ছোটবেলায় স্যারের ভয়ে রচনায় আমার প্রিয় ঋতু বসন্তকাল লিখলেও আসলে শীতকালটাই আমার প্রিয় ঋতু। স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা কোন এক রহস্যময় কারণে শীতকাল পছন্দ করেন না। আমার ধারণা ছিল, গরমকালে রোদে দাড় করিয়ে ছাত্রদের শাস্তি দেওয়া যায়, কিন্তু শীতকালে তা করা যায় না- এ কারণেই শিক্ষকরা শীতকাল পছন্দ করেন না। তবে শীতকাল আমার খুবই ভালো লাগে। আর ভালো লাগে বলেই হয়তো বছরের খুবই অল্প কিছু দিন শীত থাকে। দু বছর আগেও শীত মৌসুমে সারাদিন দৌড়ের উপর থাকতাম। সকাল ৯ টায় লেপের গভীর থেকে বেরিয়ে চলে যেতাম মাঠে। শুরু হত ক্রিকেট ম্যাচ। দুপুরে খাওয়া শেষ হতে না হতেই বিকাল। আবার ক্রিকেট। আর সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চলত ব্যাডমিন্টন। কিন্তু এখন সবাই ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় খেলা আর হয় না। তবে কয়েক বছর ধরে আমরা এক নতুন খেলা পেয়েছি। শীতবস্ত্রহীন মানুষদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহ করার খেলা। তখন ছোট ছিলাম। বড় ভাইদের আদেশে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শীতবসস্ত্র সংগ্রহ করতে খুবই ভালো লাগতো। বড় ভাইরা ব্যস্ত হয়ে যাবার পর দায়িত্ব চলে আসে আমাদের উপর। আমরাও ছোটভাইদের সাথে নিয়ে কর্ম শুরু করে দেই। পিচ্চিরা বিরাট কর্মবীর। তাদের শক্তির অভাব আছে, কিন্তু ইচ্ছার কোন অভাব নেই। এক বাসায় শীতবস্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে এক পিচ্চি বলে বসল, আপনাদের কাপড়-চোপড় যা আছে সব দ্যান! ওর কথা শুনে তো বাসার মহিলা অবাক! আমরা হাসি থামিয়ে কোন মতে তাকে বুঝিয়ে বললাম। উনিও হাসিমুখে সহায়তা করলেন।
তবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করার সময় নেই বলে গতবার ভেবেছিলাম প্রজেক্ট বাদ। মনটা বেশ খারাপও হয়েছিল। কিন্তু আবারও বুঝলাম ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ফেসবুকে মজা করার জন্য আমরা খাটি গরীব...নামে একটা গ্রুপ খুলেছিলেন রস+আলোর আইডিয়াবাজ রাকিব কিশোর। পরে সে গ্রুপ থেকেই গতবছর আমরা শীতবস্ত্রহীনদের সাহায্য করেছিলাম। গ্রুপের এ্যাডমিন মেম্বারদের প্রচেষ্টায় গত বছর এরকম সময়েই শুরু হয়েছিল গরীব গ্রুপের কার্যক্রম। গ্রুপের সদস্যরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস, ওয়াল পোস্ট আর মেসেজ দিয়ে শুরু করেছিলেন এক তুলকালাম কান্ড। সবাই মিলে স্ট্যাটাস ওয়াল পোস্ট দিয়ে টাকা-শীতবস্ত্র সংগ্রহের কাজ চালাচ্ছিলেন মেল ট্রেনের গতিতে। চেনা-অচেনা সব ধরনের মানুষ তাদের আহবানে সাড়া দিয়েছিল। বিদেশ থেকেও প্রবাসী বন্ধুরাও বাড়িয়ে ছিল সাহায্যের হাত। তখন মনে হয়েছিল, আইনের হাত নয়, সাহায্যের হাতই সবচেয়ে বড়। ফেসবুক ছাড়াও নিজের বাসা থেকে শুরু করে আশেপাশের ৪০ বাড়ি, এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শীতবস্ত্র-টাকা ইত্যাদি সংগ্রহ করে কুড়িগ্রামের এক দূর্গম গ্রামের শীতার্ত মানুষদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম প্রায় ২০০ কম্বলসহ বিভিন্ন ধরনের শীতবস্ত্র।
কুড়িগ্রামের সেই অভিজ্ঞতা আমরা কখনো ভুলব বলে মনে হয় না। কাপড় বাছাই যে কত কঠিন তা না করলে বুঝতাম না। কি দেয় নি মানুষ! দামী সোয়েটার-জ্যাকেট থেকে শুরু করে স্যান্ডো গেঞ্জি এমনকি সুপারম্যান আর পাগল ছাড়া যে জিনিস কেউ প্যান্ট এর উপরে পড়ে না সেগুলোও দিয়েছে। এইসব কাপড় বাছাই করতে গিয়ে কিশোর ভাই, কিছলু(রোহিত হাসান কিছলু, বিশিষ্ট আইডিয়াবাজ) ভাইয়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কাপড় বাছাইয়ের এই কাজটায় আমি হয়তো যেতাম না, কিন্তু কিছলু ভাইদের এলাকার ডালপুরির লোভ আমাকেও যেতে বাধ্য করেছিল।
যেদিন আমরা কুড়িগ্রাম যাব সেদিন বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচ চলছিল। বিরতির সময় বের হয়ে ক্লোজ ছোটভাই নিশানের সাথে দেখা। তাকে বললাম, শীতবস্ত্র দিতে কুড়িগ্রাম যাচ্ছি। নিশান ছাগলের মত লাফ দিয়ে বলল, ভাই আমিও যাব। সে তখন ১০ম শ্রেণির অন্যতম ফাকিবাজ ছাত্র। চান্স পেলেই ফাকি দেয়। এত সুন্দর একটা চান্স পেয়ে কাজে লাগাবে না এমন ছেলে সে না। সেও আমাদের সাথে রওনা দিল।
আমরা ২০০ নতুন কম্বলের সাথে মানুষের দেওয়া অসংখ্য পুরনো কাপড়(বাছাইকৃত) সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন লেখা ট্রাকে উঠিয়ে কুড়িগ্রাম রওনা দিলাম। এই জার্নির কথাও ভোলা ঠিক হবে না। ভেবেছিলাম এ জার্নি বাই বোট এর মত এ জার্নি বাই ট্রাক নামে আমিও একটা রচনা লিখব। পরে আর লেখা হয়নি। যাই হোক, কুড়িগ্রামে আগে থেকেই সব কিছু ঠিক করা ছিল। আমরা গিয়েই কাজে নেমে পড়লাম(আমি অবশ্য শীর্ষস্থানীয় ফাকিবাজের দায়িত্ব পালন করে কোন কাজই করি নি)। ওই গ্রামের চেয়ারম্যান(এই চেয়ারম্যান বাংলা সিনেমার চেয়ারম্যানদের মত না। তার নিজেরও অবস্থা খারাপ। গ্রামের লোক তার কথাই শোনে না। আমার ধারণা আরএফএল এর চেয়ার ব্যবহার না করার কারণেই তার এই অবস্থা) আমাদের সাহায্য করার দায়ভার নিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেললেন। অবস্থা দেখে আমরা নিজেরাই কাজ শুরু করলাম। নতুন কম্বল দেওয়ায় সবার সে কি খুশি। আমরাও উৎসাহ পেয়ে পুরোন কাপড় বের করলাম। ঘটনা এখানেই ঘটল। মাত্র ২০০ কম্বল থাকায় অনেকেই কম্বল পায় নি। তারা পুরোন কাপড় দেখে বলল, অমুকের বউ কম্বল পাইসে, আমার কম্বল কই? আমি পুরান কাপড় নিমু না। তখন আমার মনে পড়ে গেল আমাদের সবার বন্ধু, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কথা। তিনি নাকি বলেছিলেন, সাড়ে ৭ কোটি কম্বলের মধ্যে আমার কম্বল কই? ঘটনা সত্য কি না জানি না। তবে অন্যরা ঠিকই পুরান কাপড় নিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক লোক এসে বলে, ভাই, আমারে যে প্যান্টটা দিসিলেন ওইটা সাইজে ছোট হইসে, বদলাইয়া দ্যান।
মানুষের ভীড় কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিল না। কারণ, নিরাপত্তার জন্য চেয়ারম্যান যাদের রেখেছিলেন তাদের কেউই কোন কাজের না। শেষে আমরাই এ্যাকশনে নামলাম। সবাইকে লাইনে দাড় করিয়ে কাপড় দেওয়া শুরু হল। শেষও হল একসময়।
কাজ শেষে আমরা চেয়ারম্যানের বাড়িতে খাদ্যগ্রহন করে ঢাকার উদ্ধেশ্য রওনা দিলাম। গ্রাম থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে যেতে হয়। সেই ঘোড়ার অবস্থা খুবই করুন। দেখলেই মায়া হয়। তবুও নিরুপায় হয়ে আমরা ঘোড়ার গাড়িতেই উঠলাম। অর্ধেক পথে ঘোড়া বসে পড়ল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম বাঙালী মানুষের মত বাঙালী ঘোড়াও বসতে দেওয়ার সাথে সাথে একেবারে শুয়ে পড়ল। গাড়ির চালক বলল, তেমন কিছু না। একটু পর উইঠা খাড়াইব। ঘোড়া আসলেই উঠে দাড়াল। কিছলু ভাই অন্য গাড়িটায় বসে আমাদের ঘোড়ার অবস্থা দেখে খুব হাসছিলেন। এইজন্যই বোধহয় ধরা খেলেন। তবে ঘোড়ার কিছু হল না। গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেল। না হয়ে উপায় কি? কিছলু ভাইয়ের ওজন সামলানো সহজ ব্যাপার না। ঢাকায় কম্বল কেনার পর বহন করার সময় ভ্যানের চাকা পাংচার করতে উনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিলেন। ঘোড়া ও গাড়ির এই অবস্থা দেখে আমরা হেটেই রওনা দিলাম। ওই অঞ্চলে লোডশেডিং হয় না। বিদ্যুতই পৌছায়নি, লোডশেডং হবে কিভাবে? গাঢ় অন্ধকার। আকাবাকা রাস্তা। আকাশ ভরা তারা। আর সেই মিটিমিটি তারার সাথে কথা কইতে গিয়ে আমি পড়লাম এক গর্তে। বিশ্রী অবস্থা!
তারপর কুড়িগ্রাম শহরে গিয়ে বাসের টিকিট কেটে হোটেলে খেতে বসলাম। সম্ভবত এই এলাকার মানুষ মুলা ছাড়া কিছু খায় না। যেখানেই যাই, এক দেশ এক রেটের মত একই জিনিস, রুটি আর মুলা ভাজি, না হয় মুলার তরকারি। আমি মুলা খাই না। কোনমতে ডাল দিয়ে রুটি খেয়ে বাসে উঠে মনে হল, কষ্টগুলো বৃথা যায় নি। অন্তত কিছু মানুষের উপকার করতে পেরেছি এই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি বাসে ঘুমাতে পারি না। তাই বাসের হেডলাইটের মত আমার চোখও সারারাত জ্বলল। সারাদিনের কথা মনে করতে করতে ঢাকা চলে আসলাম। বাসায় এসে কম্বলের নিচে প্রবেশ করতে গিয়ে মনে হল, আমাদের একটু চেষ্টার কারণে কিছু কম্বলহীন মানুষ কম্বলের নিচে প্রবেশ করার আরামটা পাবে। তাদের আরামের কথা ভেবেই আরামে ঘুম চলে আসল।
গতবারের মত এবারও আমরা খাটি গরীব গ্রুপের মাধ্যমে শীতার্তদের সাহায্য করব। আশা করি গতবারের তুলনায় এবার আরও বেশি সাড়া পড়বে। গতবার যারা ভেবেছিলেন ফেসবুকের মাধ্যমে এসব হবে না, তাদের ভুল নিশ্চয়ই ভেঙেছে। এবার হয়তো তারাও আমাদের সাথে যোগ দেবেন। ভাবতে ভালোই লাগে যে আমাদের পথ অনুসরন করে ফেসবুকে আরও বেশ কিছু গ্রুপ হয়েছে। তারাও এবার শীতার্তদের শীতবস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে। ব্লগে দেখলাম, সকল ব্লগার একজোট হয়ে শীতার্তদের পাশে এসে দাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। আশা করি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই ঘোষণা নিয়ে কোন বিতর্ক থাকবে না। আমি সব সময় খেয়াল করে দেখেছি, সবাই মিলে এক সাথে কাজ করলে কোন বিতর্ক হওয়ার চান্সই থাকে না।
গ্রুপের লিংক :
Click This Link