বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) অধীনে প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য অনুষ্ঠিত হয় বিসিএস পরীক্ষা, যেখানে তিনটি ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে এবং আরোকিছু আনুষঙ্গিক পদ্ধতি পার হয়ে একজন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন
বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কাজ করার জন্য। সম্প্রতি ৩১তম বিসিএস পরীক্ষার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে, বিভিন্ন ক্যাডারে ২১০৮ জন কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য। যদিও এই পদের সংখ্যা প্রায়ই কমবেশি হয়, এবং গত ২-৩টি পরীক্ষার ধারা বিবেচনায় নিলে
বলা যায়, পদসংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। এই অধম সৌভাগ্যক্রমে এই পরীক্ষার ধাপগুলো একবার অতিক্রম করেছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে আগ্রহী প্রার্থীদের জন্য ২-৪ কথা বলার লোভ সামলানো গেল না, একে কোন রকম উপদেশ মনে না করে
অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির চেষ্টা মনে করলেই বাধিত হবো।
যে কেউ বিসিএস দেবার আগে একটাই অনুরোধ, আগে ভেবে দেখুন আসলেই আপনি সরকারী চাকরি করতে ইচ্ছুক কিনা। সরকারী চাকরির পক্ষে-বিপক্ষে অনেকরকম যুক্তি-পাল্টা যুক্তি রয়েছে, নিজে যাচাই করে দেখুন সেগুলো। প্রথম অভিযোগ,সরকারী চাকরির বেতন বাড়াবাড়ি রকমের কম, এমনকি চাকরিতে যোগদান করেও অনেককে এই অভিযোগ করতে এবং একসময় চাকরি ছেড়ে আবারো অন্য জায়গায় চলে যেতে দেখেছি।অভিযোগটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়, আপনার যদি বেশি টাকাপয়সার দরকার থাকে বা কোটিপতি হবার ইচ্ছে থাকে, সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে যোগদান না করাই ভাল। এক্ষেত্রে আগে থেকেই ধরে নিচ্ছি আপনি সৎ থাকতে চাইছেন এবং কোনরকম অনিয়ম করে ধনী হতে রাজি নন, এবং সেক্ষেত্রে আপনাকে মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে মাঝারি (এবং অনেকের মতে অপ্রতুল) বেতনে সংসার চালাতে। পাল্টা যুক্তি হিসেবে দেয়া যায়, সরকারি
চাকরিতে আপনি কিছু আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন, সরকারি বাড়ি এবং ক্ষেত্রবিশেষে যানবাহন, যেটা দিয়ে মোটামুটিভাবে
আপনার পোষাবে। তারপরেও বলি, টাকাপয়সার দিক দিয়ে উচ্চাভিলাষী হলে না আসাই ভাল, এবং ঘুষের লোভে আসার চেয়ে না আসা আরো ভাল, খামোকা দীর্ঘহ একটা প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন। তবে আপনি এক্ষেত্রে সরাসরি জনসাধারণের জন্য কাজ করার এবং দেশের উন্নতিতে সরাসরি অবদান রাখার দুর্লভ সুযোগ ও ক্ষমতা পাচ্ছেন, দেশ আপনাকে যা দিয়েছে তা ফিরিয়ে দেবার এরচেয়ে ভাল সুযোগ আর হয় না বলেই
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। সরকারী কাজের আরেকটা অসুবিধা হলো কাজকর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশ ধীরগতির, এবং বেশিরভাগ জায়গাতেই আধুনিকায়ন হয়নি বলে শুরুতে তাল মেলানো কঠিন হতে পারে, তবে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে, এবং আধুনিক মনের মেধাবীরা যোগ দিলে আরো পাল্টাবে তাতে সন্দেহ নেই। যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন নেই বলে আরেকটা অভিযোগ রয়েছে, তেলবাজরা উপরে উঠে যায় বা প্রমোশন পায় আগে এমন কথা প্রায়ই দেখি, কিছুটা সত্যতাও আছে এটায়, তবে এটাও ঠিক, কর্পোরেট এবং লোভনীয় প্রাইভেট চাকরি বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানে এই তেলবাজি এবং পেছন থেকে ছুরি মারা আরো অনেক বেশি চলে এবং যেখানেই উপরে ওঠার প্রশ্ন, সেখানেই এই জিনিস থাকবেই, একতরফা সরকারি চাকরির জন্য কথাটা খাটে না।
যা হোক, এই বিতর্ক এখানে না ওঠানোই ভাল, বরং ধরে নিচ্ছি যারা লেখাটি পড়ছেন তারা একটু হলেও চেষ্টা করে দেখতে আগ্রহী। সেক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে দিন এখনি, কারণ আবেদনপত্র জমা দেবার শেষ তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি, এবং বলে
রাখা ভাল যে যাদের এখনো অনার্সের ফলাফল বের হয়নি তারাও "অ্যাপিয়ার্ড" সার্টিফিকেট নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারবেন। পরীক্ষাটা হয় ৩ ধাপে, আগেই বলেছি, প্রথম ধাপটা হলো ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি বা বাছাই পরীক্ষা, যার প্রশ্নগুলো হয় এমসিকিউ বা মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন। প্রতিটি প্রশ্নের সম্ভাব্য ৪টি উত্তর থেকে বেছে নিতে হয় সঠিক ১টি উত্তর, এবং প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য ১ নম্বর পাবার পাশে প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য কাটা যাবে ০.৫ নম্বর, বিষয়টা খেয়াল রাখা ভাল। গত ৩টি বিসিএস থেকে দেখা যাচ্ছে, কম-বেশি আড়াই লাখের মত প্রার্থী থাকে, এবং প্রাথমিক বাছাইয়ের পর রাখা হয় ১৩ থেকে ১৪ হাজারের মত। কাজেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কত পেলে আপনি সেই ১৪ হাজারের ১ জন হবেন তার ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, প্রশ্ন কঠিন এবং "আনকমন" হলে ৪৮-৫০ পেয়েও টিকে যেতে পারেন, সহজ হলে ৬৫-৭০ নিরাপদ।
আশা করা যায় মার্চের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে পরীক্ষাটা হবে, কাজেই শুরু করে দিন এখনি। প্রস্তুতি একেকজন একেকভাবে নিতে পারেন, এখানে শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু অযাচিত পরামর্শ দিতে পারি। প্রশ্ন হয় বাংলা, ইংরেজি,
বাংলাদেশ বিষয়াবলী, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, গণিত এবং সাধারণ বিজ্ঞানের উপর। প্রথমেই বাংলা। এখানে প্রশ্নগুলো আসে বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে, এজন্য সবচেয়ে ভালো বই নিঃসন্দেহে প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন
আজাদের লেখা "লাল নীল দীপাবলী" (অবশ্যপাঠ্য) এবং "কত নদী সরোবর"। নীলক্ষেত গেলে পাবেন, তবে বইমেলাতে এখন হুমায়ুন আজাদের সব বই-ই পাওয়া যাচ্ছে, এই দু'টোও, কিনে ফেলুন। বাংলাতে আরেকটা ব্যাপার হলো
কবি-সাহিত্যিকদের নাম, নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা বইটা নিয়ে ভদ্রলোকদের নাম ও গুরুত্বপূর্ন বইগুলোর নামের উপর চোখ বুলালে আশা করা যায় কষ্টটা বৃথা যাবে না। যারা ইংরেজিতে ভালো তাদের জন্য বিশেষ কোন কিছুর দরকার নেই, তারপরেও
Preposition এবং common mistakes এর উপর জোর দিতে পারেন। কিছু
translation ও আসে, এবং কিছু voice, মোটের উপর, ভাল ১টা ইংরেজি গ্রামার বই পড়লে প্রিলিমিনারি পার হয়ে যাওয়ার কথা। গণিতের বেলায় বলবো, ছোট ছোট সমস্যা আসে, এবং প্রায় সবই অষ্টম বা নবম শ্রেণীর পর্যায়ের, চাইলে ঐ বইগুলো থেকে দেখতে পারেন, আর যাদের বিজ্ঞানের পড়াশোনা, অত না দেখলেও সম্ভবত চলবে।
এবারে বাংলাদেশ বিষয়াবলী ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, আর এখানেই চলে আসে গাইড বইয়ের প্রশ্ন। আপনার কাজটা সহজ করবে এবং খানিকটা গুছিয়ে দেবে গাইড বইগুলো, প্রশ্ন সম্পর্কেও ধারণা পাবেন। নীলক্ষেত থেকে এই ২ বিষয়ের উপর ওরাকল বা প্রফেসর'স এর গাইড বই কিনে ফেলুন, যে কোন একটা কিনলেই হবে। সব পড়া নিষ্প্রয়োজন, শুরুতেই দেখুন গাইডের পেছন দিকে, বিগত বিসিএস গুলোর প্রশ্ন এবং আরো কিছু সরকারী চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন আছে, সেগুলো দেখুন, ভাল একটা ধারণা পাবেন কি ধরণের বিষয়ের প্রতি জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর বিস্তারিত পড়াশোনা করুন, গাইড থেকে এবং এর বাইরেও যা পান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও তারিখ, স্থান, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, সেক্টর ও সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ইত্যাদি। বাংলাদেশের কোথায় কোন ভাস্কর্য রয়েছে, সেগুলোর নাম, উন্মোচনের তারিখ, স্থপতির নাম এগুলোর ব্যাপারেও ২-১টা প্রশ্ন থাকে। সাথে থাকে বাংলাদেশের উপজিলা-থানার সংখ্যা, বৃহত্তম-ক্ষুদ্রতম-দূরতম এই জাতীয় ২-১টা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক বিষয়ে গেলে, বিগত বছরের প্রশ্ন গুলোর সাথে দেখতে পারেন বিভিন্ন দেশের সীমান্ত, মুদ্রা, সাগর, রাজধানী, গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান, এবং অতি অবশ্যই জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন গুলোর উপর বিস্তারিত। সম্ভব হলে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়েও কিছু জেনে যাওয়া ভাল, যে সময়ে যা নিয়ম।
এগুলোর বাইরে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়মিত পত্রিকা পড়া। মুখস্ত করার দরকার নেই, গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক পাতার উপর নিয়মিত চোখ বুলান, অন্তত গত ৩-৪ মাসের। সত্যি বলতে কি, নিয়মিত পত্রিকা পড়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কম করেও ৫-৭টা প্রশ্ন সরাসরি আসে ইদানিংকালের গুরুত্বপূর্ণ দেশী-বিদেশী ঘটনার উপর। সাথে কিনে ফেলুন "কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স" ম্যাগাজিনের সালতামামি ২০১০ সংখ্যা, এবং সাথে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি সংখ্যা। সব পড়তে হবে না, সারসংক্ষেপ পড়ুন, প্রধান ২-১টা প্রবন্ধ দেখুন, পরেও কাজে লাগবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে কিছু পড়াশোনা করুন, খবর রাখুন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২৮তম বিসিএস এ "হট টপিক" ছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও বারাক ওবামা, প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় বেশ অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছিল এর উপর। গতবার সেটা ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। এবার, নিশ্চিত করেই বলা যায়, তিউনিসিয়া ও মিশরের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান বেশ ভালই গুরুত্ব পাবে।
সবার শেষে বিজ্ঞান। প্রশ্ন গুলো খুবই সাধারণ, তবে ব্যক্তিগতভাবে খুব ১টা সুবিধার লাগেনি, চা পাতায় কোন ভিটামিন থাকে বা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কত, এই জাতীয় জিনিস অনেক আগে পড়া, কাজেই একদম অবহেলা না করে ওরাকল বা প্রফেসর'স
এর বিজ্ঞানের গাইডটাও কিনে নিয়ে বইটার শেষ দিকে বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখে যাওয়া ভাল। এরপরেও কারো হাতে কিছু সময় থাকলে, কিরণ এর "আজকের বিশ্ব" থেকে বাংলাদেশ বিষয়াবলী ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর অংশটা খানিকটা দেখে নিতে পারেন, যদিও ৫০০-৬০০ পৃষ্ঠার জ্ঞানভাণ্ডার হজম হবে না ভেবে নিজে আর ঐ পথ মাড়াইনি। প্রিলিমিনারির একদম আগে
আগে নীলক্ষেতে "শিওর সাকসেস" নামে ছোটখাটো সাজেশন বই বের হয়, নিজে কিনিনি, তবে কেউ কেউ নাকি উপকার পেয়েছেন, শেষমুহূর্তে নিজেকে ঝালাই করে নিতে চাইলে কিনতেও পারেন, যদিও কার্যকর কিনা সেটা বলতে পারছি না।
সবার শেষে, ইন্টারনেট। নিয়মিত খবরের সাইটগুলোতে ঢুঁ মারুন, ব্লগে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর তথ্যসমৃদ্ধ লেখাগুলো পড়ুন, ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাস যখন সামনে, ভাষা আন্দোলনের উপরও কিছু পড়াশোনা করে নিন, আর মুক্তিযুদ্ধের উপরও, আর
কিছু না হোক, নিজের ইতিহাসটা তো ভালভাবে জানবেন। একটু চোখ-কান খোলা রাখুন চারপাশের ব্যাপারে, এবং আবারো বলছি, নিয়মিত খবর ও পত্রিকার সাথে সময় কাটান।পরীক্ষার হলে গিয়ে ভুল উত্তরের ব্যাপারে সাবধান থাকুন, এই তো,
এমন কিছু কঠিন নয়, শুধু আপনার ইচ্ছার ব্যাপার। একবার চেষ্টা করেই দেখুন না, দেশথেকে তো কম নিলাম না, এবার দেশকে কিছু ফিরিয়ে দেবার পালা, বিনিময়ে কথা দিতে পারি, দেশ আপনাকে একেবারে কম দেবে না।
সব পরীক্ষার্থীর জন্য শুভকামনা।
[লেখাটায় তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার জন্য বন্ধুবর তানভীর হোসেন রাহাত, রেজাউল করিম রানা ও শাহরুল আমিন সনেটের কাছে কৃতজ্ঞতা। লেখায় অনেককিছু বাকি থাকতে পারে, এবং অবশ্যই এটা কোন "শিওর সাকসেস" বা অবশ্য পালনীয় নির্দেশিকা নয়, নিজেই নিজের মত প্রস্তুতি নিতে পারেন, শুধু আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আপনারা সামান্য উপকৃত হলেও নিজেদের সফল মনে করবো। যেকোন প্রশ্ন থাকলে, এখানে রেখে গেলে যথাসাধ্য জবাব দেবার চেষ্টা করবো। আবারো শুভকামনা।]