....
এই যে মায়ের অনাদরে কিষ্ট শিশুগুলি
পরনে নেই ছেঁড়া কানি সারা গায়ে ধুলি....
কবি কত কষ্ট করে এই লাইনগুলো লিখেছিলেন। অথচ কবির মনের দুঃখটা আমরা বুঝতেই পারতাম না। উল্টো তার উপর আরও রাগ হত। ধুর, এইটা কোন কবিতা হল? লেখার আর বিষয় পেল না? পথশিশুদের নিয়ে এত কঠিন কবিতা কে লিখতে বলেছে? পুরো কবিতা মুখস্থ করতে গিয়ে আমাদের জান সুরসুর করে বেরিয়ে আসছে। কোনমতে প্রথম আট লাইন মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি প্রশ্নে বলেছে শেষের আট লাইন লেখ। বাংলা স্যারের মাথায় যে এমন অংক স্যার টাইপ প্যাচ এই প্রশ্ন না দিলে বুঝতেই পারতাম না। এখন অবশ্য কবির উপর আর রাগ হয় না। মনে হয় নাহ, লোকটা ভালোই লিখেছিল। গাইডের ভাষায় বললে বলতে হবে- কবি তার সুনিপুন ছন্দের চম্পক স্পর্শে পথশিশুদের দুঃখ-দূর্দশার কথা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন এই কবিতায়। কবির পে চম্পক স্পর্শে পথ-শিশুদের দুঃখ-দুর্দশা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু চম্পক স্পর্শে দুঃখ দূর হয় না। দুঃখ দূর করার জন্য মানুষের মনে একটু নাড়া দেয়া দরকার। কবি সাহেব সেটাই করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মন সম্পর্কে তার হয়তো তেমন ধারণা ছিল না। আমাদের মন এতই ভারী যে কবির সুনিপুন ছন্দেও তা নড়ে না। স্টিল হয়ে থাকে। তবে কারো কারো মন আবার কিঞ্চিত দূর্বল। তাদেরটা নাড়া খায়। ফেসবুকে আমরা খাঁটি গরীব নামে একটা গ্র“প আছে। খুবই কার্যকর এবং ভালো গ্রুপ। এই গ্র“পের সদস্যদের মন নিয়মিতভাবে নাড়া খাচ্ছে। জানুয়ারির প্রচন্ড শীতে উত্তরাঞ্চলের মানুষ কষ্ট পাচ্ছে- এটা দেখে আমরা খাঁটি গরীব গ্র“পের সদস্যদের মনে নাড়া লাগলো। তারা বিরাট কর্মবীর। শীতার্ত মানুষদের সহায়তা করার কঠিন ঘোষণা দিয়ে বসলো। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে, এই ঘোষণার পরেও সৃষ্টি হল বির্তক। অনেকেই বলল, ফেসবুক ফান করার জায়গা, এইখানে এই পথভ্রষ্ট পোলাপানগুলা গরীবদের নিয়ে ফান করছে, এই সেই। গরীব গ্র“পের সদস্যরা এইসব বিতর্ককে কোন পাত্তা না দিয়ে ফেসবুকে মেসেজ, স্ট্যাটাস, ওয়াল পোস্টের মাধ্যমে টাকা-পয়সা, শীতবস্ত্র জোগাড় করে ফেললো। নিজেদের এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ থেকে সবাই ত্রান সংগ্রহ করলো। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও একযোগে চলতে লাগলো ত্রান সংগ্রহের কাজ। দেশের বাইরে থেকেও বিপুল পরিমান সাহায্য আসতে লাগলো। বিশাল অবস্থা। তারপর একদিন ট্রাক ভর্তি শীতবস্ত্র আর কম্বলের বস্তা নিয়ে গরীব গ্র“পের সদস্যরা কুড়িগ্রাম রওনা হয়ে গেল। কুড়িগ্রামে শীতবস্ত্র দিয়ে আর সেখানকার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এসে আবার শুরু হল মজা। শীতবস্ত্র দিতে গিয়ে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে, সবাই তাদের নানা ঘটনা শেয়ার করছে ফেসবুকে। পাকা আম খেয়ে একেকজন স্ট্যাটাস দেয়- ‘রাজশাহীর খাঁটি ম্যাংগো খাইলাম। বড়ই বিচিত্র।’ এরকম আরও নানা কিছু। হঠাৎ তাদের মনে আবার একটা নাড়া লাগলো। আমরা কত আরামে আম খেয়ে স্ট্যাটাস লিখছি, একটু টক হলে আস্ত আমটাই ফেলে দিচ্ছি, আর ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো পথশিশুরা আামের স্বাদই পাচ্ছে না। কোনটা রাজশাহীর আম, আর কোনটা ফরমালিন দেওয়া আম এটা বোঝা তো দূরের কথা, আম খাওয়ার সামর্থই নেই কারো। খাঁটি গরীব গ্র“পের নাড়া খাওয়া সদস্যরা শুরু করল নতুন মিশন। পথশিশুদের আম খাওয়ানো হবে। তারা আবার কাজে নেমে পড়লো। ফেসবুকে মহাসমারোহে চলছে প্রচার। স্ট্যাটাস, মেসেজ, ওয়ালপোস্টে হোমপেজ পরিপূর্ন। গ্র“পের অন্যান্য সদস্যরাও তিন লাফ দিয়ে এগিয়ে আসছে এ মিশনে। ব্যাংক এ্যাকউন্টে জমছে টাকা। এই টাকা দিয়ে আম কিনে পথশিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তবে যেহেতু প্রশ্ন তুলতে কোন টাকা-পয়সা লাগে না, তাই এই মিশন নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছে। পথশিশুরা ভাত পায় না, তাদের আম খাইয়ে কি লাভ? আম খেয়ে পেট ভরবে? গরীবদের দুঃখ নিয়ে মশকরা.....’ গরীব গ্র“পের সদস্যরা এই ধরনের নিম্নমানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিপুল উৎসাহে কাজ করে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক মত হলে আগামী ১৮ ই জুন পথশিশুদের আম খাওয়ানো হবে। ঢাকায় বড়লোকের স্কুলের পাশাপাশি পথশিশু, শ্রমজীবি শিশুদের লেখাপড়া শেখায় এমন বেশ কিছু স্কুলও আছে। সেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা বহু কষ্টে কাজের পাশাপাশি পড়ালেখাটাও করছে। আমার ৫ বছর বয়সী ভাগ্নীর স্কুলে ফ্যান-এসি দুটোই আছে। গাড়িতে যায়, গাড়িতে আসে। তারপরও প্রায়ই সে ‘আব্বু, আমি স্কুলে যাব না’- এই বলে কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। অথচ ঢাকার অনেক শিশু বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালিয়ে স্কুলেও যায়। সেই স্কুলগুলোর অবস্থা দেখলে যে কারো মন খারাপ হবে। বদ্ধ টিনের ঘর, প্রচন্ড গরমে সেই ঘরে গাদাগাদি করে মাটিতে বসে শিশুরা কাস করে। মেঝেতে রাখা বই-খাতার পাশ দিয়ে হঠাৎ হেঁটে যায় কালো তেলাপোকা। সেই তেলাপোকার সাথে বসেই এরা হয়তো পড়ে স্বরে আ তে আম। কিন্তু ওই পড়া পর্যন্তই। আমের স্বাদটা তাদের পাওয়া হয় না। ছবির দিকে তাকিয়েই হয়তো তারা একজন আরেকজনকে বলে, ‘তোর আমটা মিষ্টি না, আমারটা মিষ্টি, এক্কেবারে রাজশাহীর গাছপাকা খাঁটি আম। অ-নে-ক মজা!’ কি ভয়ংকর অবস্থা। এইরকম স্কুলে কোন আনন্দ থাকার কথা না। ‘আমরা খাঁটি গরীব’ গ্র“প আম খাইয়ে এই শিশুগুলোকে একটু আনন্দ দিতে চায়। একটা দিন, মাত্র একটা দিন অল্প কিছু আম পেয়ে যদি এই শিশুরা একটু আনন্দ পায়, আম খাওয়ার খুশিতে হাসতে গিয়ে যদি তাদের দু-একটা ফোকলা দাঁত বেরিয়ে পড়ে কিংবা পাকা আমের রসে যদি বাচ্চাদের জামা ভিজে যায়- এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে? খাঁটি গরীব গ্র“প এই সুন্দর দৃশ্যটা মঞ্চস্থ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সবার কানের কাছে তারা ভেঁপু বাজাচ্ছে। আম আঁটির ভেঁপু। তাদের
চেষ্টা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। কাজে নেমে পড়তে ইচ্ছা করে। অনেকে নেমেও পড়ছে। তাদের সবার জন্য হাততালি। আর যারা কাজে নামতে চাচ্ছেন, কিন্তু সব তথ্য না জেনে এগোতে খুব একটা সাহস পাচ্ছেন না, তাদের জন্য ‘আমরা খাঁটি গরীব’ গ্র“পের খাঁটি লিংক নিম্নে দেওয়া হইলো।
Click This Link