আধুনিক যৌনতার হালহকিকত
দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী
ক্লাস নাইনের দুই পড়ুয়া। তারা পৌঁছে গিয়েছে সোনাগাছিতে। কারণ, প্রেমের সম্পর্কে তারা জড়িয়ে পড়েছে। তার-ই জেরে যৌন সুখের উল্লাসে মেতে উঠতে চাইছে ওই দুই পড়ুয়া। কিন্তু, যৌনপল্লীতে কেন! কারণ, খোঁজখবর নিয়ে তারা এমন জানতে পেরেছে, সোনাগাছিতে ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। সেখানে তারা নিরাপদে মেতে উঠতে পারবে যৌনতায়। তেমনই, দুই কলেজপড়ুয়াও। খোঁজখবর নিয়ে তাঁরাও এমন জানতে পারেন, যৌনতা উপভোগের জন্য অন্যকোনো জায়গার বদলে তুলনামূলক ভাবে বেশি নিরাপদ হবে সোনাগাছির কোনো ঘর। তবে, যৌনসুখের উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য কোনো যৌনপল্লীর কোনো ঘর-ই যে ওই ধরনের কোনো কিশোর-কিশোরী অথবা তরুণ-তরুণীর ক্ষেত্রে আদৌও নিরাপদ কোনো স্থান-ই নয়, সেই বিষয়টি জানতেও তাঁদের খুব বেশি সময় নষ্ট হয়নি। কেননা, যৌনতা উপভোগের জন্য সোনাগাছির কোনো ঘর সাধারণত এই ধরনের কাউকে ভাড়া দেওয়া হয় না। কোনোভাবে ভাড়ায় ঘর মিলে গেলেও, থেকে যায় অন্য বিভিন্ন সমস্যাও। যেমন, কোনো যৌনপল্লীতে কোনো সমাজবিরোধীর আনাগোনা অসম্ভব নয়। তেমনই, যেকোনো যৌনপল্লীতে যেকোনো সময়ই হতে পারে পুলিশি হানা। কিন্তু, শুধুমাত্র যেমন এমন দুই ঘটনাও নয়। তেমনই, ওই কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীর কাহিনীও আবার বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও নয়। কেননা, বিভিন্ন সময় এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী থাকতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে। শুধুমাত্র যে সাক্ষী থাকতে হচ্ছে, তাও নয়। বরং, আগের তুলনায় এই ধরনের আরও বেশি ঘটনার এখন সম্মুখীন হচ্ছে ওই সংগঠন। তেমনই, শুধুমাত্র যে নিজেদের ইচ্ছায় যৌন সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য সঙ্গীর সঙ্গে কোনো কিশোরী অথবা তরুণী সোনাগাছি অথবা এ রাজ্যের কোনো যৌনপল্লীর ঘর খোঁজ করছেন, তাও নয়। কেননা, বিভিন্ন সময় দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে অন্য বিভিন্ন ঘটনারও সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সে সবের মধ্যে এমনও হয়: কোনো কিশোরী অথবা তরুণীকে সেখানে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের-ই নিকট কোনো আত্মীয় অথবা পরিচিত। ওই কিশোরী অথবা তরুণীর সঙ্গে ওই আত্মীয় অথবা পরিচিতর প্রেমের সম্পর্ক যে থাকতে পারে না, তাও নয়। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সূত্রের খবর, এমনও হচ্ছে যে, কোনো কিশোরী অথবা তরুণীকে এই শহর দেখাবেন বলে কলকাতায় নিয়ে এলেন তাঁর কোনো আত্মীয় অথবা পরিচিত। কিন্তু, ওই কিশোরী অথবা তরুণীকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেলেন তাঁর ওই আত্মীয় অথবা পরিচিত। কারণ, শহর দেখানোর নাম করে ওই কিশোরী অথবা তরুণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়তে চান নিকট ওই আত্মীয় অথবা পরিজন। কিন্তু, যৌন সুখের উল্লাসে নিশ্চিন্তে মেতে ওঠার জন্য এ ভাবে কেন-ই-বা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে সোনাগাছি অথবা অন্যকোনো যৌনপল্লীকে? দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সূত্রের খবর, যৌনপল্লী সম্পর্কে অনেকের-ই সেভাবে ধারণা নেই। যে কারণে, ওই সংগঠনকে এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে, এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে কোনোমতেই সমর্থন করে না পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। ওই সংগঠনের সচিব ভারতী দে বলেন, দুর্বারের কোনো মেয়ে বাদে অন্য কেউ এখানে ঘর ভাড়া নিতে পারে না। তবে, একই সঙ্গে তিনি অবশ্য বলেছেন, কোনো কোনো সময় বাইরের কেউ ঘর ভাড়া পেয়ে যায়। যে যা যাঁরা এ ভাবে ঘর ভাড়া দেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিই। কিন্তু, সোনাগাছি অথবা কলকাতা সহ এ রাজ্যের অন্য কোনও যৌনপল্লিতে কেন ঘরের খোঁজে আসছেন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মহিলা-পুরুষরা? কারণ, দুনিয়া ক্রমে আরও বদলে চলেছে। আর, তার সঙ্গে বদলে চলেছে যৌনতার সংজ্ঞাও। অন্যদিকে, যৌনতা যে জীবনের কতটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সেই বিষয়েও চিন্তা-ভাবনায় ক্রমে আরও পরিবর্তন ঘটছে। আর, এমনই নানা কারণে, যৌন সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিরাপদ স্থান মনে করে বেছে নেওয়া হচ্ছে যৌনপল্লির কোনও ঘর। তবে, ভারতী দে বলেন, দুর্বারের ফিল্ড ওয়ার্কাররা সতর্ক রয়েছেন। বাইরের কেউ যদি এখানে কখনও ঘর ভাড়া পেয়ে যান, তা হলে আমাদের কাছে খবর চলে আসে। নাবালক কোনও মেয়ের জন্য কোনও ঘর যদি কেউ ভাড়া দেন, তা হলে, আমরা তাকে পুলিশের কাছে তুলে দিই। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সচিব বলেন, ক্লাস নাইনের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে কিছুটা সময় ওরা একসঙ্গে কাটাতে চেয়েছিল। এত কম বয়স। তাই ওদেরকে পুলিশের কাছে তুলে না দিয়ে, ওদের অভিভাবকদের খবর পাঠানো হয়। তার পর, অভিভাবকদের বুঝিয়ে, তাঁদের সঙ্গে ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’’ সেভাবে না বুঝে ক্লাস নাইনের ওই দুই পড়ুয়া সোনাগাছি পৌঁছে গিয়েছিল। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এমনই মনে করে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে ওই দুই পড়ুয়াকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হলে, তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। যে কারণে, তাদের অভিভাবকদের কাছেই ওই দুই পড়ুয়াকে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু, কলেজ পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে? ভারতী দে বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক হলেও, ঘর ভাড়া নিয়ে কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানোর জন্য জায়গা নয় সোনাগাছি অথবা অন্য কোনও যৌনপল্লি। এ কথা কলেজের ওই ছাত্র-ছাত্রীকে বোঝানো হয়েছিল। পুলিশ হানা দিলে তাঁরা যে সমস্যায় পড়তে পারেন, সেই বিষয়টিও বোঝানো হয়েছিল। তবে, স্কুল-কলেজের ওই ধরনের পড়ুয়াদের থেকেও দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির কাছে অনেক বেশি চিন্তার কারণ কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলা এবং তার সঙ্গীর বিষয়টি। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সচিব বলেন, কলকাতা দেখাবে বলে নাবালিকা একটি মেয়েকে সোনাগাছিতে নিয়ে এসেছিল ওর কাকা। বিষয়টি আমাদের নজরে আসতেই আমরা পুলিশের সহায়তা নিয়েছি। কারণ, কিছু সময়ের জন্য এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে ওই নাবালিকার সঙ্গে তার কাকা যৌন সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিল। একই সঙ্গে ভারতী দে বলেন, আত্মীয় অথবা পরিচিত কেউ, এ ভাবে অনেক সময় কোনও নাবালিকাকে ফুঁসলিয়ে অথবা তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে এখানে আসে ঘর ভাড়া নিয়ে কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটাবে বলে। এ সব ক্ষেত্রে আমরা তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিই। নিষিদ্ধ পাড়ায় কেন যায় পুরুষরা ? চারিদিকে যখন সেক্স র্যা কেট নিয়ে এত গুঞ্জন৷ তখন জানিয়ে রাখা ভালো দেহব্যাবসা চলছে, কিন্তু একমাত্র পুরুষের দয়াতেই৷ অনেকে বলতেই পারেন জিগোলো প্রথা এখনও বাড়ছে৷ কিন্তু তবুও যৌনপল্লিতে পুরুষ খদ্দেরদেরই রমরমা৷ সকলে বলবেন পারিবারিক জীবনে সুখশান্তির অভাবেই একজন পুরুষ যৌনপল্লির রঙিন আলোয় রাঙিয়ে তুলতে চান তার জীবন৷ কিন্তু যাঁরাই বেশ্যালয়ে যান সেইসব পুরুষের জীবনের গল্পটা কি একই ? যদিও সেটা নিয়ে ভিন্ন পুরুষের ভিন্ন মতামত৷ বিবাহত জীবনে সমস্যা বা জীবনের নিরাশা দূর করার পাশাপাশি অতিরিক্ত যৌনখিদে মেটাতেও বেশিরভাগ পুরুষই একজন বেশ্যার বিছানায় আশ্রয় নেন৷ এমনও কিছু পুরুষ রয়েছে যারা দীর্ঘদিন ধরে একজন বেশ্যার কাছেই যান৷ যেসব পুরুষরা যৌনকর্মীদের আশ্রয় নেন তাদের ছবি মোটামুটি একই ধরনের, কিন্তু তারা এই কাজের জন্য কি যুক্তি দেন ? ফ্রেড ও লারা প্রায় ছয় বছর ধরে একে অপরকে চেনে৷ কিন্তু তফাৎ একটাই যে লারার সঙ্গে সময় কাটাতে ও সহবাস করার জন্য টাকা দেয় ফ্রেড৷ সহবাসের জন্য টাকা দেওয়া ঠিক কি না তা নিয়ে দুজনে মাঝেমধ্যে ঝগড়াও করে৷ চাকরি ছাড়ার পর ইন্টারনেটের মাধ্যমেই লারার সঙ্গে আলাপ হয় ফ্রেডের৷ তাদের দুজনের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়৷ লারা বলেন, “আমি দেখা করতে আসার আগেই ফ্রেড আমার অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে দেয়”৷ অন্যদিকে রবার্টের জীবন আবার বেশ খানিকটা অন্য৷ বেশ কয়েকবছর হল তার বিয়ে হয়েছে৷ রবার্ট বলেন, “আমি সেক্স খুব পছন্দ করি, কিন্তু আমার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে সেক্স তো দূরের কথা জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়াও পছন্দ করে না৷ যদিও জীবনসঙ্গিনী হিসেবেও খুব ভালো”৷ তিনি আরও বলেন, “আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাইতাম৷ এই কারণেই আমাকে বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে যৌনতা কিনতে হয়েছে৷” রবার্টের মতো অনেকেই মনে করেন সম্পর্কের জটিলতা কাটাতে এটি একটি ভালো উপায়৷ যদিও গ্রাহাম জানিয়েছেন, “এটা সত্যিই খুব রোমান্টিক, আর এতে মনে হয় যেন এক মিনিটে একটা গোটা সম্পর্ক তৈরি হওয়া”৷ গ্রাহামের মতোই অপর একজন হলেন সাইমন৷ লাজুক হওয়ার কারণেই মহিলাদের সঙ্গে সহজে মেশাটা তার কাছে চিরকালই ছিল দুঃসাধ্য৷ সাইমন বলেন, “সহবাসের জন্য আমার প্রবল ইচ্ছা হয়৷ কিন্তু শুধু সাময়িক আনন্দের জন্য আমি এটা করি না৷ আসলে ওই মুহুর্তে কিছু সময় যদি আমি একজন মহিলার সঙ্গে কাটাতে না পারি, তাহলে আমি নিজেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে মনে করতে থাকি৷” পুরুষদের বেশ্যাগমন কিন্তু শুধুই বীর্যস্খলনের জন্য – এটা ভাবলে বেশ ভুল হয়ে যাবে।কেউ যায় নেশা করতে, কেউ যায় নানা কারণে আত্মগোপন করতে, কেউ যায় বডি করাতে, কেউ-বা অত্যাচার করতে, কেউ যায় শুধুই ঘসাঘসি করতে, কেউ-বা আসে নির্ভেজাল গল্প করতে।কে, কী করতে বেশ্যার ঘরে রাত বা দিন কাটাচ্ছে তা এক প্রয়োজনের সঙ্গে আর-এক প্রয়োজন এমনভাবে মিশে আছে যে কোনো একটা উদ্দেশ্য আলাদা করে বাছা যায় না।
বেশ্যাপাড়ার বেশ্যারা কেমন মস্তি-স্ফূর্তি করে জানতে ইচ্ছা করে খুব।যে যৌনতা নিয়ে তামাম মানুষের কত ফ্যান্টাসি কত প্যাশন, সেই যৌনতা বেশ্যাপাড়ার বেশ্যাদের যৌনসঙ্গী যখন মোটেই দুর্লভ নয়, সেই যৌনতা কতটা উপভোগ্য ! একটিবার যৌনমিলনে জন্য নারীপুরুষনির্বিশেষে যে মানুষ হা-হুতাশ, তখন বেশ্যাপাড়ার বেশ্যারা ‘হর রাত নই খিলাড়ি’-দের পেয়ে জীবন কেমন সুখের সাগরে ভাসছে ? ক্ষেত্র-সমীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কথা বলতে হবে তাঁদেরই সঙ্গে, যাঁরা প্রতি রাত নতুন নতুন যৌনসঙ্গীদের যৌনমিলনে মেতে ওঠেন।রাতভর যাঁরা স্ফূর্তি করে তাঁরা কী বলছে ? কী গল্প ? যা শুনেছি তা যতটা সম্ভব মার্জিত ভাষায় শীলিত ঢঙে প্রকাশ করার চেষ্টা করব স্মৃতির কাছে ঋণী থেকে -- “এ পাড়ার মেয়েরা কেউ মানুষ নয়, যোনি-সংবলিত যন্ত্রবিশেষ। ভালোবাসাহীন, প্রেমহীন, আদরহীন, আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন, রুচিহীন এক যান্ত্রিক সম্পর্কহীন সম্পর্ক। পয়সার বিনিময়ে আমাদের প্রতি রাতে ক্লান্তিহীন যোনি বিলাতে হয় একাধিক পুরুষকে, যে পয়সার অনেকটা অংশ খেয়ে নেয় অনেক নেপো।প্রতি রাতের এক-একটি খরিদ্দার যেন এক-একটি বিভীষিকা, আতঙ্ক, অত্যাচারী, নির্যাতক।পুরুষ নয়, লিঙ্গনামক একটি মৃত্যুদণ্ড ! কেমন যৌনসুখ ? যৌনসুখ কী সেটা কোনোদিনই বুঝতে পারলাম না। কাকে বলে ভালোবাসা ? কাকে বলে সোহাগ-আদর ? কাকে বলে শৃঙ্গার ? যৌনসঙ্গী বেছে নেওয়ার কোনো স্বাধীনতা নেই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। কোনোদিন তা জেনেবুঝে উপভোগ করতে পারলাম কই ! জেনেবুঝে নেওয়া তো দূরের কথা – খরিদ্দারের সঙ্গে যখন প্রথম যৌনকর্মের অভিজ্ঞতা হয় তখন তো অজ্ঞান অবস্থা। যখন, মানে যে বয়সে সেক্স করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার নয়, সেই বয়সে সঙ্গম ঘাড়ে চেপে বসে। বলাৎকার দিয়ে শুরু হয় আমাদের যৌনজীবন।তারপর একদিন সময়ের দাবি মিটিয়ে শরীরের এ ক্ষত ক্রমশ শুকিয়ে যায়। শরীর-মনের ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনো দাম নেই। ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। ‘বাবু’ এলেই ‘বসতে’ হবে। এটাই দস্তুর। কখনো-কখনো খরিদ্দারের কাছে আমাদের শরীরটার জেল্লা বাড়াতে গর্ভধারণও করতে হয়। গর্ভধারণ করলে বুক–দুটো বেশ ভারি-ভারি হয়ে ওঠে, শরীরটা গোল-গোলপানা হয়। পোয়াতি মেয়ের ভরা বুক ভরা শরীর অনেক খরিদ্দারকে বেশ তাতিয়ে দেয়। কিন্তু সন্তান যতক্ষণ ধারণ করে রাখা যায় ধারণ করি, তারপর একসময় গর্ভপাত। পেটের ভিতর ছয়-সাত মাসের বাচ্চা তখন বেশ বড়ো। বাচ্চা এমন বড়ো হয়ে গেলে গর্ভপাত মানেই মৃত্যকে নেমন্তন্ন করা। তবুও করতে হয়। পেট খসাতে হাতুড়ে ডাকতে হয়, বাধ্য হয়েই। সেপটিক হয়ে কেউ কেউ মারাও যায়। কেউ সে খবর রাখে না। প্রতি মুহূর্তে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক যৌনমিলনের আতঙ্কে দিন এবং রাত গুজরান।সারা পৃথিবীর যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা যে-কোনোদিন যে-কোনো মুহূর্তে পেশার মুখে লাথি মারতে তৈরি।সুযোগ পেলে আমরা যৌনপল্লিগুলি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। কিন্তু চাইলেও কোনোদিন নিশ্চিহ্ন হবে না। কারণ আমরা ছাড়া কেউই আমাদের পেশাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় না। বরং উলটোটাই হয়। সব ভণ্ড। কি সমাজ, কি রাষ্ট্র, কি সমাজসেবী সংগঠক সবাই আমাদের মঙ্গলের নামে নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে আমাদের টিকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র রচনা করে যাচ্ছে। মস্তানদের মাস্তানি, পুলিশের বাড়াবাড়ি, দালালের রমরমা, আড়কাঠির সক্রিয়তা, শরীরের অন্য অংশ সহ যোনিদেশে সিগারেটের ছ্যাঁকা, কামড়ে রক্তাক্ত করা, যোনিমুখে মদের বোতল বসিয়ে সজোরে লাথি মেরে পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার আতঙ্ক, যোনির ভেতর লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে দেওয়ার আতঙ্ক, পাড়ায় মেয়ে কেনাবেচা, নতুন নতুন মেয়েদের এ লাইনে নিয়ে আসা, সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস -- সব আগের মতোই আছে, যেমন ছিল। যেটা হয়েছে, সেটা হল এলাকায় প্রচুর কন্ডোম বিক্রি বেড়েছে। আর ফি-বছর একটি মেলার আয়োজন হচ্ছে, যা যৌনকর্মী মেলা”।
পরিণতি ? শেষপর্যন্ত এই দুর্দশাগ্রস্ত বেশ্যাদের পরিণতি কী ? দুটি পরিণতি – (১) গেরস্ত হওয়া এবং (২) হাফ-গেরস্ত হওয়া। গেরস্ত হওয়া মানে যদি কোনো বাঁধা ‘বাবু’, সে মজুর-দালাল-পাতি চাকুরে-ব্যাবসায়ী যাই হোক – ধরে তাকে দিয়ে কপালে সিঁদুর পরিয়ে কোথাও সত্যিকারের ঘর বসানো যায়।অপরদিকে হাফ-গেরস্ত মানে অন্তত কোনো বাঁধা ‘বাবু’ পাওয়া, যে তাকে বিপদে-আপদে দেখবে, হয়তো দু-পয়সা মূলধন দিয়ে সাহায্য করবে যাত কিনা সে কালে কালে বাড়িউলি হয়ে উঠতে পারে। এই তাঁর পেশায় একমাত্র উত্তরণ। এই দুয়ের মধ্যে কিছুই না হলে ক্রমে ওই পল্লিতেই ঝি-গিরি করতে হয়, নয়তো পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হয়। যদি দেশ-গাঁ ঘর আত্মীয় বলে কিছু থাকে তো সেখানে বেঁচে থাকার অন্তিম ঠাঁই খুঁজে নিতে হয়।
যে সমস্ত পুরুষরা ওই পাড়ায় থাকে তাঁরা অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত, বেকার, বেশ্যাদের উপার্জনের নির্লজ্জ পরজীবী।ওইসব নিকম্মা গুলিখোর পুরুষরাই ওদের মানে বেশ্যাদের প্রহার করে, অত্যাচার করে। সংগঠনের পদ দখল করে, মতামত দেয়। এইসব পুরুষপুঙ্গবদের হাত থেকে, দালালদের হাত থেকে, মাসিদের হাত থেকে অত্যাচারিত মেয়েদের রক্ষা করতে পারবে কারা ? সংগঠন ? সংগঠনের কর্মসূচিতে মিশে গেছে অত্যাচারী যাঁরা ? দুর্ভাগা বেশ্যাদের কথা কে বলবে কারা ? সংগঠন ? ওদের কণ্ঠ কারা ? সংগঠক ও স্বেচ্ছাসেবীরা, যাঁরা মৌচাকে রানি-মৌমাছি হয়ে বসে চূড়ায় ? সংগঠনের অফিস আছে, অফিসে মোটা বেতনের চাকুরে আছে, সংগঠনের প্রেস আছে, সভা-সমিতি আছে। সংগঠনের রাজনীতি আছে। পাড়া কোন্ রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত থাকবে তা নিয়ে নিত্য লড়াই-সংঘর্ষ আছে।
গড়পড়তা একটা মেয়েকে প্রতিদিন কমবেশি চারবার যৌন সম্পর্ক করতে হয়।দিনের বা রাতের শেষতম খরিদ্দারটির জন্য যখন কোনো মেয়ে ‘বসছে’ তখন তথাকথিত সেই ‘যৌনসেবা’ দিতে শরীর কতটা প্রস্তুত।সপ্তাহে সাতদিন, মাসে তিরিশ দিন, বছরে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন মেয়েটির জীবন এভাবে চলতে থাকে। কখনো-বা পেটের জন্য অস্থায়ী আস্তানা গাড়তে হয় শহরের কোনো এক উপকণ্ঠে। বিচ্ছিন্ন প্রবাসী শ্রমিকদের বস্তির মধ্যে বেশ্যাপল্লি এখনও জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। কলকাতার মেয়েরা যেখানে ওভারটাইম খাটে। দিনে ৫০-১০০ শরীরের সঙ্গে মিলিত হতে হয়। বেশ্যাদের কাজ হল যথাযথ অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের যৌনসুখ দিয়ে তৃপ্ত করা। শুধু কি যৌনসুখ দেওয়া ! একজন পুরুষ যখন মূল্য দিয়ে একতাল মাংস ভাড়ায় নেয়, তখন সেই মাংস কেমনভাবে খাবে সেটা পুরুষটির উপরই নির্ভর করে।সে সঙ্গম করতে পারে, যৌন বিকৃতি চরিতার্থ করতে পারে, যৌনকর্মীকে প্রহার করতে পারে, ধর্ষকাম মেটাতে পারে, যোনিদেশে জ্বলন্ত সিগারেট দলে দিতে পারে।প্রতিটি বিক্রি হওয়াই তো মোটামুটি একইরকম যন্ত্রণাক্লিষ্ট – দেহে ও মনে দুই-ই।বেশ্যাপল্লির বেশ্যাদের যৌনকর্মী বা বেশ্যা যাই-ই বলা হোক-না-কেন “যৌন-ক্রীতদাস” বললেই এঁদের অবস্থানে অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছোনো যায়।সিটি কলেজের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘’যাঁদের দেহ বেঁচে খেতে হয়, তাঁদের ‘যৌনকর্মী’ বলে এই কুপ্রথাটিকে এক ধরনের অনুমোদন (স্যাংশান) দেওয়ায় আমার প্রবল আপত্তি আছে। পদ্মলোচন বললে কানার চোখ ফোটে না। দেহব্যাবসা শ্রেণিসমাজের বহু কলঙ্কের একটি ; শ্রেণিপূর্ব সমাজে এমন কোনো কুৎসিত পেশা ছিল না। জীবনধারণের কোনো উপায় না থাকলে তবেই মেয়েদের এই পথ বেছে নিতে হয় – তার কারণ বেছে নেওয়ার মতো আর কোনো বিকল্প তাঁদের থাকে না। এই পেশা বন্ধ করাই হবে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কাজ। যৌনকর্মী নাম দিয়ে, ট্রেড লাইসেন্স চালু করে যাঁরা এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তাঁরা আসলে শ্রেণিসমাজেরই পক্ষে : আরও বহুরকম শোষণের মতো এই শোষণেও তাঁদের কোনো আপত্তি নেই”।
যৌনকর্ম কি কোনো কর্ম ? তাহলে যৌনকর্মী কেন ? তার মানে তো যৌনকর্মের স্বীকৃতি ! বৈধতা দান ! তসলিমা নাসরিন বেশ্যাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে। বলেছেন – “পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতা প্রথা বৈধ সেই রাষ্ট্র সত্যিকার কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। কোনও সভ্যতা বা কোনও গণতন্ত্র মানুষের উপর নির্যাতনকে ছল-ছুতোয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়”।
যৌনকর্মী শব্দটি নতুন। এঁরা নিজেদেরকে কর্মী বলে মনে করে। বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে একটা সামাজিক ঘৃণা যুক্ত আছে বলে সমাজের অনেক পতিরা মনে করেন। যৌনকর্মী শব্দটির মধ্যে সামাজিক মর্যাদা বা পেশাকে সম্মান দেওয়ার অভিব্যক্তি আছে বলে ধারণা। কিন্তু আমার তেমন মনে হয় না। আর-একটি নতুন বিশেষণ বা নাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। বেশ্যা আর যৌনকর্মী শব্দটির মধ্যে মর্যাদাগতভাবে কোনো ফারাক নেই। দুটো শব্দই সমান ঘৃণার। তসলিমার সুরে সুর মিলিয়ে বলল, “নিজেদের যতই শ্রমিক বলে দাবি করুক, সমাজ জানে এঁরা বেশ্যার কাজই করছে। তকমা বদলালেই কি পরিবর্তন ঘটে যাবে ? মেথরের কাজকে জাতিভেদাশ্রিত সমাজ শ্রদ্ধার চোখে না দেখলেও সেটা শ্রমিকের কাজ। কিন্তু বেশ্যাবৃত্তির কখনও এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে না”। একটা শ্রেণির নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটির উদ্ভব। সেটি হল আইনি স্বীকৃতি। পেশার বৈধতা।বিপন্ন যৌনকর্মীদের সুরক্ষিত রাখতেই আইনি বৈধতা প্রয়োজন বইকি।আইনি স্বীকৃতি দিলেই যে সব মহিলারা দলে দলে এই বৃত্তিতে অশংগ্রহণ করবেন, এটা যেমন ঠিক ভাবনা নয় – ঠিক তেমনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলারা বুক চিতিয়ে “গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই” বলবেন এটাও সহ্য করা যায় না। যে পথেই হোক, যৌনবৃত্তিকে নিয়ে কখনোই আহ্লাদিত হওয়ার নয়।কারণ কোনো অপরাধেই অজুহাত আইনগ্রাহ্য হতে পারে না। ‘খাইতে পারিলে কে চুরি করে’ বললে কারোর চুরির করার অধিকার জন্মায় না, চৌর্যবৃত্তিও বৈধতা পায় না। পেটের জ্বালায় বেশ্যাবৃত্তি করাকে যদি সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে হয়, তাহলে তো কোনো অপরাধকেই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে শাস্তি দেওয়া যায় না ! মানুষ তো পেটের জ্বালা মেটাতেই চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি করেন, তাই না ? যৌনব্যাবসাকে আইনি বৈধতা দিতে হলে তো চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির মতো ঘটনাগুলিকেও বৈধতা দিতে হয়। যৌনব্যাবসাকে আইনি বৈধতা নয়, বরং তাঁদের নাগরিক অধিকার বা মানুষের মতো বাঁচার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার আন্দোলন হোক।সেইসঙ্গে আড়কাঠি, দালাল, মেয়ে পাচারকারী এবং মাস্তানবাহিনীদের দৃষ্টান্তমূলক বা যাবজ্জীবনের সাজা দেওয়ার দাবি জানাতে হবে। কারণ যাঁরা মেয়েদের ধরে এনে বেশ্যাবৃত্তিতে ঠেলে দেয়, তাঁরা আসলে একটি মানবাধিকারকে হত্যা করে।এইসব হত্যাকারীদের চরম শাস্তি নির্দিষ্ট করা উচিত।তসলিমা নাসরিন অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “যতদিন পুরুষতন্ত্র থাকবে ততদিন এ পেশা থাকবে। কিন্তু আমরা পুরুষতন্ত্রকে আর বেশিদিন টিঁকে থাকতে দেব না”।তসলিমা, যাঁরা বলছেন “এটা আর পাঁচটা পেশার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসেবা। আপনার প্রাত্যহিক প্রয়োজনে বাজার থেকে চাল কিনে খেতে যদি আপত্তি না-থাকে, তবে অর্থের বিনিময়ে যৌনতার কেনাবেচায় আপত্তি থাকবে কেন ? পৃথিবী থেকে বাজারের ধারণা যদি উঠে যায়. তাহলে এ পেশা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে” তাঁদের আপনি কী বলবেন ?
বেশ্যাবৃত্তিকে কি আইনি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ? কেন আইনি স্বীকৃতি সঙ্গত নয় ? আইনি স্বীকৃতি নয়, এর সপক্ষে দশটি যুক্তিও পাওয়া যায়। যেমন—(১) বেশ্যাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি আসলে আড়কাঠি, দালাল ও যৌন-ব্যাবসার কাছে এক উপহারস্বরূপ। এই ছাড়পত্রের সুবাদে পতিতালয়, সেক্স ক্লাব, ম্যাসেজ পার্লার, মধুচক্র, যৌনঠেক – সবই বৈধতা পেয়ে যাবে। (২) বেশ্যাবৃত্তির বৈধতাদান বা নিরপরাধীকরণের অর্থ নারী-পাচারকে উৎসাহিত করা।(৩) যৌনপেশার আইনি বৈধতা বা নিরপরাধীকরণ বেশ্যাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে না, বরং তাকে বাড়িয়ে দেয়।(৪) বেশ্যাবৃত্তি আইনি বৈধতা গোপন, বে-আইনি, খোলা রাস্তায় বেশ্যাবৃত্তি বাড়িয়ে দেয়। (৫) বেশ্যাবৃত্তির স্বীকৃতি দান ও নিরপরাধীকরণ যৌনশিল্পে নাবালিকাদের অনুপ্রবেশ বাড়িয়ে দেবে। (৬) বেশ্যাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি যৌনপেশার নারীদের নিরাপত্তা দেয় না। (৭) বেশ্যাবৃত্তির স্বীকৃতি ও নিরপরাধীকরণের ছাড়পত্র যৌন-ব্যাবসার চাহিদা বাড়িয়ে দেবে, এই আইনি প্রশ্রয় পুরুষকে আরও নারীদেহ ক্রয়ে আকৃষ্ট করবে। (৮) আইনি মেয়েদেয় যৌনপেশার স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষা দেয় না। (৯) আইনি স্বীকৃতি বা নিরপরাধীকরণ বলবৎ হলেও যৌনপেশার নারীদের চাহিদা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য বাড়ে না। (১০) বেশ্যাবৃত্তি-ব্যবস্থার ভিতরকার মেয়েরা চায় না এই পেশা আইনি স্বীকৃতি পাক। কারণ বেশ্যাপল্লির এমন একটা মহিলাকে পাওয়া যায়নি, যে চায় তাঁর সন্তান-আত্মীয়-বন্ধুদের কেউ এই পেশায় অর্থোপার্জন করুক।
দেহব্যাবসায়ীদের কি ‘যৌনকর্মী’ বলা যায় ? দেহোপজীবিনীরা কি শ্রমিক ? কী বলছেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী অশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ? –- “চরম দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যে সমস্ত মেয়েগুলোকে ধরে এনে দেহব্যাবসা করানো হচ্ছে, তাঁদের পুনর্বাসনের না করে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আরও জাঁকিয়ে ব্যাবসা করার দাবি জানানো হচ্ছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে ? যৌনকর্মীরা চাইছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, ভাবা যায় ! আরে বাবা, ব্যাবসা হল সাধারণত দু-রকম । এক, সুস্থ ও আইনি ব্যবসা । দুই, অসুস্থ ও বে-আইনি ব্যাবসা। এখন যে ব্যাবসাটা আপাদমস্তক অসুস্থ ও বে-আইনি, তার আবার ট্রেড ইউনিয়ন কীসের, আমার মাথায় তো কিস্যু ঢুকছে না। আর এই দাবির পিছনে যুক্তিটা কি, না আইনের অধিকার পেলে যৌনকর্মীদের ব্যাবসা করতে আরও সুবিধে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই ব্যাবসা চালাতে আজও কি আইন তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছে ? দেয়নি। সুতরাং যে পেশা বা ব্যাবসার কোনো আইনি ভিত্তিই নেই, সে ব্যাবসার আবার পরবর্তী সুযোগসুবিধা নিয়ে ভেবে কী লাভ ? আজ যৌনকর্মীরা তাদের শ্রমিক বলে দাবি করছে। তাঁদের গতর খাটানোর সঙ্গে শ্রমিকের গতর খাটানোর তুলনা করছে।খুব নিষ্ঠুর অর্থে তাঁদের এবং শ্রমিকের গতর খাটানোর এই তুলনাটা মেনে নিলেও, জানতে ইচ্ছে করে একজন যৌনকর্মীর পক্ষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একজন শ্রমিকের মতো উৎপাদন করা সম্ভব ? সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রতি একজন শ্রমিকের যে দায়বদ্ধতা, একজন যৌনকর্মীরও কি সেই সমান দায়বদ্ধতা রয়েছে ! নিশ্চয় নয়। যদিও তাঁদের বক্তব্য, যৌনকর্মী না-থাকলে আজ ঘরে ঘরে এই দেহব্যাবসা হত, যে ব্যাবসা বন্ধ করেই নাকি সোনাগাছি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাটের মতো যৌনপল্লির প্রয়োজন। এটা একেবারেই অযৌক্তিক কথা।যেমন অযৌক্তিক তাদের এই দাবি। আরে বাবা, আইনের স্বীকৃতি পেলেই কি মানুষের মানসিকতা, সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ পালটে যাবে ? এটা কখনো হয় নাকি ? শের শাহের আমলেও তো নিয়ম ছিল চুরি করলে হাত কাটা যাবে, তা বলে কি চুরি থেমে থেকেছে ? সুতরাং আইনি স্বীকৃতি পেলেই যৌনকর্মীরা শ্রমিকের সঃবীকৃতি পেয়ে যাবে, সমাজের স্বীকৃতি পেয়ে যাবে, এমন চিন্তাভাবনার কোনো কারণ নেই”।
অশোকবাবুকে অনেকে রক্ষণশীল বলতেই পারেন। তাঁর সঙ্গে কেউ একমত হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। তবে আমি বলি কী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটি বড়ো শহরের সবকটি বড়ো বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে শহরে যেরকম দুর্যোগ নামবে, এটিকেও সেভাবেই দেখা দরকার। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এক পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতার তৎকালীন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট গোটা কলকাতা শহরে ৪০৪৯টি বেশ্যাঘর আছে বলে স্বীকার করেন, যাতে বাস করছিলেন মোট ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। অর্থাৎ গৃহপ্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ জনেরও বেশি। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেভার-টোনার যৌনকর্মীর সংখ্যা ৩০,০০০ জন নির্ধারণ করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আদশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪২৭১ জনে। ১৯২১ এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে উল্লিখিত সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০,৮১৪ এবং ৭,৯৭০ জনে। কিন্তু ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের সভানেত্রী দাবি করেন যে পুলিশের হিসেবে কলকাতার যৌনকর্মীর সংখ্যা ২০,০০০ জন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের পরে অনেক দিন বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। বিশ্বায়নের থাবায় দিকে দিকে দারিদ্র্য আরো বেড়েছে, বেড়েছে পাচার, বেড়েছে উন্মত্ততা। ফলে বর্তমানে কলকাতা শহরে যৌনকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে বৈ তো নয়। দেবাশিস বসুর দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের মহামারীতত্ত্ব বিভাগ যে জরিপ চালায় তাতে কলকাতা ও হাওড়া শহরে মোট ১৯টি যৌনপল্লি চিহ্নিত হয়। প্রতিটি পল্লিতে যদি গড়ে ২০০ করে গৃহও ধরা হয়, তাহলে মোট গৃহ দাঁড়ায় ৩৮০০টি, এবং গৃহপ্রতি ৩ জন করে ধরলে যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১,৪০০ জন। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা যদি ৮,৬০০ ধরা হয় তবে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২০,০০০ জনে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হিসেবটা ঠিক এরকমই। তাদের মতে, কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে বেশ্যাপাড়ানির্ভর ১২,০০০ জন এবং ফ্লটিং ৮,০০০ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই অঙ্কে আবাসিক হোটেল এবং ফ্লাটবাড়িভিত্তিক যৌনকর্মীদের চিত্রটি নেই। এই ভাগে আরো ২০,০০০ জন থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এটি ধরা হলে কলকাতা শহরে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০,০০০ জনে। আমরা অন্য দেশের একটি শহরের হিসেবটি এত নিখুঁতভাবে দেখতে চেষ্টা করছি এ কারণে যে এখানকার যৌনকর্মীদের একটি বড়ো অংশই বাংলাদেশের নারী ও শিশু। রয়টারের একটি সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৩০ হাজার মেয়েশিশু আছে কলকাতার বিভিন্ন পতিতালয়ে এবং ১০ হাজার আছে মুম্বাই এবং গোয়ার পতিতালয়ে। এসব নারী ও মেয়েশিশুর সবাই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছেন। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২০০,০০০ নারী পাচার হয়েছেন। এছাড়া এসময়ে মোট ৬০০০ মেয়েশিশু পাচার বা অপহৃত হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে। ইন্টার প্রেস সার্ভিস (৮ এপ্রিল ১৯৯৮) সূত্রে জানা যায়, পাচারকৃত এই দু-লক্ষ নারীর সবাই ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। একটি বিদেশী সংস্থার বাংলাদেশ সম্পর্কিত কান্ট্রি নেরেটিভ পেপারের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈধভাবে যেসব নারী গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করবার জন্য কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে যান, প্রায়শ তাঁদেরও অনিচ্ছাকৃত যৌনদাসত্বকে মেনে নিতে হয়। ওই পেপারের মতে, বার্মিজ মেয়েদের পাচারের রুট হিসেবেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে।বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছে দুর্জয় মহিলা সমন্বয় কমিটি।
যৌনকর্মীদের জাতীয় আন্দোলন : দুর্বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের অন্যান্য কিছু এলাকার যৌনকর্মীরাও তাঁদের নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -- পঞ্চম (বিহার), সাভেরা (দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার) , সেক্স ওয়ার্কার্স ফোরাম (কেরল), বেশ্যা এইডস মোকাবিলা পরিষদ (মহারাষ্ট্র) এবং উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ (তিরুপতি)।
ভারতে যৌনপেশা সম্পর্কীত এখন যে আইন চালু আছে (ইম্মরাল ট্র্যাফিক প্রিভেন্শন অ্যাক্ট, ১৯৫৬), তার সংশোধনের জন্য ভারত সরকার সম্প্রতি যে প্রস্তাবের খসরা তৈরি করেছে, তার প্রতিবাদের দুর্বার এবং উপরোক্ত সংস্থার প্রায় ৪০০০ যৌনকর্মী প্রতিনিধি দিল্লিতে গত ৩ থেকে ৮ মার্চ সমবেত হন এবং সভা-সমিতি, র্যা লি , পথনাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেন। সবচেয়ে বেশি আপত্তি হল এই সংশোধনী প্রস্তাবের একটি ধারা সম্বন্ধে যাতে যৌনকর্মীর খরিদ্দারদের আইনত অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেওয়া হবে। ৮ মার্চ তাঁরা একটি শোভাযাত্রা করে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। সেটাতে তাঁরা এই সংশোধনী প্রস্তাবটি বিলোপ করা ও পিটা আইনের কিছু ধারার সংশোধন করার জন্য আবেদন করেন। ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীদের পক্ষে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের নানাবিধ অধিকারের দাবি করা এবং ইতিমধ্যে অতি অল্প হলেও তার কিছুটা আদায় করা তাঁদের নিজেদের কাছে বা অন্যদের কাছেও ১৫ বছর আগে প্রায় স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে যৌনকর্মীরা বেশ কয়েক বছর হল তাঁদের নিজেদের কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করতে পেরেছেন। কিন্তু এইসব যৌনকর্মীরা ভারতের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের মতো এত দরিদ্র, এত নির্যাতিত ও এত অসহায় কখনোই ছিলেন না। ভারতের যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হিসেবে গণ্য হবে।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি : এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্যে সোনাগাছির পিয়ার এডুকেটররা, প্রকল্পের ডাক্তার, সমাজসেবিকা ইত্যাদির সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন যে, ওখানকার যৌনকর্মীদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে এবং তাঁদের খরিদ্দারদের কাছে দলবদ্ধভাবে কন্ডোম ব্যবহারের দাবি করতে হবে। পিয়ার এডুকেটরদের উদ্যোগে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি নামে যৌনকর্মীদের একটি সংস্থা তৈরি হল। এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করা হল যে, যৌনকর্মকে একটি ন্যায্য পেশার স্বীকৃতির দাবি করা, সাধারণ নাগরিকদের যেসব ন্যুনতম অধিকার আছে যৌনকর্মীদের পক্ষ থেকে সেসব অধিকার দাবি করা এবং এইসব অধিকার আদায় করার জন্য সঙঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যাওয়া। প্রথম লড়াই শুরু হল খরিদ্দারদের সঙ্গে যাতে তাঁরা যৌন সংসর্গে কন্ডোম ব্যবহার করেন। খরিদ্দাররা যখন দেখলেন যে কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক বলে কোনও যৌনকর্মীর কাছে প্রত্যাখ্যত হলে আশেপাশের সব যৌনকর্মীর কাছ থেকেই তিনি একই কারণে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন -- বেশি টাকা দিতে চাইলেও, তখন তাঁরা কন্ডোম ব্যবহার করতে রাজি হতে থাকলেন। এর ফলে সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার বেশ দ্রুত হারে বাড়তে থাকল এবং তাঁদের যৌনরোগের সংক্রমণ কমতে থাকল। এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যাও ভারতের অন্যান্য জায়গার যৌনকর্মীদের মধ্যে যতটা বাড়তে থাকল, সোনাগাছিতে ততটা বাড়ল না। ২০০৬ সালে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের অনুপাত শতকরা ৬-এর মত, কিন্তু মুম্বাইয়ের কামাতিপুর এলাকায় শতকরা ৫০-এর বেশি এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক জায়গায় শতকরা ৩০-এর বেশি। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের অনুপাত অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ হল তাঁদের খদ্দেরদের কন্ডোম ব্যবহার করতে রাজি বা বাধ্য করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে বলে। দুর্বারের নানাবিধ কার্যক্রম মাধ্যমে তাঁরা জীবনের অন্যান্য আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও ক্ষমতায়নের দিকে এগিয়েছেন। এর একটা প্রধান উদাহরণ হল উষা কো-অপারেটিভ নামে নিজেদের একটি সমবায় সংস্থার সৃষ্টি করে স্থানীয় সুদখোর কুসিদজীবীদের শোষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া। যৌনকর্মীদের অনেকেই দৈনিক রোজগার থেকে কিছু টাকা এই সংস্থায় জমা রাখেন এবং অসুখ-বিসুখ বা অন্য কারণে বাড়তি টাকার দরকার হলে এই সংস্থা থেকে অল্প সুদে টাকা ধার করতে পারেন। উষা কো-অপরেটিভের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০০ এবং সারা বছরে এর মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
যৌনকর্মীদের এবং যৌনপেশাকে নির্মূল করা-না-করার প্রশ্নে, পুনর্বাসন প্রশ্নে, নৈতিকতা প্রশ্নে, ধর্মীয় প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে নানারকম তর্ক-বিতর্ক আমরা শুনে থাকি। অর্থশাস্ত্র মতে, বাজারে যদি কোনো পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে সে পণ্যের উৎপাদন রহিত করা যায় না। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে তার উৎপাদন চলতেই থাকে। যৌনপণ্যের বাজারচাহিদা কমানো না-গেলে চিহ্নিত “রেড লাইট এরিয়া”-গুলিকে তছনছ করে দিলেও অন্য কোনো ছদ্ম-আবরণে এ ব্যাবসা চলতেই থাকবে। তাতে মাত্র একদল যাবে, একদল আসবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
কিন্তু লক্ষণীয় যে বেশ্যাবৃত্তি টিকিয়ে রাখার পক্ষে দেওয়া সর্বকালের সকল মতই হল পুরুষদের। কারণ এ প্রথার ভোক্তা পুরুষরাই। প্রত্যক্ষভাবে নারীনেত্রীদের বেশ্যাবৃত্তির পক্ষে সাধারণত মত দিতে দেখা যায় না। নারীরা এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত -- এক ভাগের নেত্রীরা বেশ্যাবৃত্তিকে সম্পূর্ণভাবে যৌন-নির্যাতন বা ধর্ষণ হিসাবে দেখেন। তাঁরাই চান এ ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হোক। এ সকল নারীনেত্রীদের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে সুইডেনে একটি আইনও তৈরি হয়ে গেল। সেখানে বলা হল -- যৌনতা বিক্রি কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু যৌনতা ক্রয় অবশ্যই অপরাধ। এই আইন যৌনসেবা ক্রয়ে ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে । আর ক্রেতা যখন থাকবে না তখন এটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। অন্য পক্ষের নারীগণ মনে করেন -- পতিতাদের অধিকার, নিজস্ব ইচ্ছা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে দেখেন। তাঁরা পতিতাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, যথার্থে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করে পতিতালয় উচ্ছেদের বিরোধিতা করেন এবং এই পেশাকে কর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বলেন। দেহব্যবসায়ে নিয়োজিতদের পতিতা, বেশ্যা, গণিকা, খারাপ মেয়েছেলে ইত্যাদি না-বলে যৌনকর্মী এবং তাদের কর্মকে যৌনকর্ম বলার পক্ষে পৃথিবীব্যাপী তাদের আন্দোলনও জারি করা আছে।এরা জার্মানিতে আইন সংস্কারের জন্য চেষ্টা করার ফলে গত ২০০২ সালে সে দেশে যৌনকর্ম একটি নিয়মিত পেশা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও ওই আইনে যৌনকর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত করেছে। সারা পৃথিবীতেই এই দাবিতে আন্দোলন সচল আছে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এবং বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘও এরকম দাবিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছেন।প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে স্বেছায় যুক্ত হয়েছেন বা পাকেচক্রে শরীরের ব্যাবসায় যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন বা কিনছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার পৌর-কর্তৃপক্ষ ১৯৯২ সালে শহরের যৌন-বিনোদন কেন্দ্রগুলি ভেঙে দেওয়ার পর সেখানকার যৌনকর্মীরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে ওদেশে বিভিন্ন ধরনের যৌনরোগ ও এইচআইভির সংক্রমণ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।
সত্যিকারেই বেশ্যাবৃত্তি নিশ্চয় সমাজ থেকে নির্মূল করা যাবে না। কেন-না সমলিঙ্গ কিংবা ভিন্ন লিঙ্গের সঙ্গে সহবাস করে বহু প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছায় প্রচুর অর্থ ও সম্পদ অর্জন করে থাকে। এ ধরনের নারী-পুরুষের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে নেহাত কম নেই। আসলে প্রতিটি নারীপুরুষনির্বিশেষে মানুষের ভিতর বহুগামিতা কমবেশি থাকে। নানা সামাজিক অবস্থানের কারণে কারোর এই জীবনযাপন প্রকটিত হয়, কারোর-বা প্রচ্ছন্নই থেকে যায়। আমার মনে করি না যেসব প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী একাধিক নরনারীর যৌনমিলন করে রোজগার করে তারা নিষিদ্ধ হোক। তা কোনোদিনই সম্ভব নয়। কঠোর আইন করেও সম্ভব নয়। কিন্তু যেসব মেয়েরা নানা ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে বেশ্যাপল্লির অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।কীভাবে ? প্রথমত, দেশের সমস্ত অনিচ্ছাকৃত প্রতিটি বেশ্যাদের বেশ্যাপল্লি থেকে বাইরে বের করে এনে বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত করে পুনর্বাসন দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রস কোয়ার্টারের বা বেশ্যাবাড়ির বাড়িওয়ালিদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করতে হবে এবং পাড়াগুলি বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।তৃতীয়ত, মেয়ে-পাচারকারীদের সনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। চতুর্থত, ভবিষ্যতে যদি কেউ কোনো মেয়েকে প্ররোচনা দিয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করলে লাইফার অথবা মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তির বিধান রাখবে হবে।বেশ্যামুক্ত একটা দেশ হয়তো উপহার দেওয়া যাবে না, কিন্ত যৌন-ক্রীতদাস নির্মূল সম্ভব।পেশা নির্বাচনের অধিকার সকলকেই রাষ্ট্র দিয়েছে।জবরদস্তি কোনো পেশায় কারোকে ঠেলা দেওয়া মানে মানবাধিকারেরই লঙ্ঘন।যেসব মেয়েদের নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয় কেউ, তখন সেই সংশ্লিষ্ট মেয়েটির মৃত্যুরই সামিল হয়।
যাঁরা বেশ্যাদের নিয়ে বেশ্যাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করছেন বলে দাবি করছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই চাইছেন বেশ্যিবৃত্তিকে ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করতে। সামনে ফেস্টুন টাঙিয়ে যৌনকর্মীর অশ্রুপাত করছেন, পিছনে পিছনে এই বৃত্তিকে পাকাপোক্ত করে তোলার বন্দোবস্ত করে যাচ্ছে। এনজিও চালানোর নামে বিদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার আসছে, আর হরির লুটের বাতাসা হচ্ছে।পতিতাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তিকে রোধ করতে হলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আসলে বেশ্যারা মানুষ। আর মানুষ বলেই তাঁরা তাঁদের মেয়েদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। মানুষ বলেই আশা আছে তাঁরা ‘যৌনকর্মী’ সংগঠনের নেতা-উপদেষ্টাদের ভেন্ট্রিলোকুইজমের পুতুল হয়ে অনন্তকাল থাকবে না। সেদিন এই মেয়েদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে থাকা পুলিশ-মস্তান-বাড়িওয়ালিদের মতোই এইসব ‘যৌনকর্মী’ সংগঠনের নেতৃত্বকে তাঁরা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলবে। সামাজিকভাবে সকলে মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আশা করা যায় বেশ্যাবৃত্তি বা বেশ্যালয়কে সমাজ থেকে ধ্বংস করা যাবে। লাস ভেগাস, ম্যাকাউয়ের বিখ্যাত বেশ্যালয়গুলি অতীত হয়ে যাক বললেই কী অতীত হয়ে যাবে ? স্বপ্ন দেখার অধিকার থাকলেও, আশা করার মতো এমন কোনো উপাদানই আমি দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু, সংসার চলবে কীভাবে? কীভাবে-ই-বা তাঁরা বেঁচে থাকবেন? কেননা, তাঁরা কেউ-ই রোজগেরে নন৷ প্রেমের সম্পর্কের এক প্রকার পরিণতি হিসেবে তাঁরা বিয়ে করেছেন৷ কাজেই, জীবন এবং জীবিকার বিষয়টি তাঁদের কাছে তখন অন্যতম প্রশ্ন৷ শেষ পর্যন্ত, স্নাতক স্তরের দ্বিতীয় বর্ষে-ই তাঁরা চুকিয়ে দিলেন পড়াশোনার পাট৷ এবং, তাঁরা যোগাযোগ করলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে৷ কারণ, অন্য কোনও জীবিকা নয়৷ তাঁরা যৌনপেশায় অংশ নিতে চান৷
শেষ পর্যন্ত, দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সম্মতিতে, জীবিকা হিসেবে যৌনপেশাকে বেছে নেন ওই তরুণী৷ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ওই তরুণ এবং তরুণী রয়েছেন উত্তরবঙ্গের এক যৌনপল্লিতে৷ ওই তরুণী সেখানকার যৌনকর্মী৷ তবে, জীবন-জীবিকার টানে এ ভাবে ওই তরুণী উপার্জন করলেও, তাঁর ওই তরুণ স্বামী অবশ্য বেকার৷ দুই পরিবারের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগও নেই৷ এবং, জীবন-জীবিকার টানে ওই তরুণী শেষ পর্যন্ত যৌনপেশাকে বেছে নিলেও, তাঁরা উভয়েই তাঁদের পরিচয় গোপন রাখতে চান বলেও জানা গিয়েছে৷ শুধুমাত্র এমন ঘটনাও নয়৷
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক পড়ুয়া৷ তিনিও পড়াশোনার পাট চুকিয়ে, জীবন এবং জীবিকার টানে বেছে নিতে চান যৌনপেশাকে৷ কারণ, পরিবারের সঙ্গে ওই ছাত্রীর এমন অশান্তি হয়েছে যে, তার জেরে তিনি যোগাযোগ করেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে৷ তিনি যেমন আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ শেষ করতে চান না৷ তেমনই, তিনি আবার বাড়িতেও ফিরতে চান না৷ যে কারণে, জীবিকা হিসেবে যৌনপেশাকে বেছে নেওয়ার জন্য তিনি নাছোড়বান্দা৷ এবং, এই ঘটনাও কলকাতার৷ তবে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওই পড়ুয়াকে যৌনপেশায় অংশ নিতে হয়নি৷
কেননা, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া ওই তরুণীর কাছ থেকে গোটা বিষয়টি জানার পর, দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির তরফে যোগাযোগ করা হয় তাঁর বাবার সঙ্গে৷ ওই তরুণীর বাবার অনুরোধ অনুযায়ী, সোনাগাছিতে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির অফিসে বসিয়ে রাখা হয় তাঁকে৷ কারণ, তত সময়ে সেখানে পৌঁছতে চান ওই তরুণীর বাবা৷ এর পর, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওই পড়ুয়ার বাবা সেখানে পৌঁছলে, দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির তরফে তাঁকে দেখানো হয় ওই তরুণীর লিখিত আর্জি, জীবন-জীবিকার টানে কেন তিনি যৌনপেশায় অংশ নিতে চান৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওই তরুণীকে বোঝানো সম্ভব হয়৷ এবং, তার জেরেই, যৌনপেশায় অংশ না নিয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে তিনি বাড়িতে ফিরে যান৷ শুধুমাত্র যেমন এই দুই ঘটনাও নয়৷ তেমনই, এই দুই কাহিনি আবার বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনাও নয়৷
কেননা, আগেও যেমন এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে৷ তেমনই, এখনও এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম ওই সংগঠনকে৷ তবে, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের অন্যতম ফারাক, আগের তুলনায় এখন এই ধরনের অনেক বেশি ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে৷ কারণ, আগের তুলনায় এখন আরও অনেক বেশি সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত মহিলা বেছে নিতে চাইছেন যৌনপেশাকে৷ এবং, যৌনপেশায় অংশ গ্রহণের জন্য তাঁরা যোগাযোগ করছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে৷ ওই সংগঠনের সচিব ভারতী দে-র কথায়, ‘‘শুধুমাত্র যাদবপুরের বি.এ. সেকেন্ড ইয়ারের ওই দু’টি ছেলে-মেয়ে নয়৷ শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওই মেয়েটিও নয়৷ আগের তুলনায় আমরা এখন এই ধরনের অনেক বেশি ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি৷’’
একই সঙ্গে ভারতী দে বলেন, ‘‘যৌনপেশায় নামার জন্য প্রতি মাসে এখন ২০০ থেকে ২৫০ জন মেয়ে আমাদের সেল্ফ রেগুলেটরি বোর্ডের সম্মুখীন হচ্ছেন৷ প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক, দুই ধরনের মেয়েরাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন৷ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৯৬ শতাংশ মেয়ে নিজের ইচ্ছায় যৌনপেশায় নাম চাই ছেন৷ তবে, যৌনপেশায় নামার জন্য আমাদের সেল্ফ রেগুলেটরি বোর্ড কখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও মেয়েকে সম্মতি দেয় না৷’’ সেক্ষেত্রে কী হয়? কেননা, ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলারা তাঁদের ইচ্ছায় যৌনপেশায় অংশ নিতে চাইছেন৷ তা হলে, ওই সব অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলা কি তাঁদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেন? তাঁরা কি ফিরে যান তাঁদের বাড়িতে?
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সচিব বলেন, ‘‘যৌনকর্মী হওয়ার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা যখন আমাদের সেল্ফ রেগুলেটরি বোর্ডের সম্মুখীন হয়, সেই সময় আমাদের বক্তব্য জানার পরে তাদের অনেকে এমন কথা বলে যে, আমরা তাকে সুযোগ দিচ্ছি না তো কী হয়েছে, অন্য কোনও যৌনপল্লিতে সে যাবে৷ সেখানে সে যৌনপেশায় নামার সুযোগ পাবে৷ এ ক্ষেত্রে সেভাবে আমাদের করার কিছু থাকে না৷ কারণ, পশ্চিমবঙ্গের সব যৌনপল্লিতে এখনও আমরা পৌঁছতে পারিনি৷ দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির অধীনে যে সব যৌনপল্লি রয়েছে, সেই সব জায়গায় কোনও মতেই কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে যৌনপেশার জন্য সম্মতি দেবে না আমাদের সেল্ফ রেগুলেটরি বোর্ড৷’’ বহু অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলা যেভাবে নিজের ইচ্ছায় যৌনপেশায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে, তার পিছনে অন্যতম কারণগুলির মধ্যে দারিদ্র এবং বাড়িতে অশান্তির মতো বিষয় রয়েছে বলেও জানান তিনি৷
যদিও, যৌনপেশায় অংশ গ্রহণের জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্রী অথবা উচ্চ শিক্ষিত কোনও তরুণী যে শুধুমাত্র দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে-ই যোগাযোগ করছেন, তাও নয়৷ এসকর্ট সার্ভিস সহ অন্য নানা উপায়ে তাঁরা যৌনপেশায় অংশ নিচ্ছেন৷ কখনও যেমন অর্থের প্রয়োজনে অথবা অতিরিক্ত অর্থের কারণে৷ তেমনই, কখনও আবার নিছক-ই যৌনসুখ উপভোগের কারণে তাঁরা যৌনপেশায় অংশ নিচ্ছেন৷ তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অভিজাত শ্রেণির-ও চাকুরিজীবী মহিলা অথবা গৃহবধূ৷ তেমনই, শুধুমাত্র আবার মহিলারাও নন৷ যৌনপেশায় অংশ নিচ্ছেন পুরুষরাও৷ এবং, কলকাতায়-ও, এ ভাবে বিভিন্ন উপায়ে যৌনপেশায় অংশগ্রহণের হারও আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে৷
কিন্তু, যৌনপেশায় অংশ নেওয়ার জন্য আগের তুলনায় আরও বেশি সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত মহিলারা কেন যোগাযোগ করছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে? ভারতী দে বলেন, ‘‘অনেক সময় প্রেমের সম্পর্কে কোনও মেয়ে ফেঁসে যায়৷ অনেক সময় প্রেম করে বিয়ে করার পরে কিছু আর করার থাকে না৷ যেমন যাদবপুরের ওই দু’জন৷ যৌনকর্মী হিসেবে মেয়েটি উপার্জন করছে৷ অথচ, ছেলেটি কোনও উপার্জন করছে না৷ ওই মেয়েটির উপার্জনেই ছেলেটি চলছে৷ কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক সময় ওই ধরনের কোনও মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে, অন্য কোনও মেয়েকে নিয়ে থাকছে ওই ধরনের কোনও ছেলে৷ আর, এ ভাবেও কলকাতার সোনাগাছি সহ এই শহর এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন যৌনপল্লিতে এখন যৌনকর্মী হিসেবে পরিচয় বহন করে চলেছেন উচ্চশিক্ষিত বহু মহিলা৷
যেসব মেয়েরা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে দেহ বিক্রি করে সমাজ
তাঁদের বলে পতিতা ।
অপরদিকে,
যেসব মেয়েরা হাজার টাকার বিনিময়ে লুকিয়ে দেহ বিক্রি করে সমাজ তাদের বলে সোসাইটি গার্ল । যারা আর একটু বেশী দামে দেহ
বিক্রি করে সমাজ তাদের বলে পার্টি গার্ল । আর সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে তথাকথিত শিক্ষিত মেয়েরা যখন রাস্তা দিয়ে দেহ দেখিয়ে- দেখিয়ে হাঁটে I বয়ফ্রেন্ডের কোলে বসে আড্ডা দেয়,
মাঝে মাঝে ** খায়, কিস খায় এবং মাঝে মাঝে সেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে লিটনের ফ্ল্যাটে যায়, পয়লা বৈশাখে লাল- সাদা শাড়ী পড়ে হাজারটা ছেলের
সাথে ডলাডলি করে, পান্তা খায়, আর রিক্সায় হুড তুলে দিয়ে ** , আবার
বলে আমরা শুধুই ফ্রেন্ড !
সমাজ তখন তাঁদের বলে আধুনিক মেয়ে ! যারা আরও বেশী দামে দেহ বিক্রি করে সমাজ তাদের বলে মডেল গার্ল বা অভিনেত্রী (সব মডেল বা অভিনেত্রীকে বলছি না) । সমাজের অনেকের চোখে এরা আবার ড্রিমগার্ল ! তাদের আবার ভিডিও বের হয় ।
কিন্তু তারপরও তারা সমাজে সকলের নিকট সম্মানপ্রাপ্ত । অথচ দেহ
ব্যবসায় যারা শুধুমাত্র পেটের দায় করে বা জোরপূর্বক তাদের করানো হয়,
তারাই বেশ্যা বলে আখ্যায়িত ।
কিন্তু
কেন ?
তাঁদের এত টাকা-পয়সা, পাওয়ার নেই বলে ?
থুতু মারি চুশীলদের এই দ্বৈত নীতিকে ।
যারা পেটের দায়ে এই ঘৃণ্য কাজটি করে তাঁদেরকে আমি পতিতা বলি
না, আমি পতিতা বলি তাদেরকে যারা অর্থ বা কাজের লোভে পর পুরুষের
সামনে বিবস্ত্র হতে দ্বিতীয় বার ভাবে না ।
মানব জন্মের শুরু থেকেই মানুষকে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। সৃষ্টির বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য কাজ করে আসছে। কারণ জীবন ধারণের জন্য এই তিনটি উপাদান অপরিহার্য। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনো পুরুষ, কখনো নারী- সংসার নির্বাহের দায়িত্ব নিয়েছে। সংসার নির্বাহের জন্য, জীবন ধারণের জন্য সমাজের প্রথম থেকেই কৃষিকার্য, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। জীবন ধারণের জন্য আয়ের কয়েকটি নির্দিষ্ট পন্থা ভগবানহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এবং সমাজ কর্তৃক সাধারণভাবেও যা স্বীকৃত; তা আজও বর্তমান। যেমন কৃষিকাজ, ব্যবসা, শিল্প, শ্রম বিক্রি ইত্যাদি।
কিন্তু সমাজ বিবর্তনের একটি পর্যায়ে এসে নির্দিষ্টভাবে নারী দেহ বিক্রির মাধ্যমে আয়ের একটি ব্যবস্থা চালু হয়ে গেল। এর নাম পতিতাবৃত্তি বা ঘৃণিত। অথচ স্বীকৃত পেশা হিশেবে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। নব চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে জোরাল জিনিস হচ্ছে ক্ষুধা ও জৈবিক তাড়না। জৈবিক তাড়নার শক্তি আবার প্রচন্ড। বিভিন্ন পরিবেশে তা বাড়ে কমে। স্বাভাবিকভাবে, অর্থাৎ সমাজ স্বীকৃত পথে যখন মানুষ যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে পারে না, তখনই সে অবৈধ পথে তা মেটাবার চেষ্টা করে।
তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে, পুরুষ যখন যৌনক্ষুধা মেটাবার জন্য স্ত্রী ব্যতিরেকে যখন অবৈধভাবে অন্য নারীর সঙ্গে কামনা করে, অন্যদিকে নারী তার অন্ন-বস্ত্রের সংগ্রহের প্রয়োজনে তার দেহদান করতে প্রস্তুত হয়। তখনই একটা আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক একটা অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটা হল পতিতাবৃত্তির পেশাগত রূপ, তা সামাজিকভাবে ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে দোষণীয় হোক আর না হোক- এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু এর বাইরেও অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। সেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন থাকে না। নারী-পুরুষ দুজনেরই যৌন চাহিদার ফলে- এ ধরনের অবৈধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রকম ঘটনা পৃথিবীব্যাপী আমাদের আনাচে-কানাচে অহরহ ঘটছে। এটি অন্য ইস্যু। আমাদের আলচনা এ প্রসঙ্গে নয়। শুধু যৌন উত্তেজক কারণগুল আলচনা করতে গেলে এ প্রসঙ্গ কিছুটা হয়তো আসতে পারে। কেননা যৌন উত্তেজনার কারণেই এরা অবৈধ মিলনে উদ্যোগী হয়।
আমাদের আলচনা শুধু নারী দেহের ব্যবসা নিয়ে। পতিতাবৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুরুষ আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে নারীদেহ ভোগ করবে। সেখানে নারীর যৌন চাহিদার প্রশ্ন অবান্তর।
আমরা এবার দেখবো, সমাজের কোন স্তরে এই ব্যবস্থা পেশা হিসেবে চালু হয়েছিল।
পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন : বলা হয়ে থাকে, পতিতাবৃত্তি আদিম পেশা। আদিম বলতে কী বোঝায়? আদিম বলতে বোঝায়, হয় সহজাত অথবা সৃষ্টির শুরু থেকেই যা চলে আসছে। পতিতাবৃত্তি সহজাতও নয়, আদিমও নয়। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই পতিতাবৃত্তি পেশা চলে আসছে- এমন কোনো দলিল আমাদের হাতে নেই। বরং পরিপূর্ণ স্বীকৃত পেশা হিসেবে পতিতাবৃত্তি সমাজ বিবর্তনের বহু বহু পরে শুরু হয়েছে। সে ইতিহাস আমাদের হাতে আছে। এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটেনিকা। বলছে, ‘যৌনাচার সমাজে প্রচলিত ছিল- এমন সমাজ আদিতে দেখা যায় না।’
তবে প্রাচীন ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় অদ্ভুত অদ্ভুত সব সামাজিক রীতিনীতির কারণে মেয়েদের বহু ভোগ্যা হতে হতো। এগুল আমরা সংক্ষেপে আলচনা করব। পেশার আকারে এগুলকে সরাসরি পতিতাবৃত্তি বলা যাবে না, তবে এই ধরনের ব্যবস্থার ফলে অনেক মেয়ে পরবর্তীতে পরিত্যক্তা হয়ে দেহদান করে অর্থ আয় করত। এটাকেও সরাসরি সংগঠিত আকারের আধুনিক গণিকা ব্যবসার মতো বলা যাবে না। তা ছিল নিতান্ত অসংগঠিত ও বিক্ষিপ্ত এবং এরা ছিল সামাজিক কুপ্রথার স্বীকার। এ ব্যবস্থাটিও আদিম নয়।
আদিম কথাটাই আপেক্ষিক। আজকের তুলনায় বৃটিশ আমল আদিম, পুরনো, হাজার বছর পরে আমরা হয়ে যাব আদিম। সমাজ শুরু হবার পর থেকে, আরো পরিষ্কার করে বললে, মানুষ জন্মের শুরু থেকে কোনো অবস্থায়ই পতিতাবৃত্তি প্রচলিত ছিল না। এমনকি কোনো যৌনচায়ের কথাও জানা যায় না।
মানব জীবনের অস্তিত্ব ৭ লাখ বছর আগের বলে বৈজ্ঞানিকরা মনে করে থাকেন। কিন্তু সভ্যতার যাত্রা দেড় লাখ বছর আগের বলে জোরালভাবেই মনে করা হয়। ৭ লাখ বছর আগের কথা বাদ দিলেও, দেড় লাখ বছর আগে যে সভ্যতার শুরু, পতিতাবৃত্তি পেশার অস্তিত্ব এই দেড় লাখ বছর আগে যদি আবিষ্কার করা যায়, তবেই তাকে আমরা আদিম বলব। কিন্তু দেড় লাখ বছর আগের সভ্যতার বহু প্রমাণ পাওয়া গেলেও পতিতাবৃত্তির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
সভ্যতার যাত্রাপথে বহু বহু বছর পরে, ভারতে বৈদিক যুগে পতিতাবৃত্তি প্রচলিত ছিল বলে কোনো কোনো অনির্ভরযোগ্য প্রাচীন পুস্তকে জানা যায়। অবশ্য এ ধরনের পতিতাবৃত্তি বর্তমান যুগের মতো নয়। মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার ও খারাপ আচারের ফলেই এসব পতিতাবৃত্তির উদ্ভব ঘটত। বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগে পতিতাবৃত্তি আইনসম্মত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বলে জানা যায়। তৎকালীন ভারতীয় সমাজের নোংরা আচার ব্যবস্থার কারণে নারীজাতি নিপীড়িত, লাঞ্ছিত হতো, ভোগ করা হতো তাদের বিভিন্নভাবে, নানা নিয়ম-নিষ্ঠার ছদ্মাবরণে। অবশেষে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো রস নিংড়ানো ছোবড়ার মতো। অগত্যা বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া গতি থাকত এদের। এ রকম অত্যাচারের কাহিনী ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অনুসন্ধানী গ্রন্থে। সে অত্যাচার ও নারী নির্যাতনের ধরন ও প্রকৃতি বহু বিচিত্র। আমরা সে বিষয়ে কিছু আলকপাত করবে দেখব কিভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতিহাসের একটি পঙ্কিল অধ্যায়ে নারী তার দেহ বিক্রির ব্যবসায়ে নামতে বাধ্য হয়েছে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে-২ গণিকার উল্লেখ করা হয়েছে, রাজসভার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে। প্রধান গণিকাসহ বেশকিছু গণিকা নিয়োগ করা হতো, যারা রাজার বিভিন্ন সেবাযত্ন ও অঙ্কশায়িনী হবার জন্যে প্রস্তুত থাকত। রাজদরবারের গণিকা ছাড়াও মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগের কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথাটি ধর্মীয়ভিত্তিতে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথাটি ধর্মীয়ভিত্তিতে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করায় সুন্দরী যুবতীদের কেনাবেচা আইনানুগ হয়। তখন থেকেই সুযোগ সন্ধানীরা এই প্রথার সুযোগ নিয়ে ব্যাভিচার শুরু করে। দক্ষিণ ভারতে এই প্রথা এতো জনপ্রিয় ছিল যে, মোক্ষম ও অর্থ লাভের আশায় কেউ কেউ বাইরে থেকে মেরে কিনে এনে আবার কেউ বা নিজের কন্যাকে পর্যন্ত মন্দিরে উৎসর্গ করত। রাজকীয় পুরুষ ও মন্দিরের উচ্চশ্রেণীর পুরোহিতরা এই নারীদের ভোগ করত। এদের জন্য ভালবাসা বা বিয়ে করা ছিল মৃত্যুতুল্য অপরাধ। মন্দির থেকে একবার এরা বহিষ্কৃত হলে পতিতালয় ছাড়া এদের আর জায়গা হতো না। দেখা যাচ্ছে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বৈদিক যুগে ভারতে পতিতাদের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে।
আমরা কোষ গ্রন্থেও ‘জায়াজীব’ বলে একশ্রেণীর লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যে সমাজে পয়সার বিনিময়ে একজনের স্ত্রীকে অনেকে ভোগ করত। রামায়ণে আছে-৪ রাম বনবাসে যাবার সময় সীতা সঙ্গে যাবার জন্য জেদ ধরলেন। রাম অস্বীকার করলে সীতা বলনেন, ‘নর্ত্তরেরা যেমন তাদের স্ত্রীদের অন্যভোগ্যা করে, তুমিও আমাকে তাই করতে চাও?’
বাৎসায়নের কামসূত্রে-৫ চারণকবি সম্প্রদায়ের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, চারণদের স্ত্রীরা সহজলভ্যা ছিল। পৌরাণিক কাহিনী ও শাস্ত্রগুল থেকে আরো জানা যায়, রাজবাড়ীর উৎসবের দিন সিংহ দরজা খুলে দেয়া হতো। বহু রমনী আসত বিভিন্ন কাজে ও দেখতে। রাজা দূর থেকে দেখে যাকে পছন্দ করতেন দূতি মারফতে উপঢৌকনসহ তাকে রাজার শয্যাশায়িনী হবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো। স্বেচ্ছার না এলে জোর করে ধরে এনে পালঙ্কে ফেলা হতো-৬। রাজার দেখাদেখি আমাত্যবর্গের কাছে যে সকল রমণী কজে আসতে বাধ্য হতো, তারা এই সকল উচ্চারাজ কর্মচারীর যৌন সম্ভোগের শিকার হতো।
গ্রাম প্রধানের যুবক পুত্রেরা কৃষিকার্যে নিয়োজিত রমণীদের- তাদের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে মিলিত হতে বাধ্য করত তাদের পিতার পদমর্যাদার সুযোগ নিয়ে। কামসূত্রে আরো উল্লেখ আছে, বিধাতা, স্বামী পরিত্যাগ প্রসিতভার্তিকা, অক্ষমের স্ত্রী ও বাড়ির দাসীকে পুরুষরা বিভিন্নভাবে ফুঁসলিয়ে অথবা জোর করে ধর্ষণ করত। এসব যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে আইনও ছিল। বাৎসায়নের এই চিত্রের সঙ্গে আজকের দিনের একটুও তফাৎ নেই।
বৈদিকোত্তর যুগের চিত্র তুলে ধরেছেন এলভি যোশী।-৭ নৈনিতাল, আলমোড়া এবং গাড়োয়াল অঞ্চলে দেশীয় রাজদের অধীনে ‘নাইট’ নামে এক সম্প্রদায় ছিল। নাইকদের মেয়েরা ঘরের পুরুষদের ভরণ-পোষণের জন্য বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হতো। অর্থের বিনিময়ে তারা ঘরের মেয়েদের বিক্রি করে দিতো। বৃটিশ শাদসনামলে আইন করে এই প্রথা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
মিসেস গৌরী ব্যানার্জী ‘নাম্বুদ্রি’ সমাজের এক মর্মুস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছেন।-৮ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ‘নাম্বুদ্রি’ সম্প্রদায়ের কন্যারা থাকত পর্দার অন্তরালে। কোনো পরপুরুষ যদি হঠাৎ কখনো তাদের দেখে ফেলত কিংবা স্পর্শ করত, তবে সেই মেয়ে পতিতা বলে গণ্য হতো সমাজে। সমাজগতিরা মেয়েটিকে সমাজচ্যুত ঘোষণা করত। ঘোষণা পর প্রথমে বাড়ির ভৃত্যরা মেয়েটিকে যথেচ্ছ ভোগ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসত। বাবা-মার সাধ্য ছিল না বাধা দিতে। রাস্তায় ফেলার পরে কাড়াকাড়ি করে যে তাকে নিতে পারত, ইচ্ছেমতো কয়েকদিন ভোগ করে তারপর সে তাকে বিক্রি করে দিত অথবা অন্য কাউকে দান করত। এমনিভাবে হাত বদল হতে হতে মেয়েটি শেষতক গিয়ে পৌঁছত অন্ধকার জগতে। আত্মহত্যা অথবা পতিতাবৃত্তি ছাড়া তখন তার সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকত না। ডিএন মজুমদার হিমালয়ের কোনে উপজাতিদের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রথার কথা লিখেছেন।- ৯ ‘রীত’ নামক এক প্রথা অনুযায়ী ব্যক্তি তার প্রথমা স্ত্রীকে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিত। সেই অর্থে সে স্বাচ্ছন্দ্যে দ্বিতীয় স্ত্রী সংগ্রহ করতে পারত। তাকেও সে এমনিভাবে বেচে দিতে পারত। এইভাবে কেনাবেচনার ফলে হাত বদল হতে হতে, যৌবন নিঃশেষ হলে পরে তারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতো। স্থানীয় সরকার স্ত্রী বিক্রিয় ওপর কর আদায় করে রাজকোষে ভালো অর্থ জমা করত। আমাদের বাংলাতেও একসময় ছিল এক অদ্ভুত প্রথা। রাজা লক্ষণ সেন ছিলেন এই প্রথার উদগাতা। এই প্রথার নাম ‘কুলিন’ প্রথা। কুলিন পুরুষরা অর্থের বিনিময়ে ঘরে ঘরে বিয়ে করে বেড়াত। কোনো কোনো কুলিন স্বামীর শতাধিক স্ত্রী থাকবার কথা জানা যায়। অনেক যৌবনবতী স্ত্রী স্বামীর সংসর্গ না পেয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হতো। এতে সে গর্ভবতী হয়ে পড়লে ‘কুলিন স্বামী’ মেয়ের পিতার কাছে থেকে সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করার বিনিময়ে অনেক টাকা আদায় করত। অন্যথায় ব্যভিচারের অপরাধে মেয়েটিকে সমাজচ্যুত করা হতো। বিতাড়িত মেয়েটির সামনে তখন খোলা থাকত মাত্র দুটি পথ- আত্মহত্যা না হয় বেশ্যাপল্লী।
সামন্ত যুগে রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ্যাবৃত্তি প্রসার লাভ করে। রাজা-মহারাজারা ছাড়াও আমাত্যবর্গ পেশাদারী রমণী নিয়োগ করত। সে সময় পেশাদারী রমণীর এতে চাহিদা হয় যে, এদের জোগান দেবার জন্য নিয়মিত নীতি চালান, কেনাবেচনার ব্যবসার সূত্রপাত হয়। এক শ্রেণীর পুরু জীবিকা হিসেবেই এই ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। রাষ্ট্রের কাছে এই ব্যবসার কেনাবেচার হিসেব দিতে হতো ও কর পরিশোধ করতে হতো। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এই ব্যবসা এককালে এত জোরদার হয়ে ওঠে যে, গৃহস্থ রমণীদেরও রেহাই ছিল না। সমুদ্র বাণিজ্যে ভারত থেকে নারী চালান যেত বিদেশে, আবার বিদেশ থেকেও বাছাই করা রমণী আসত ভারতীয় রাজদরবারে বৈভব বৃদ্ধির উদ্দেশ্য। এসব কাহিনী ভারতীয় পূরাণ ও ধর্ম-সংহিতাসমূহের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এর ঐতিহাসিক মূল্য পাঠকরাই নির্ধারণ করবেন।
এবার এনসাইক্লোপেডিয়ার অনুসন্ধানে দেখা যাক পতিতাবৃত্তির জন্ম ইতিহাস।- ১০ নগর সভ্যতার পত্তনের ফলে ধীরে ধীরে যৌনতার প্রসার হতে থাকে। প্রথমাবস্থায় এটাকে দমন করা হলেও স্বার্থাদ্বেষী ও সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু গ্রুপ এটাকে প্রশ্রয় দেয়। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ক্রীতদাসী প্রভৃতিরা গোপনে যৌন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হয়। ধীরে-ধীরে গোপনে এই ব্যবসা স্বীকৃতি লাভ করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ‘লিডিয়ান’ ও ‘সাইপ্রিয়ান’ জাতির কন্যারা দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করে অর্থ সংগ্রহ করে এনে বিয়ে করত।
পুরোহিতরা কখনো-কখনো ধর্মের নামে মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োজিত করত। যেমন প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ায় মেয়েদের ইশতার দেবীর মন্দিরে যেতে হতো। মন্দিরের যে পুরুষ প্রথমে জিহ্বা দিয়ে ঐ মেয়েকে রূপারমুদ্রা নিক্ষেপ করবে, সেই পুরুষ ঐ মেয়ের দেহ ভোগের অধিকার পাবে। এ নিয়ম প্রাচীন ভারত মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় প্রচলিত ছিল। প্রাচীনকালে প্রযুক্তিক উন্নয়নের ফলে নগরায়ন সাধিত হয় এবং এই ধরনের নগরের মধ্যে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাচীন গ্রীস, ইসরাইল রোমে এ ধরনের পতিতাবৃত্তির প্রথম উৎপত্তি। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় স্বেচ্ছামূলকভাবে গোপনে পতিতাবৃত্তি প্রসার লাভ করে। কিন্তু কোথাও তা আইনগত স্বীকৃতি পায় না।
চীনে তা’ও রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি চালু করে। কিন্তু পরবর্তী সা’ঙ রাজবংশ (৯৬০-১১২৬ খৃ ক্যাফেতে ও অন্যান্য প্রমোদস্থানে যেসব কর্মরত মহিলারা ছন্দ বেশ্যাবৃত্তি করত, তাদের হাংচৌ শহরে সীমাবদ্ধ করে দেয়। রোমান আমলেই পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তির পেশার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয় ও কর ধার্য করা হয়। শিল্প বিল্পবের ফলে ব্যাপক নগরায়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের ফলে আধুনিক বেশ্যাবৃত্তির উম্মেষ ঘটে। এনসাইক্লোপেডিয়ার মতে ‘নগরায়ণ’, ‘অর্থনৈতিক শোষণ’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার’ এই তিনটি কারণে আধুনিক বেশ্যাবৃত্তি পেশা হিসেবে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপরে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইউনেস্কোর উদ্যোগে ফরাসী পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা জাঁ ফান্দান্দলয়ে গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন। বেশ্যাবৃত্তি সভ্যতার প্রাচীনতম পেশা তো নয়ই, এমনকি এই পেশার ধারণা আদি সমাজে ছিল একেবারে অজানা।
আধুনিক বেশ্যাবৃত্তির বিস্তার নারীর মর্যাদার চরম অবমাননা, জনস্বাস্থ্যের অবনতি বিশ্ব মানবতাকে করুণভাবে নাড়া দেয়। পতিতাবৃত্তির দ্রুত বিস্তারে পশ্চিমা জগতে বহুবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশ্ব সমাজ মাথা ঘামাতে শুরু করে এই দুষ্ট ক্ষতের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি নিয়ে। ব্যাপক গবেষণা ও আলোচনা-সমালোচনায় রত হয় এর কারণ উদ্ঘাটন ও তা দূরীকরণের জন্য। এনবাইক্লোপেডিয়া নগরায়ন ও অর্থনৈতিক শোষণকে বেশ্যাবৃত্তির প্রধান কারণ বলেছে। আমরা খতিয়ে দেখব এর প্রত্যক্ষ কারণসমূহ। প্রবেশ করব বেশ্যাবৃত্তির অন্তর্নিহিত কারণের গভীরে।
পতিতাবৃত্তি গ্রহণের কারণসমূহ : নগরায়ণ যে পতিতারবৃত্তির জন্য দিয়েছে, ঐতিহাসিক পরিক্রমায় সে সত্য জানা গেল। তাই বলে গ্রামেও যে এ ব্যবসা নেই, তা বলা যায় না। শহরের মতো নির্দিষ্ট পল্লীতে স্বীকৃত আকারে নেই বটে, কিন্তু বিভিন্নভাবে অসহায় নারীরা নির্ধাতিতা ধর্ষিতা হচ্ছে। কখনো অর্থের বা উপঢৌকনের বিনিময়ে গ্রামের অনেক নারী গোপনে দেহদান করে থাকে। এনসাইক্লোপেডিয়ার মতে আর্থিক শোষণ, পতিতাবৃত্তির দ্বিতীয় কারণ। এই কারণটিই প্রধান এবং সার্বজনীন ও সর্বকালীন।
আমরা পতিতাবৃত্তির কারণগুলকে দুই দিক থেকে মূল্যায়ন করব। কেননা প্রতিটি ঘটনারই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া আছে। ব্যাপারটি পারস্পরিক- একদেশীয়ভাবে কিছু ঘটে না। চাহিদা না থাকলে যেমন, অর্থনীতির সংজ্ঞায়, জোগান থাকে না, তেমনি ক্রেতা না থাকলে বিক্রেতা থাকত না। পতিতা ব্যবসায় পুরুষ ক্রেতা নারী বিক্রেতা। এখানে ক্রেতার ভূমিকাই মুখ্য, অন্তত আমার মতে। পুরুষের কাছে অবৈধভাবে নারীদের ভোগের চাহিদা আছে বলেই এই পেশার অস্তিত্ব। নারী জোগানের ব্যবস্থাটি যেভাবেই হোক না কেন চাহিদার প্রয়োজনেই ব্যবস্থাটি প্রসার লাভ করেছে। ঠিক যেমন নেশাখোরদের চাহিদা আছে বলেই গাঁজা-ভাঙয়ের জোগান এসে থাকে। এই জোগান স্বাভাবিকভাবে না থাকলে চোরাই পথে আসবে তবু আসতেই হবে। এখানে যেমন গাঁজার চোরাচালান বন্ধ করে গাঁজার নেশা ছাড়ানো যাবে না, তেমনি নারী জোগানের পন্থা বন্ধ করেও বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে না, যতক্ষণ না অবৈধ নারীদের ভোগের চাহিদা বন্ধ হচ্ছে।
তাই বিষয়টিকে আমরা দুইভবে দেখব। কেন পুরুষরা অবৈধ নারী সম্ভোগ কামনা করে? বিপরীতে কেন রমণীরা তাদের দেহ বিক্রি করে?
মেয়েদের পতিতাবৃত্তি গ্রহণের কারণ :
১. দারিদ্র্য : দারিদ্র্যকে পতিতাবৃত্তির প্রধান কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু আমরা তা স্বীকার করি না। অন্যান্য কারণের সঙ্গে দারিদ্র্যও একটি সহায়ক কারণ মাত্র- প্রধান কারণ নয়। অভাবের কারণে কোনো মেয়ে যে স্বেচ্ছায় পতিতাবৃত্তি পেশা গ্রহণ করেছে- এমন কথা আমাদের জানা নেই। বরং আমরা জানি কোনো গরীব মেয়ে জান দেবে তবু সতিত্ব দেবে না। তবে অভাবের সুযোগ নিয়ে দালালরা বিভিন্ন কৌশলে মেয়েদের শেষতক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে। অভাব এখানে সরাসরি কোনো কারণ নয়- উপলক্ষ মাত্র। অভাবই যদি পতিতাবৃত্তির প্রধান কারণ হতো তবে সকল অথবা অধিকাংশ মেয়েই পতিতাবৃত্তি পেশা গ্রহণ করত। এদেশে নব্বই শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কিন্তু আমরা জানি সারা দেশে মোট ১ লাখ নারী এই পেশায় জড়িত। অতএব পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন দরিদ্র নারী সমাজের মধ্যে মাত্র ১ লাখ মহিলার এই পেশা গ্রহণ করেছে। তা-ও সরাসরি দারিদ্র্যপ্রসূত নয় কোনো অবস্থাতেই দারিদ্র্যকে এই পেশার প্রধান কারণ বলা যায় না।
২. নারী অহরণ : বরং উচিত, দারিদ্র্যের চেয়ে নারী অহরণই বেশ্যাবৃত্তির প্রত্যক্ষ ও প্রধান কারণ। আসলে ব্যাপারটি পারস্পরিক সম্পর্কিত। খুব কমই নারীদের সরাসরি অপহরণ করে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়। সরাসরি অহরণের সংখ্যা খুবই কম। কর্মের লোভ দেখিয়ে প্রেমে প্রতরণা করে এবং অন্যান্যভাবে মেয়েদের ফুঁসলিয়ে পরে অপহরণ করা হয় অথবা দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। অতএব অন্য যে কারণ থেকেই হোক না কেন, নারী অপহরণই মূল এবং শেষ কারণ।