লিখেছেন, এই হাদীস সকল ইমামের উসুল মোতাবেক দলীল হওয়ার উপযুক্ত। অর্থাৎ এটা নির্ভরযোগ্য দলীল। আরেকজন গায়রে মুকাল্লিদ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল আমীর আল ইয়ামানী بلوغ المرام -এর ভাষ্যগ্রন্থ سبل السلام-এ হযরত বারা ইবনে আযিব রা.-এর হাদীস, যে হাদীস সহীহ মুসলিমে আছে, ‘যখন তুমি সিজদা করবে তখন তোমার দুই হাতের পাতা মাটিতে রাখ আর দুই কনুই মাটি থেকে উপরে রাখ’। এই হাদীস আলোচনা করার সময় বলেছেন, ‘এই হাদীসে আছে পুরুষের নামাযের হুকুম। নারীর নামাযের পদ্ধতি আলাদা, যা আবু দাউদের এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে’। তো তার মতেও ইমাম আবু দাউদ রাহ.-এর বর্ণিত হাদীসটি গ্রহণযোগ্য এবং দলীল হিসাবে উপযুক্ত। এ জন্য তিনি এই হাদীসের ভিত্তিতে পুরুষ ও নারীর নামাযের পার্থক্য বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয় হাদীস : ইমাম বায়হাকী রাহ. তাঁর ‘আসসুনানুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا جلست المرأة في الصلاة وضعت فخذها على فخذها الأخرى وإذا سجدت ألصقت بطنها في فخذيها كأستر ما يكون لها وإن الله تعالى ينظر إليها ويقول يا ملائكتي أشهدكم أني قد غفرت لها.
“নারী যখন নামাযে বসবে তখন তার এক উরু অন্য উরুর উপর রাখবে। আর যখন সিজদা করবে তখন তার পেটকে উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে। আল্লাহ পাক ঐ নারীর দিকে তাকান এবং বলেন, হে ফিরিশতাগণ! আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি যে, আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি”। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৩১৯৯
এই হাদীসেরও সনদ হাসান পর্যায়ের, নির্ভরযোগ্য পর্যায়ের।
তৃতীয় হাদীস : ইমাম তবারানী রাহ. ‘আলমুজামুল কাবীর’ গ্রন্থে হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন,
يا وائل بن حجر ! إذا صليت؛ فاجعل يديك حذاء أذنيك، والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها.
“হে ওয়ায়েল! যখন তুমি নামায পড়বে তখন তোমার দুই হাত কান বরাবর উঠাবে। আর নারী তার হাত উঠাবে বুক পর্যন্ত।” -মুজামে কাবীর, তবারানী, হাদীস ২৮
তো এই হাদীসে নামাযে হাত তোলার ক্ষেত্রে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। এটিও হাসান পর্যায়ের হাদীস।
এ সমস্ত হাদীস এবং এ বিষয়ের আরো কিছু রেওয়ায়েত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসগুলোর ভিত্তিতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর নামাযের কিছু পার্থক্য নিদের্শ করেছেন।
এরপর রয়েছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান
عليكم بسنتي و سنة الخلفاء الراشدين “তোমরা আমার সুন্নাহকে ধারণ কর এবং খোলফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহকে ধারণ কর”। আলোচ্য বিষয়ে খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর আছর সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ‘মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক’, ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ’ হাদীসের দুই বিখ্যাত ও মূল্যবান কিতাব। ইমাম আব্দুর রাযযাক, ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ হলেন ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তায। এই দুই কিতাবে আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, سئل عن صلاة المرأة নারীর নামায সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন,
إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها
“নারী যখন সিজদা করবে তখন যেন সে জড়সড় হয়ে সিজদা করে এবং তার দুই উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।” -মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক ৫০৭২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, ২৭৭৭
আর এ শুধু সিজদার ক্ষেত্রে বিধান নয়, গোটা নামাযের বিধান। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় আছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে নারীর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি দুটো শব্দ বললেন, تجتمع و تحتفز “নারী এক অঙ্গকে আরেক অঙ্গের সাথে মিলিয়ে জড়সড় হয়ে নামায পড়বে।”
তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা এবং বিখ্যাত মুজতাহিদ সাহাবীগণের নির্দেশনা এবং এরপর যদি আরো দেখত চান, তাহলে তাবেঈ যুগের বিখ্যাত সব ইমাম, আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ., মুজাহিদ ইবনে জাবর রাহ., ইবরাহীম আন নাখায়ী রাহ., এরকম বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুজতাহিদ ইমামের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এই সবগুলো দলীল হাওয়ালাসহ দেখতে চাইলে উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের মূল্যবান প্রবন্ধটি দেখতে পারেন, যা মাসিক আলকাউসারে (রবিউস সানী-জুমাদাল উলা ১৪২৬; জুন ২০০৫ সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর মাকতাবাতুল আশরাফ কর্তৃক প্রকাশিত ‘নবীজীর নামাজ’ বইখানির পরিশিষ্ট অংশে ছাপা হয়েছে।
এই যে নিয়ম, নারীর নামাযের কিছু বিষয় পুরুষের নামাযের নিয়মের চেয়ে আলাদা, যে নিয়মে আমাদের নারীগণ নামায পড়ে আসছিলেন, এ নিয়মটি শুধু ‘প্রচলিত’ একটা ব্যাপার নয়, বরং তা আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম, যা মুসলিম জাহানে যুগ যুগ ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে।
কিন্তু পরবর্তীতে কিছু মানুষ তাদের কিছু নীতি ও ব্যাকরণের ভুলের কারণে- আমি পরিষ্কার ভাষায় বলব, ভুলের কারণে- কিছু বিচ্ছিন্ন মত বা বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যে সিদ্ধান্তের সাথে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে নিয়ে খায়রুল কুরুনের, সাহাবা তাবেঈনের যুগের এবং গোটা বিশ্বের মনীষীদের সিদ্ধান্তের কোনো মিল নেই। মানুষের ভুল হতেই পারে। কোনো গবেষকের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত ভুল হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু দুঃখের ও দোষের বিষয় হচ্ছে, ভুলকে ভুল হিসাবে জানার পরও এর উপরে অবিচল থাকা।
আমাদের কোনো কোনো বন্ধু আমাদের দোষারোপ করেন যে, আমরা মাযহাব অনুসরণ করি। আর তাদের ‘মতে’ মাযহাব মানার অর্থ, হাদীস ও সুন্নাহ বর্জন করে ব্যক্তির মত অনুসরণ। (নাউযুবিল্লাহ!) এই যে, আজ যে বিষয়টি আলোচনা করা হল এই বিষয়ে আমাদের নারীগণ কি ব্যক্তির মত অনুরসণ করছিলেন, না আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অনুসরণ করছিলেন? তারা তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অনুসরণ করছিলেন। এখন কেউ যদি ভুলক্রমে কিছু বিচ্ছিন্ন মত গ্রহণ করে এবং সঠিক তথ্য-প্রমাণ সামনে আসার পরও ঐ ভুল নিয়মের উপরই থাকে তাহলে আসলে কি সে সুন্নাহর অনুসারী হবে, না ব্যক্তির মতের অনুসারী হবে?
তাহলে তো অভিযোগকারীরাই অভিযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। তারা সাধারণ মানুষকে, গোটা মুসলিম জাহানের বড় অংশকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করছেন যে, তারা সুন্নাহ মানেন না, ব্যক্তির মত মানেন! অথচ বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারাই আসলে সুন্নাহ ত্যাগ করে ব্যক্তির মত অনুসরণ করছেন! এবং এমন মত, যার পক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল নেই!!
খুব সংক্ষেপে দু একটি কথা নিবেদন করলাম, আশা করি এখান থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে হাদীস আমি শুরুতে পাঠ করেছি-
اعْتَدِلُوا فِي السُّجُودِ، وَلَا يَبْسُطْ أَحَدُكُمْ ذِرَاعَيْهِ انْبِسَاطَ الْكَلْبِ.
“তোমরা ঠিকভাবে সিজদা করো। তোমাদের কেউ যেন সিজদায় তার হাতকে বিছিয়ে না দেয় যেভাবে কুকুর বিছিয়ে দেয়।” এই হাদীস পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই হাদীসে পুরুষের সিজদার নিয়ম শেখানো হয়েছে। আর যে সকল হাদীসে নারীর সিজদার নিয়ম এসেছে সেগুলোও আমি আপনাদের সামনে উল্লেখ করেছি। সুতরাং পুরুষের সিজদার নিয়ম এবং নারীর সিজদার নিয়ম সম্পূর্ণ আলাদা। এই বিষয়টি পরিষ্কার থাকত যদি আমাদের সামনে আরবী পাঠ থাকত। কিন্তু আমাদের অনেকের সামনে আরবী পাঠ নেই, শুধু তরজমা আছে। এটা আসলে না বুঝার এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে ভুলটা ধরতে না পারার অনেক বড় কারণ।
এবার একটি ছোট্ট প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমার আলোচনা শেষ করছি। এই আলোচনার পর আমাদের কোনো কোনো মা-বোনের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন আসতে পারে যে, আমরা যারা কিছুকাল যাবৎ পুরুষের মত নামায পড়েছি, পুরুষের মত সিজদা করেছি, আমরা শুনেছিলাম এটা সুন্নাহ, এজন্যই আগের নিয়ম ত্যাগ করে কিছুদিন যাবৎ পুরুষের মত নামায পড়েছি, আমাদের নামায কি হয়নি?
এর উত্তরে বলব- আপনার নামায হয়নি, তা নয়। আপনার নামায হয়েছে। কারণ এটি এমন কোনো বিষয় নয়, যার কারণে নামায নষ্ট হয়ে যায়। তবে অবশ্য নিয়ম-পরিপন্থী হয়েছে। সুতরাং সামনে থেকে আপনার কর্তব্য, যদি আপনি আসলেই সুন্নাহর অনুসারী হয়ে থাকেন, সুন্নাহয় নারীদের নামাযের যে পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সে নিয়মে নামায পড়া।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বোঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(ধারণ ও লিখনে : মুহাম্মাদ আনাস বিন সা‘দ)