আমাদের এলাকায় ক্লাবঘর নামক একটা ঘর আছে। এলাকার কল্যান সমিতির অফিসটাকে সবাই ক্লাব ঘর বলে। এই ঘরে এলাকার মুরব্বিরা দরজা-জানালা বন্ধ করে ভাল ভাল(ভালো কথাটার বিশেষ অর্থ আছে, বুদ্ধিমানরা বুঝে নিন) সিনেমা দেখে। তবে তাদের প্রথম পছন্দ হল মহিলাদের রেসলিং। বিশ্বকাপ টাইপের কোন খেলা হলে এই মুরব্বিদের একটু মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ তখন এলাকার পোলাপান সবাই মিলে ক্লাব ঘরে খেলা দেখতে আসে। মহিলাদের রেসলিং বা ক্যাটরিনার নাচ কোনটাই দেখা হয় না। পারফিউমের বিজ্ঞাপন আর চিয়ার লিডারদের নৃত্য তাদের সামান্য আনন্দ দেয়। যাই হোক, গতকাল রাতের কথা। অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের খেলা হচ্ছে। ক্লাবে প্রচুর লোক। আমি এবং আমার দোস্ত পাভেল খুবই অবাক হলাম। এই এলাকার মানুষ সব ভারত বা পাকিস্তানের সাপোর্টার। এরা এত মনযোগ দিয়ে এই খেলা দেখছে কেন? ক্লাবে ঢুকে বুঝলাম সবাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কারণ একটাই, অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানকে বিদায় করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার একটা উইকেট পড়ে আর পাবলিক খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে। আমার দোস্ত পাভেল এক লোককে বলল,
-আপনি ইংল্যান্ড সাপোর্ট করছেন?
-অবশ্যই। এই হারামজাদা অস্ট্রেলিয়া আমাদের বুকটা একেবারে ঝাজড়া কইরা দিসে। আহারে! কেমনে ওরা পাকিস্তানরে হারায় দিলো। ইশ। ওই কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে কেমন যেন লাগে।
তার কথা শেষ হতে না হতেই ক্যামেরন হোয়াইট আউট। এই খুশিতে লোকটা চিৎকার দিয়ে পাভেলকে জড়িয়ে ধরল। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই লোককে আমি খুব ভালো করে চিনি। বাংলাদেশের খেলার সময়ে সে ছিল। বাংলাদেশের সাথেও ক্যামেরন হোয়াইট আউট হয়েছে। কিন্তু তখন এই লোক খুশিতে কাউকে জড়িয়ে ধরেন নি।
পাকিস্তানের সাথে দ.আফ্রিকার খেলা দেখছি। আমির খুবই সহজ একটা ক্যাচ মিস করায় আমরা বললাম, পাকিস্তান ভুয়া। বাংলাদেশের ফিল্ডিং কত ভালো। এক আংকেল বললেন, ‘বলটা সামনে পড়সে। এই ক্যাচ কেউ ধরতে পারতো না।’ আমরা বললাম, কি যে বলেন, আমাদের ইমরুল কায়েস থাকলেই এইটা ধইরা ফেলতো। আংকেল এমন ভাবে তাকালেন যেন ইমরুল কায়েস জীবনে ক্যাচ ধরেনি। বললেন, ‘বাংলাদেশ কি খেলে তা আমরা জানি। একটা ম্যাচও জিততে পারে না।’
আমরাও জানি। শুধু আমরা কেন? বাংলাদেশের ফিল্ডিং যে ভালো তা সবাই জানে। তবে জানে না এদেশের কিছু লোক। পাকিস্তান টিমের প্রতি এদের মমতার শেষ নাই। ক্যাচ মিস করলে বলে- ‘সামনে পড়সে’ আর বাংলাদেশি কেউ কোন ক্যাচ মিস করলে সারা জীবনে যে যত গালি শিখেছে তা মুখস্ত বলা শুরু করে।
অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত হারার পর এক লোক আক্ষেপ করে বলছিল, ‘ধুর, আজকে দুঃখে আমার পড়ালেখা হবে না। ঘুমও আসবে না।’ অথচ বাংলাদেশ ভালো খেলেও হারার পর ওই লোক যে গালি গুলো বাংলাদেশ টিমকে দিয়েছিল শুনলে ওরা খেলাই ছেড়ে দিত। এদের যখন বলি- ছি, আপনি বাংলাদেশ সাপোর্ট না করে ভারত-পাকিস্তান সাপোর্টঁ করেন? আপনি তো মানুষ না, রাজাকার- এসব কথা শুনলেই এই সাপোর্টারগুলো বলে, ‘দেখেন ভাই, খেলা হচ্ছে খেলা, নির্মল বিনোদন। প্লিজ এর মধ্যে রাজনীতি টেনে আনবেন না, রিকোয়েস্ট।’ এই টাইপের কথা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। কয়েকদিন আগে আবার শুনলাম। আমি রাজনীতি তেমন বুঝি না। ছোটদের রাজনীতি নামের একটা বই বাসায় আছে। আমি পড়ার আগেই উইপোকারা বইয়ের কিছু অংশ পড়ে ফেলেছে। রাজনীতির প্রতি উইপোকাদের যে এত আগ্রহ তা আগে বুঝি নি। উইপোকাদের সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হত, রাজনীতি জিনিসটা কি তা তাদের কাছ থেকে বুঝে তারপর সেটা নিয়ে টানাটানি করতাম। তবে ভারত-পাকিস্তানের এই রকম সমর্থক দেখলে বা এদের কথা শুনলে ইচ্ছা করে এদের প্রত্যেকের কানের লতির ঠিক দুই ইঞ্চি নিচে কষে দুইটা থাবড় মারি। কে জানে, একদিন হয়তো সত্যি সত্যি মারবো।