ন্যাট জিওতে একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম, আমাদের প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি দেখার মাঝেই যে কত কিছু জানার আছে সেটা নিয়ে। লেখার বিষয়বস্তুর আকালে মিলাদের জিলাপি দেখার মত লাফিয়ে পড়লাম। দেখা যাক হাবিজাবি কিছু লেখা যায় কিনা।
চাকা
গাড়ির চাকা আসলে কেন খাঁজকাটা হয়? অর্থাৎ চাকাতে কেন থ্রেড দেয়া হয়? অনেকগুলো কারণের মাঝে একটা দেখা যাক বাস্তব পরীক্ষা দিয়ে। একটা ট্র্যাক বানানো হলো, রেসিং ট্র্যাকের মত। চারপাশ থেকে ফোয়ারার পানি দিয়ে বৃষ্টির আবহ সৃষ্টি করা হলো। প্রথমে খাঁজকাটা চাকা দিয়ে শুরু হলো, ৪০ কিমি গতি তুলে হার্ডব্রেক করা হলো। দেখা গেল গাড়িটা থামার আগে যাচ্ছে প্রায় ৫৩ মিটার। এবার খাঁজছাড়া চাকা। ব্রেক করার পর গাড়িটা থামার আগে কতদূর গিয়েছে আন্দাজ করুন তো! ১২৫ মিটার।
পেপার ক্লিপ
প্রতিদিন যে এলিপ্টিক্যাল শেপে ৩ বার বাঁকানো পেপার ক্লিপগুলো আমরা ব্যবহার করি, সেটা ঠিক এই আকারে আসতে বেশ সময় লেগেছে। সেফটিপিনের মত, তিনকোণা, তারার মত, এমন নানা আকার পার হয়ে এখনকার জেমস ক্লিপের আকার পেয়েছে এটা। এই আকারটা সাধারণ ইস্পাত হলে ধরে রাখতে পারতো না, যতবারই বাঁকানো হতো তার আগের আকারে অর্থাৎ কিনা সোজা হয়ে যেতে চাইতো। যেভাবে ইচ্ছা বাঁকানোর জন্য সাধারণ ইস্পাতের সাথে মেশানো হয় সামান্য ম্যাঙ্গানিজ আর সিলিকন, যার জন্য এই ইস্পাতকে ইচ্ছামত বাঁকিয়ে আকার দেয়া এবং সেই আকারেই রেখে দেয়া যায়। অবিশ্বাস্য হলো, প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই পেপার ক্লিপ তৈরি হয় ২০ বিলিয়ন অর্থাৎ ২ হাজার কোটি, যার জন্য খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টন ইস্পাত।
এয়ারক্রাফট টায়ার
আবারো ফেরত আসি চাকায়, তবে সাধারণ চাকা নয়, উড়োজাহাজের চাকায়। এ চাকার সাথে সাধারণ চাকার পার্থক্য থাকতেই হবে, এয়ারক্রাফট টায়ারকে একই সাথে যেকোন ট্রাকের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ওজন আর ধাক্কা এবং সেই সাথে ফর্মূলা ওয়ানের রেসিং কারের চেয়েও বেশি গতি হজম করার ক্ষমতা থাকতে হবে। বিশেষভাবে বানানো এই চাকাগুলোকে তাই চরমতম পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেরকম একটা পরীক্ষা দেখতেই ন্যাটজিও টিম গিয়েছিল বিশ্বখ্যাত টায়ার নির্মাতা ডানলপের কারখানায়, যারা কিনা ছোট গাড়ি থেকে শুরু করে বোয়িং জাম্বোজেটেরও চাকা বানিয়ে থাকে। ১৯১০ সাল থেকে বিমানের চাকা বানানো শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানটি, এখনো টিকে আছে সুনামের সাথে। দেখা গেল তাদের কারখানায় কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা। প্রতিটা চাকাকে পরীক্ষা করা হয় ডায়নামোমিটার নামের একটা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে, যেটা একই সাথে ইমপ্যাক্ট (আকস্মিক ধাক্কা), ওজন আর অ্যাব্রেশান (গতি আর আঘাতজনিত ক্ষয়) টেস্ট করতে পারে। অবশ্যই সাধারণভাবে যা আসার কথা তারচেয়ে বেশ কিছুটা বেশি ধরেই পরীক্ষাগুলো করা হয়। প্রশ্ন আসতে পারে, এই বেশিটা কি? জবাব হলো, ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং, বা এয়ার পারাবতের মত খালেবিলে মাঠেঘাটে নেমে পড়া, অথবা আরো খারাপ হলে, দুর্ঘটনা। সাধারণ একটা এয়ারক্রাফট টায়ারের জন্য চাপ ধরা হয় ২২০ পিএসআই, অর্থাৎ প্রতি বর্গইন্ঞ্চিতে ২২০ পাউন্ড, তবে সবার শেষে যে "ইনফ্লেটেবল টেস্ট" করা হয়, সেখানে ধরা হয় এক্সট্রিম কন্ডিশান, যাতে টায়ার ফেটে যাবে। এজন্য ডিজাইন প্রেশারের অন্তত ৪ গুণ প্রেশার দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। একটা বায়ুশূন্য কক্ষে টায়ারটা রাখা হয়, আর ভিতরে ভরা হয়, না, বাতাস না, পানি। পানি কেন? কারণ বাতাস দিয়ে ঐ চাপ সৃষ্টি করতে চাইলে এটা এত বেশি আয়তনে বাড়বে যে যখন ফাটবে তখন ফ্যাক্টরি বিল্ডিংয়ের অর্ধেকটা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শেষ এই বোকামিটা ডানলপ করেছিল ১৯৩৯ সালে, সেবার পুরো প্রেশার চেম্বারটা উড়ে গেলে পর এই পানি দিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা। যাই হোক, পানি দেয়া হচ্ছে, চাপ বাড়ছে, ৩০০, ৪০০, ৬০০, ৮০০, ৯০০, ১০০০, এবং বুম! টায়ারটা ছিটকে গেল এদিক ওদিক, তবে এত চরম কন্ডিশনেও কিন্তু একটা দিক ফাটলো চাকাটার, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলো না। বোঝাই যায়, ডানলপ এমনি এমনি এত নামডাক করেনি।
গ্লু বা আঠা
খুবই পরিচিত জিনিস। গৃহস্থালী ব্যবহারের যে গ্লু, তার ক্যাটাগরি ৩টা। প্রথমটা, অ্যাডহেসিভ টেপে যেমন থাকে, বা স্টিকিং প্লাস্টারে। এমনিতে শুকনো থাকে, হাতে লাগলেও আটকে যায় না, কিন্তু চামড়ায় বা অন্য কোথাও লাগিয়ে সামান্য চাপ দিলেই এই চাপের কারণে আটকে যায়। পরেরটা হলো "থার্মোপ্লাস্টিক গ্লু"। তরল অবস্থায় যেকোন কিছুর উপর দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যেই শুকিয়ে যায়, প্রচণ্ড শক্তভাবে ঐ বস্তুর সাথেই লেগে যায়। হাতের উপর লাগিয়ে দেখা গেছে, তোলার সময় হাতের লোমসহ ছিঁড়ে আনে। আর শেষটা, ইভাপোরেটিং ডিপেন্ডেন্ট গ্লু, সবচেয়ে শক্তিশালী, দেয়ালে পোস্টার লাগানোর জন্য যে তরল আঠা ব্যবহার করি সেগুলো। এর কণাগুলো যে বস্তুর সাথে লাগানো হয় তার অণুর সাথে বাতাসের উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে লেগে যায়। কেমন শক্তিশালী এটা? একটা কাঠের পাটাতনে একটা ইউনিফর্ম লাগিয়ে দেয়া হলো এই গ্লু দিয়ে, এরপর ৪ দিন শুকানো হলো। একজন লোককে বুকখোলা এই ইউনিফর্মে ঢুকিয়ে আটকে দেয়া হলো, এরপর ক্রেন দিয়ে তোলা হলো উপরে। ৯৫ কেজি ওজনের লোকটাকে তুলে নিলো, আর পুরো ওজনটাকে সাপোর্ট দিলো সাধারণ আঠা, দেখেও বিশ্বাস হয় না।
ব্রিটিশ পাউন্ড
টাকা জাল করা ঠেকাতে কত পদ্ধতিই তো নেয়া হয়, আমাদের টাকার মতই ব্রিটিশ পাউন্ডেও মেটাল থ্রেড থেকে শুরু করে আল্ট্রাভায়োলেট রে দিয়ে দেখা যায় এমন গোপন নম্বরও আছে। তবে জাল টাকা নিখুঁত করে ধরা খেয়ে গিয়েছিল জার্মানরা, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ঐসময়ে জার্মানরা এতই নিখুঁত পাউন্ড বানাতো যে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞরাও সেটা ধরতে পারতো না। শেষ পর্যন্ট সেটা ধরা পড়লো কিভাবে? না, জার্মানদের অতি খুঁতখুঁতে কাজের কারণে। ব্রিটিশ পাউন্ডে কোণার দিকে যে "N" থাকে, সেই "N" এর বাম দিকের কোণাটা, ব্রিটিশ ছাপাকারকদের খানিক অবহেলার কারণেই, বেশ ছড়ানো থাকতো, অনেকটা কালি ছড়িয়ে গেলে যা হয়। সবকিছুতেই খুঁতখুঁতে জার্মানদের সেটা হজম হয়নি, তারা পুরো নিখুঁত "N"-ই দিয়ে রাখতো, আর ঐ দেখেই ব্রিটিশরা ধরে ফেলতো, এই কাজ তাদের না। মাঝে মাঝে কাজে অবহেলাও সুফল আনে দেখা যায়!
সুপার গ্লু
আবার ফিরে আসি আঠাতে, তবে সাধারণ আঠা নয়, সুপার গ্লু। এটার আবিষ্কার একদম আকস্মিক। ১৯৪২ এর কথা, কোডাক (ফিল্ম কোম্পানি) এর ডঃ হ্যারি কুভার চেষ্টা করছিলেন স্নাইপারদের রাইফেলের গান-সাইটে ব্যবহারের জন্য স্বচ্ছ প্লাস্টিক বানাতে, মাঝ দিয়ে যেটা হলো, এমন এক যৌগ আবিষ্কার করে ফেললেন, যেটা ১০ সেকেন্ডের মাঝে চরমভাবে আটকে যায় যেকোন কিছুর সাথে, এমনকি মানুষের চামড়ার সাথেও। রাসায়নিক নাম "সায়ানোঅ্যাক্রাইলেট", পেটেন্ট করে এর নাম দেয়া হলো "সুপার গ্লু", বাজারজাতকরণ শুরু হয় ১৯৫৮ থেকে।
অবশ্য, এর থেকেও শক্তিশালী দামী গ্লু আবিষ্কৃত হয়েছে এর পরে, যেগুলোকে বলা হয় "ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লু", শিল্পকারখানা বা বিশেষ ধরণের যন্ত্রপাতিতেই সেগুলো ব্যবহৃত হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টিকিং প্লাস্টার এতই শক্তিশালী যে ৫ বর্গসেন্টিমিটারের একটা টেপ একটা ৯৫ কেজি মানুষকে শূন্যে ধরে রাখতে পারে ৫৮ সেকেন্ড, আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লু? মাত্র কয়েক ফোঁটা গ্লু দিয়ে ছোট, কয়েক ইন্ঞ্চির দু'টো অ্যালুমিনিয়ামের পাত জোড়া লাগানো হলো। এরপর ২ দিক থেকে শুরু হলো টানাটানি, একদিকে ৭০০ কেজি ওজন, অন্যদিকে টাগ-অভ-ওয়্যার দল, এরাও যে টান দিলো সেটার মান ওরকমই। হলো না কিছু। এরপরে টানা হলো গাড়ি দিয়ে, ছুটলো না। শেষমেশ ল্যাবরেটরিতে নিয়ে ইস্পাতের রডের শক্তি পরীক্ষার যন্ত্র দিয়ে টান দেয়া হলো। অবশেষে ছিঁড়লো, তবে কত শক্তি লেগেছিলো জানলে চোখ কপালে উঠে যাবে। মাত্র কয়েক ফোঁটা গ্লুকে ছাড়াতে লেগেছিলো পুরো ১৭০০ কেজি বল।
টাকা দিয়েই শেষ করি। মাঝেমাঝেই আমাদের বলা হয় হাত দিয়ে টাকা ধরলে হাত ধুয়ে ফেলতে, জীবাণু আছে। কথাটা পরীক্ষা করে দেখা হলো ঐ ব্রিটিশ পাউন্ডের উপরই। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখা গেল, এর আঁশগুলোর ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া, অনেকগুলোই কঠিন রোগ সৃষ্টিকারী। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো নিষ্ক্রিয় ব্যাকটেরিয়াগুলো। আপাতত এরা ক্ষতি করছে না, তবে উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই এরা সক্রিয় হয়ে উঠে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতে পারে।
আসলেই, অর্থই অনর্থের মূল।