রাত বাজে ১১টা ৩০, দাঁড়িয়ে আছি সিলেট শহরে, সৌদিয়া বাস কাউন্টারের আশপাশে ঘুরঘুর করছি। এই সময়ে এখানে ঘুরঘুর করার কথা না, কর্মফল ভোগ করছি বলা যায়, বন্ধুদের সাথে মাধবকুণ্ড গিয়েছিলাম, পথে বিশাল ঝগড়া করে সিলেট শহরে নেমেই আলাদা হয়ে গেছি। ৩ জন গেছে একদিকে, এই বান্দা অন্যদিকে, নিজেই সিলেট ঘুরবো এমন একটা জেদ। ব্যাপারটা ঠিক কতখানি মূর্খের মত হয়েছে সেটা টের পেলাম আধা ঘণ্টা পরেই, যখন রাত ১০টা ৩০ মিনিটে একটা হোটেলে ঢুকে শুনলাম রুম খালি নেই, এবং তার ১৫ মিনিট পরে আরো এক হোটেলওয়ালা একই বুলি ঝাড়লো। আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল আমার চেহারায় একটা চোর চোর ভাব আছে, দু'টো হোটেলওয়ালা একই ভঙ্গিতে খেদিয়ে দেয়াতে মোটামুটি নিঃসন্দেহ হয়ে গেছি। কিন্তু এই নো দাইসেলফে কোন উপকার হচ্ছে না, এক ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন হোটেলে রুম পাওয়া যেতে পারে, জবাবে যে হোটেলটা দেখিয়ে দিল সেটার এক রাতের ভাড়া ৮০০ টাকা, ওখানে থাকলে ঢাকা ফিরতে হবে হেঁটে, নয়তো শাহজালালের মাজারে গিয়ে ভিক্ষা করে।
কাজেই এখন বাস কাউন্টারের আশপাশে ঘুরে ঘুরে ভাবছি রাতটা থাকবো নাকি ঢাকার বাস ধরবো, নাকি শাহজালালের মাজারেই রাত পার করার চেষ্টা করবো। একবার এগোই একবার পিছাই, এরমাঝেই মোবাইল বের করে দেখে ফেলেছি ১২টা বাজে প্রায়। এমন সময় দেখি কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে এক ছেলে বের হচ্ছে, বয়স আমার চেয়ে কিছু বেশিই হবে, ফর্সা, চেহারা দেখে ভরসা হলো যে কিছু জিজ্ঞেস করলে ধাতানি দেবে না। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে পাকড়াও করলাম, জানালাম যে মাধবকুণ্ড গিয়েছিলাম, ফিরতে রাত হয়ে গেছে, কোন হোটেলে রুম পাচ্ছি না। একা মাধবকুণ্ডে গিয়েছিলাম সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল, কি ভাবলো কে জানে, তবে খানিক চিন্তাভাবনা করে জানালো, তা পরিচিত হোটেল আছে একটা, ভালই মোটামুটি, কম ভাড়াতেই থাকতে পারবো। সেদিকেই নাকি যাচ্ছে, চাইলে আমাকে নামিয়ে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। মনে মনে ভাবলাম, নিলে তো নেবে মোবাইলটা, বড়জোর কয়টা টাকা, তা এখানে থাকলেও কেউ না কেউ নেবে, উঠেই পড়ি। আল্লাহর নামে রওনা দিলাম। পথে জানলাম, নাম তামীম, সিলেটের বেশ বনেদী পরিবারের ছেলে, অনেকেই নাকি চেনে। ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, ঢাকায়ও আছে, প্রায়ই আসা হয়। গল্প করতে করতেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম, তালতলা এলাকায়, ম্যানেজার বেশ খাতির করে অর্ধেক ভাড়ায় রুম দিয়ে দিল, যাওয়ার সময় ফোন নম্বর দিয়ে বলে গেলেন কোন সমস্যা হলেই যেন তখনই জানাই। ধন্যবাদ কিভাবে দেয়া যায় ভাবতে ভাবতেই হাওয়া, আমি আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে উপরওয়ালার শুকরিয়া করে ঘুম, একদিনের জন্য অনেক বেশিই হয়ে গেছে।
তামীম ভাইয়ের কল্যাণে মহাঝামেলা থেকে রক্ষা পেয়ে পরদিন জোশ বেড়ে গেল, একা একাই জাফলং আর সিলেট ঘুরে বীরদর্পে ঢাকা ফিরলাম। অবাক ব্যাপার, ফেরার দিনই আবার ফোন করে খোঁজ নিলেন ভদ্রলোক, মা তাঁকে জানালেন, তাঁর এই মহাবেকুব পুত্রকে বিপদের সময় সাহায্য করার জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি নিজে চুপ থাকলাম, কখনো কখনো ধন্যবাদ দিলে অমর্যাদাই করা হয়, কিছু ঋণ শোধ করার ক্ষমতা বিধাতা মানুষকে দেননি।
অতীত থেকে একটু বর্তমানে ফিরি। গতকালকের কথা, সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরেছি, নতুন চাকরি, চরম খাটুনি, সাথে সারাদিন এর-ওর সাথে খ্যাচম্যাচ লেগেই আছে, প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা। ফিরে শুনলাম, সকালবেলা বাবা অফিসের দিকে গিয়ে এখনো ফেরেননি। সেটা মাঝে মাঝেই হয়, মাথা ঘামানোর অবস্থা নেই, কিন্তু ৭টার পরেও না ফেরায় দুশ্চিন্তা শুরু করতেই হলো। এরমাঝেই হঠাৎ মোবাইলে ফোন, বাবার নম্বর থেকে, ধরতেই একটা অপরিচিত গলা শুধালো, আপনার নাম অমুক? বললাম হ্যাঁ, আবার প্রশ্ন, এটা যার নম্বর তিনি কে? বললাম আমার বাবা। সাথে সাথেই জানালেন, বাবাকে কাকরাইলের ইসলামী ব্যাঙ্ক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, মৌচাকের কাছে নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত হিট স্ট্রোক জাতীয় কিছু, তিনিসহ আরো ২জন নিয়ে এসেছেন, আমি এখনি যেন যাই। মাথাটা ওলোটপালট হয়ে গেল, অনুরোধ করলাম তিনি যেন কষ্ট করে অপেক্ষা করেন, এখুনি রওনা হচ্ছি। অসহনীয় উদ্বেগ নিয়ে জ্যামের মাঝে এক ঘণ্টা লাগিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম, জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখি একজন দাড়িওয়ালা লোকের সাথে এক ভদ্রমহিলা, সাথে আমাদের বয়সী একটা ছেলে। বাবাকে দেখালেন, অক্সিজেন দিয়ে রাখা, তখনো জ্ঞান ফেরেনি, ডাক্তার জানিয়েছেন সিটিস্ক্যান করাতে হবে ব্রেম হ্যামারেজ হয়েছে কিনা দেখার জন্য, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা, বললেই করা হবে।
কথা বলারও সময় নেই, সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে কথা বলে স্ক্যানিং মেশিনে ঢোকানো হলো উপরে নিয়ে, এর মাঝেই জানলাম দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের নাম রকিবুল ইসলাম, ভদ্রমহিলার নাম শানু, আর ছেলেটা পদ্মা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের একজন কর্মচারী। কেউই কাউকে চেনেন না, মৌচাক মোড়ে বাবাকে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে প্রথমে রকিব ভাই ধরে পদ্মাতে নিয়ে আসেন, শানু আপা এসেছিলেন তাঁর বাবার পরীক্ষা করাতে, একা রকিব ভাই সামলাতে পারছেন না দেখে নিজের বাবাকে বিদায় করে শানু আপা এগিয়ে আসেন, এরপর থেকেই আছেন। পদ্মার ঐ ছেলেটাকে নিয়ে ৩ জন এসেছেন হাসপাতালে, জরুরী বিভাগে ভর্তি করেছেন ছোটাছুটি করে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনেছেন, ডাক্তার আর কর্মচারীদের বলেকয়ে অক্সিজেন আর স্যালাইন দেবার ব্যবস্থা করেছেন, এবং বাবার মোবাইল থেকে ১০-১৫টা জায়গায় ফোন করে অবশেষে আমাকে খুঁজে পেয়েছেন, এবং এরপরেও আছেন আমাদের সাথে।
কথা শুনতে শুনতেই সিটিস্ক্যানের ফলাফল পাওয়া গেল, ভাল খবর হলো রক্তক্ষরণ হয়নি, তবে জরুরীবিভাগের চ্যাঙরা ডাক্তার ঝুঁকিতে নেই, পাঠালেন উপরে বুড়ো ডাক্তারের কাছে। আবার স্ট্রেচার নিয়ে ছোটা, ফর্ম পূরণ করা, আমি নিজেকে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ দাবী করতে পারি না, রকিব ভাই একাই সব করলেন, শানু আপা তখন মায়ের সাথে। বুড়ো ডাক্তার জানালেন, একদিন হাসপাতালে রাখলে ভাল হয়, ওষুধপত্র দিয়ে দিচ্ছেন। ভর্তি করাতে গিয়ে শুনি, সিট নেই, হাতেপায়ে ধরেও লাভ হলো না। আমার হতভম্ব মুখ দেখে আবারো রকিব ভাই ছোটাছুটি করে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করলেন, বুড়োর কাছ থেকে বারাকাহ জেনারেল হাসপাতালে একটা কেবিন দেয়ার চিঠিও লেখালেন। সব নিয়ে যখন আমরা রাজারবাগের পথে, রাত তখন সাড়ে দশটা।
বারাকাহ হাসপাতালে যেতে যেতেই বাবার জ্ঞান ফিরলো, কথাও বললেন। সেখানে গিয়ে দেখি, ওটাকে হাসপাতাল না বলে খোঁয়াড় বলাই ভাল, অব্যবস্থাপনা আর নোংরামির চূড়ান্ত উদাহরণ। কেবিন দেখে মনে হলো, এখানে থাকলে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। এরমাঝেই জরুরী বিভাগের ডাক্তার দেখে বললেন, জ্ঞান যখন ফিরেছে আর মস্তিষ্কে যেহেতু রক্তক্ষরণ হয়নি, বাড়ি নিয়ে যেতে পারি, এমনিতেও এখানে আর তেমন কোন সেবা পাবো না। পরামর্শের জন্য তাকালাম ২ হিতৈষীর দিকে, দু'জনই বাড়ি নেবার জন্য মত দিলেন। এরমাঝেই এক আত্মীয় চলে এসেছেন, বাসায় নেবার জন্য লোক পাচ্ছি, ২ জন বিদায় চাইলেন। এবারও আর ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর চেষ্টা করলাম না, এমন মানুষদের ধন্যবাদ জানানোর মত মানুষ এখনো হয়ে উঠতে পারিনি।
কথা অনেক বাড়িয়ে ফেলেছি, ২-১টা কথা বলেই ইতি টানি। মায়ের কাছে জানলাম, রকিব ভাই বিকম পাশ করেছেন, আগে কোন একটা ওষুধ কোম্পানিতে ছিলেন, বিদেশ যাবার চেষ্টা করে টাকাপয়সা অনেক গেছে, এখন কিছু করেন না, ছোটখাটো কিছু করা যায় কিনা চেষ্টা করছেন। আমার কুটিল মনে প্রশ্ন জাগলো, বাবার পকেটে মোবাইল ছিল, সাড়ে আট হাজার টাকা ছিল, একজন মানুষ যার টাকার প্রয়োজন, কিভাবে সবকিছুকে উপেক্ষা করে, এমনকি অজ্ঞান বা মৃতপ্রায় রোগী বহনে কত বেশি ঝুঁকি সেটা জেনেও এভাবে না খেয়ে না ঘুমিয়ে একজন অপরিচিত মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কিভাবে? শানু আপার কথা ভেবে মনে হলো, যেখানে সবাই শুধু দায়িত্ব এড়াতে চায়, একজন সাধারণ মানুষ তখন অতিমানবী হয়ে ওঠেন কোন শক্তিতে? খানিক পরে হাল ছেড়ে দিলাম, আমার মত ক্ষুদ্র নিচুমনের মানুষের পক্ষে সত্যিকারের মানুষের কাছাকাছি হয়ে ওঠা কখনোই হবেনা। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষ দেখে যে উটকো ঝামেলা ভেবে ঝটপট কেটে পড়ি, সে কিভাবে খাঁটি মানুষের মন বুঝবে?
মাঝে মাঝেই জীবনের দিকে আর মানুষের দিকে হতাশ হয়ে মানুষের দিকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি, এমন একটা পেশায় আছি যেখানে প্রতিনিয়তই মানুষের নীচতা, শঠতা, ভণ্ডামি দেখতে হয়, পৃথিবীতে মানুষ নামের জীবটার খুব অভাব বোধ করি তখন। তামীম ভাই, রকিব ভাই, শানু আপা, আর নাম না জানা পদ্মার সেই কর্মী-- আপনাদের যদি জীবনরক্ষার কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, সে হবে আপনাদের অনেক বেশি ছোট করা, বরং কৃতজ্ঞতা জানাই এই ক্ষুদ্র মানুষের নিজেকে ভাল মানুষ ভাবার অহংকার ভেঙে দেয়ার জন্য, নিজের ক্ষুদ্রতা আরেকবার দেখে নেবার সুযোগ দেয়ার জন্য, আর মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়াও ভাল সেটা আরো একবার ভাবানোর জন্য, ধরার বুকে স্রষ্টার করুণাধারা বারবার অনুভব করানোর জন্য।
স্রষ্টার পৃথিবীর আনাচেকানাচে যেসব "মানুষ" আমাদের প্রতিদিন মানুষ হতে শেখাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি এই অধমের নতমস্তকে অভিবাদন এবং কৃতজ্ঞতা।