মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে।
সেকি অন্য তত্ত্ব মানে।।
মাটির ঢিবি কাঠের ছবি
ভূত ভাবি সব দেবাদেবী
ভোলে না সে অন্যরূপী
মানুষ ভজে দিব্যজ্ঞানে
নরই সরই নূলা ঝলা
পেঁচ পেচী আলাভো
তাতে নয় সে ভোলনেওয়্লা
যেজন মানুষ রতন চেনে
ফেয়ো ফেপী ফ্যাকসা যারা
ভাকা ভোকায় ভোলে তারা লালন তেমনি চটা মারা
ঠিক দাঁড়ায় না একখানে
-- লালন
মহাত্মা লালনের বিরাজময়তা কুষ্টিয়া অঞ্চলের সকল মানব মনে।ভাব ও মানব আচরনের সর্বত্র মহাত্মার এই বিচরন বুঝেও গ্রহণের মধ্যদিয়ে ধরা যায় । যা সহজীয়া জীবনাচরণের হ্নদয়ে শীতল হওয়া প্রবাহের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যায়।এ অঞ্চলের মানুষের যাত্রা ও গন্তব্যে যদি কোন ঠিকানা খোঁজ হয় তাহলে আগে আসে মহাত্ম লালন।মহাত্মার এ বলয় কি করে তৈরি হলো সে বিচর করার আগে মহাত্মার দেহত্যাগ করার দুই সপ্তাহ পর কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকা লেখা ধারন করা যাক।
‘‘লালন ফকীরের নাম এ অঞ্চলে কাহার ও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন,পূর্ব্বে চট্টগ্রাম ,উত্তরে রঙ্গপুর,দেণ যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্য্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই ফকীরের শিষ্য ;শুনিতে পাই ইঁহার শিষ্য দশ হাজারের উপরে ।ইঁহাকে আমরা স্বচে দেখিয়াছি;আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি।কুষ্টিয়ার আনতিদূরে কালীগঙ্গার ধারে সেওরিয়া গ্রামে ইঁহার একটি সুন্দর আখড়া আছে।...লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না;অথচ সকল ধর্মের লোকেই তাহার আপন বলিয়া জানিত।
কুষ্টিয়ার অধিন চাপড়া ভৌমিক বংশীয়েরা ইঁহার জাতি ।ইঁহার কোন আত্মীয় জীবিত নাই।ইনি নাকি তীর্থগমন কালে পথে বসন্তরোগে আক্রাান্ত হইয়া সঙ্গিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েন।...ইনি ১১৬বৎসর বয়সে গত১৭ই অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সম্বরন করিয়াছেন।...মৃত্যুকালে কোনো স¯প্রদাদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিমকার্য্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না।’’(হিতকরী ,১৫ কার্তিক ১২৯৭/৩১ অক্টোবর ১৮৯০)
মহাত্মার দেহ অবসানের মধ্যদিয়ে কালের সীমানা পেরিয়ে তিনি যাপন করছেন ভাবময় জীবন ।মহাত্মার বসতি এতটা পোক্ত যে চারিধারে এতো টান ও মান তার মধ্যেও দিগন্তের পথে হেটে চলা এখান কার মানুষ , তাঁরা বট বৃরে প্রশান্ত ছায়ায় গান ধরে।সবচেয়ে তপ্ত দুপুরে মাটির টানে সে গান ছড়িয়ে পরে দিগন্তে গাঘেষে দাঁড়ানো সব গুলো গ্রামে।মানুষ গুলো বট বৃরে ব’এর মত মাটিকে আঁকড়ে ধরার মত লম্বা চুল রাখে।প্রশান্ত সাদা মেঘের মত আলখিল্লা পড়ে।তারে কম্পন জাগিয়ে সুর ছড়ায়।মহাত্মার এই যে বিচরণ তা চেতনগতবলয় পেরিয়ে অবচেতন আচরণকে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্পর্শ করে।যে কেউ সাইজীকে নিজের মত করে ধারন করতে পারে। যে কারনে মহাত্ম লালন সর্বত্রে বিরাজমান।সাইজী যাকে বলেছেন চেতন গুরু।
এই চেতনগুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনা কেউ মাপ করেনি। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ অবস্থান করার কারনে তিনিও সম্ভবত লালনে ভাবজগৎ দ্বারা কিছুটা হলেও প্রভাবিত।ডক্টর মতিলাল দাশ এর মতে,‘ রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গানে বাউল-সঙ্গীতের বিশিষ্ট প্রভাব পরিলতি হয়,এবং সম্ভবতঃ তিনি যখন শিলাইদহে ছিলেন, তখন লালন কিম্বা তাঁহার শিষ্যদিগের গান শুনিয়াছিলেন।’
কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের সহজীয়া ভাবজগতের উন্মেষ কারো কারো মতে সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মাধববিবি ও আউলচাঁদ বাউলের কাছ থেকে।তবে সবচেয়ে শক্তিশালী মত চৈতণ্য দেবের প।সুফি দর্শনও ব্যাপক মাত্রায় ভাবজগতে জড়িয়ে আছে।
’লালনের কাছে জ্ঞান ও সত্য অলৌকিক বা ঐশ্বরিক নয়।জ্ঞানে উৎস মানবগুরু। কিন্তু গুরুও সব জানে না,তাই সাধুসঙ্গ করে অনন্ত জ্ঞানের কণাগুলি সংগ্রহকরতে হয়।নিজে প্রয়েগ করে যাচাই করতে হয় সত্যতা।...ব্যক্তি ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বস্তুস্বরূপের ভগাংশ মাত্্র প্রতিফরিত করে এবং সঙ্কীণ অভিজ্ঞতাবাদে ভ্রান্তি থাকে। বহুকালের এবং বহুয়ুগের মানুষের খন্ডিত উদ্যোগ এবং অভিজ্ঞতার সমন্বিত ফল হয় মনুষের জ্ঞান।অগ্রবর্তী অভিজ্ত হতায় এবং বহুজনের অবিজ্হতায় পুষ্ট হয়ে জ্ঞানের ক্রমান্বয়ী অগ্রগতি ঘটে।লালন এ কারণে অগ্রবর্তী সাধকগুরু এবং পূর্ববর্তী পরম্পরায় পরীতি সত্যকে শ্রেয় বিবেচনা করেছেন।ভাববাদী দর্শন সমস্থ লিখিত শাস্ত্রগুলিকে কাল্পনিক তথ্যের বিকৃত করার ফলে, লালন এক সমান্তরাল জ্ঞানের উৎস নির্দেশ করেছেন।তা হল মৌখিক পরম্পরায় গুপ্তভাবে রতি গুরুপরম্পরার পরীতি সত্যের জ্ঞানভান্ডার।মানুষের কাছ থেকে যথার্থ জ্ঞান পায়।(ডক্টর শক্তিনাথ ঝা,লালনের মানুষ -তত্ত্ব) মহাত্মা লালন এমনিভাবে প্রবল আশ্রয়ে স্থান করে নেয় নদী আর বি¯তৃত প্রকৃতির বসতি গড়া কুষ্টিয়ার মানুষের গভীরে। মানুষই তারপর হয়ে ওঠে সাধনগুরু।