প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তাআলা ও রসূলুল্লাহ স.-এর কথা পরস্পরবিরোধী হতে পারে না। কেননা, এটা মূর্খতার আলামত। তবে উম্মাতের সুবিধার্থে বা ভিন্ন কোন কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হুকুমের রদবদল হয়েছে যা প্রকাশের তারিখ না জানার কারণে কোন্টি আগের আর কোন্টি পরের তা নির্ণয় করা অনেক ক্ষেত্রে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথবা কোন্ ক্ষেত্রের জন্য কোন্ হুকুম প্রজোয্য তা স্পষ্টভাবে বুঝতে না পারার কারণে অনেক সময় কুরআন-হাদীসে বর্ণিত বিধি-বিধান একটি আরেকটির বিপরীত বলে মনে হয়। এ জাতীয় কোন সমস্যা দেখা দিলে গবেষক ইমামগণ আপন আপন যোগ্যতা অনুসারে তা নিরসনের চেষ্টা করে থাকেন। কখনও সমন্বয় সাধন করেন আবার কখনও বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে কোন একটিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
এ ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কিরাম প্রথমে লক্ষ্য করেন: উলামায়ে উম্মাত এটাকে ব্যাপকভাবে আমলে গ্রহণ করেছেন কি না। পূর্ববর্তী কোন এক বা একাধিক গবেষক এটা দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন কি না। সেটা কোন ফকীহ বা প্রসিদ্ধ সাহাবার বর্ণনা কি না। অথবা হাফেজে হাদীস বা আইম্মায়ে হাদীসের মাধ্যমে বর্ণিত কি না। এরপরে লক্ষ্য করেন: হাদীসটি أصح الأسانيد অর্থাৎ, সর্বোৎকৃষ্ট সনদ বা তার কাছাকাছি কোন সনদে বর্ণিত কি না। কিংবা বিবাদমান হাদীসগুলোর মধ্যে কোন একটির আমল গ্রহণ করলে তা কুরআনের আয়াত বা অন্যান্য হাদীসের সমন্বয়ক হয় কি না। এর বিপরীতে বুখারী-মুসলিম বা নির্ভরযোগ্য অন্য কিতাবে কোন হাদীস বর্ণিত হলে সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে এমনটা অনেক মুহাদ্দিস এবং গবেষক মনে করেন না। আর যে ইমামগণ বুখারী-মুসলিমের হাদীসকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তাঁরাও এটাকে প্রাধান্য দানের সর্বশেষ কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন।
আল্লামা আবু বকর হাঝেমী রহ. তাঁর ‘আলই’তিবার’ নামক কিতাবে বিবাদমান দুই হাদীসের মধ্যে প্রাধান্য দেয়ার পঞ্চাশটি কারণ উল্লেখ করেছেন; যার মধ্যে বুখারী-মুসলিমের হাদীস হওয়ায় প্রাধান্য দেয়ার এমন কোন কারণ বর্ণনা করেননি। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. তাঁর কিতাব ‘তাদরীবুর রাবী’তে প্রাধান্য দেয়ার একশত আটটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এ কারণগুলোকে তিনি মৌলিকভাবে সাতটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। তন্মধ্যে সপ্তম ভাগের শিরোনাম দিয়েছেন الْقِسْمُ السَّابِعُ: التَّرْجِيحُ بِأَمْرٍ خَارِجِيٍّ “সপ্তম প্রকার : মৌলিক বিষয়বহির্ভূত কোন বিষয়ের দ্বারা প্রাধান্য দেয়া”। এ শিরোনামের অধীনে তিনি এগারোটি কারণ বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে সর্বশেষ নম্বরে গিয়ে বলেন: ، اتَّفَقَ عَلَى إِخْرَاجِهِ الشَّيْخَانِ অর্থাৎ, বুখারী-মুসলিম একযোগে যে হাদীস বর্ণনার করেছেন। (তাদরীবুর রাবী: হাদীসের প্রকার নম্বর- ৩৬)
আল্লামা সুয়ূতী রহ.-এর বর্ণনা থেকে দুটি বিষয় বুঝে আসে। এক. বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হওয়ার কারণে কোন হাদীসকে প্রাধান্য দেয়া হাদীসের মৌলিক কোন গুণ নয়। দুই. বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হওয়ার কারণে কোন হাদীসকে প্রাধান্য দেয়াটা প্রাধান্য দানের সর্বশেষ কারণ যা দ্বারা সধারণতঃ কোন বিবাদমান হাদীসের মাঝে প্রাধান্য দেয়া হয় না।
উপরন্তু, এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, সার্বিক বিবেচনায় কোন একটি কিতাব প্রাধান্য পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, এ কিতাবের প্রত্যেকটি হাদীস অন্য যে কোন কিতাবের সব হাদীসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হাদীসের দৃঢ়তা প্রমাণের ক্ষেত্রে এ শর্ত জুড়ে দিয়েছেন যে, উক্ত হাদীসের ওপর হাদীস নিরীক্ষক ইমামগণের কোন আপত্তি না থাকতে হবে এবং বর্ণিত হাদীসের বক্তব্যের সাথে উক্ত কিতাবে বর্ণিত অন্য কোন হাদীসের অনিরসনযোগ্য দ্বন্দ্বও না থাকতে হবে। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, বুখারী-মুসলিমের কোন হাদীসের ওপর যদি হাদীস নিরীক্ষক ইমামগণের কোন আপত্তি থাকে অথবা হাদীসের বিষয়বস্তুর মাঝে অনিরসনযোগ্য দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে সে হাদীসগুলো বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্খিত শ্রেষ্ঠত্বের মান পাবে না। অতএব, বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত যে কোন হাদীস অন্যান্য কিতাবের যে কোন হাদীসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিষয়টি এমন নয়।
বুখারী-মুসলিমের সব হাদীস সহীহ বলে উম্মাতের স্বীকৃতি বিদ্যমান রয়েছে। এতদসত্ত্বেও হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ.-এর অনুসন্ধানে নিরীক্ষক ইমামগণের আপত্তি রয়েছে এমন হাদীসের সংখ্যা বুখারী-মুসলিমে ২১০টি। তন্মধ্যে ‘মুত্তাফাক আলাইহি’ অর্থাৎ, উভয় কিতাবে যৌথভাবে বর্ণিত হয়েছে ৩২টি, শুধু বুখারীতে ৭৮টি এবং শুধু মুসলিম শরীফে ১১০টি। (হাদীউস সারী: ৮ম অধ্যায়) আর শায়খ আবু সুফিয়ান মুস্তাফা বাহু লিখিত الأحاديث المنتقدة فى الصحيحين কিতাবের বিবরণ মোতাবেক বুখারী-মুসলিমে এরকম হাদীসের সংখ্যা ৩৯৫টি। যার মধ্যে ‘মুত্তাফাক আলাইহি’ ৫২টি, শুধু বুখারীতে ১০৪টি এবং শুধু মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে ২৩৯টি। এ ছাড়া উভয় কিতাবে স্বতন্ত্রভাবে বিতর্কিত রাবীর সংখ্যা বুখারীতে ৮০জন এবং মুসলিমে ১৬০জন। তাহলে নিরীক্ষক ইমামগণের আপত্তি রয়েছে বা বিতর্কিত রাবীগণের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে বুখারী-মুসলিমের এমন হাদীসের বিপরীতে যদি অন্য কিতাবে নির্ভরযোগ্য রাবীগণের মাধ্যমে কোন হাদীস বর্ণিত হয় তাহলে সেগুলোর মান বুখারী-মুসলিমের হাদীসের তুলনায় কোনক্রমে কম নয়; বরং অনেক বেশী।
উদাহরণ হিসেবে ধরে নেয়া যাক, বুখারীতে চার হাজার হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে দু’হাজার হাদীস উঁচু স্তরের সহীহ। এক হাজার মধ্যম স্তরের সহীহ। অবশিষ্ট এক হাজার সাধারণ স্তরের সহীহ। আর তিরমিজীতেও চার হাজার হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে এক হাজার হাদীস উঁচু স্তরের সহীহ। এক হাজার মধ্যম স্তরের সহীহ। এক হাজার সাধারণ স্তরের সহীহ। আর অবশিষ্ট এক হাজার হাদীস জঈফ। সার্বিক বিবেচনায় বুখারীর মান অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু তিরমিজী শরীফের উঁচু স্তরের সহীহ এক হাজার হাদীসকে যদি বুখারীর নিম্নস্তরের এক হাজার হাদীসের বিপরীতে রাখা হয় তাহলে অবশ্যই তিরমিজীর হাদীসগুলো বুখারীর ওই হাদীসগুলোর চেয়ে প্রাধান্য পাবে। যদিও সার্বিক বিবেচনায় বুখারীর মান ঊর্ধ্বে। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় বুখারীর মান ঊর্ধ্বে হওয়ার দোহাই দিয়ে বুখারীর যে কোন হাদীসকে অন্যান্য কিতাবের সব হাদীসের ওপর প্রাধান্য দেয়া বাস্তবও নয়, যৌক্তিকও নয়।
এর চেয়েও বেশী বাস্তব এই যে, চার ইমামসহ হাদীস নিরীক্ষক ও নীতিনির্ধারক ইমামগণ যথা- ইবরাহীম নাখঈ, (মৃত্যু- ৯৬) মুহাম্মাদ বিন মুসলিম যুহরী, (মৃত্যু- ১২৫), আবু আব্দুর রহমান আওযাঈ (মৃত্যু- ১৫৭), শু’বা বিন হাজ্জাজ (মৃত্যু- ১৬০) সুফিয়ান সাওরী (মৃত্যু- ১৬১), আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (মৃত্যু- ১৮১), ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল কত্তান (মৃত্যু- ১৯৮), আব্দুর রহমান বিন মাহদী (মৃত্যু- ১৯৮), ইয়াহইয়া বিন মাঈন (মৃত্যু- ২৩৩), আলী বিন মাদীনী (মৃত্যু- ২৩৪) ও ইসহাক বিন ইবরাহীম রাহওয়াইহ (মৃত্যু- ২৩৮) সহ অধিকাংশ ইমামগণই ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিমের পূর্বে গত হয়ে গেছেন। সঙ্গত কারণেই হাদীস থেকে জীবন চলার বিধি-বিধান বের করা, সহীহ-জঈফ নির্ণয় করা, বিবাদমান হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন বা প্রাধান্য দেয়াসহ প্রায় সবকিছুই সম্পন্ন হয়ে গেছে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের জন্মেরও পূর্বে। আর বুখারী-মুসলিমের সম্মানিত ইমামদ্বয় তাঁদের পূর্বের ইমামদের বাছাইকৃত রাবীদের থেকে সহীহ হাদীসগুলো গ্রহণ করেছেন মাত্র। হ্যাঁ, কোন কোন ক্ষেত্রে সহীহ-জঈফ নির্ণয়, হাদীস থেকে মাসআলা বের করা এবং বিবদমান হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন বা প্রাধান্য দেয়াসহ প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে তাঁরাও গবেষণা করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁদের গবেষণাও অনেক মূল্যবান। কিন্তু আল্লামা সুয়ূতী এবং আবু বকর হাযেমীসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারক ইমামগণের ভাষ্য মোতাবেক বিবাদমান হাদীসের মাঝে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি বুখারী-মুসলিমের বর্ণনার ওপর তেমন নির্ভরশীল নয়। অন্যথায় প্রশ্ন আসে যে, ইমাম বুখারী ও মুসলিমের জন্মের পূর্বে সোয়া দুইশত বছরেরও বেশী সময় যাবত মুসলিম উম্মাহ কিসের ভিত্তিতে আমল করেছেন? সুতরাং যে কোন মাসআলার ক্ষেত্রে নিঃশর্তভাবে বুখারী-মুসলিমের হাদীসকে প্রাধান্য দেয়ার নীতি মুহাদ্দিসীনে কিরামের নিকটে স্বীকৃত নয়; বরং এটা বিরোধপূর্ণ হাদীসের মাঝে প্রাধান্য দেয়ার এমন একটি ভুল পদ্ধতি যা উসূলে হাদীসে অজ্ঞ বা অপরিপক্ক ব্যক্তিদের আবিষ্কৃত।
মুফতি গোলামুর রহমান সাহেবের সালাতুন নবী কিতাব থেকে